বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের সিলেট-ম্যানচেস্টার রুট। আগামী মে মাস থেকে এই রুটে বাংলাদেশ বিমান আর ফ্লাইট চালাবে না। যে রুটে সিলেট থেকে প্রতি সপ্তাহে ডানা মেলত দুটি ফ্লাইট। এসব ফ্লাইটে ইংল্যান্ডে বসবাসকারী বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রবাসীরা সিলেটে আসা-যাওয়া করতেন। মাস শেষে যার সংখ্যা চার হাজারও বেশি। প্রবাসী বাংলাদেশিদের দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এই রুট চালু হয়। তবে চালুর মাত্র চার বছরের মাথায় সেটি আবার বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে।
কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, লোকসানের কারণে রুটটি আর রাখা যাচ্ছে না। তবে একাধিক সূত্র জানিয়েছে, লোকসান নয়। এটি একটি অজুহাত মাত্র। মূলত অন্য রুটে উড়োজাহাজ নিয়ে যাওয়ার জন্যই সিলেট-ম্যানচেস্টার রুটটি বন্ধ করা হচ্ছে। এই সিদ্ধান্তে প্রভাব রেখেছে বিমানে থাকা ‘সিলেটবিরোধী’ গ্রুপটি! তাদের সিলেট বিদ্বেষই প্রভাব ফেলছে এ ক্ষেত্রে।
সূত্র জানায়, ঢাকা-ইতালি ও ঢাকা-চায়না রুটে বিমান বাংলাদেশ ফ্লাইট পরিচালনা করলেও এখনো পর্যন্ত লাভের মুখ দেখেনি। সবচেয়ে বেশি লস হচ্ছে ইতালি রুটে। তবুও লোকসানের বোঝা মাথায় নিয়ে সেই রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করছে বিমান বাংলাদেশ। অন্যদিকে সিলেট-ম্যানচেস্টার রুটের ফ্লাইটগুলো সব সময় থাকে যাত্রীতে পরিপূর্ণ। এই রুটে যাত্রীদের চাপও বেশি। কয়েক মাস আগে বুকিং দিতে চাইলেও সিট খালি পাওয়া যায় না। এ অবস্থায় ‘লোকসান’-এর অজুহাত সঠিক নয়।
তবে কর্তৃপক্ষ এটি স্বীকার করছে না।
তারা বলছে, এই রুটে বিজনেস ক্লাসের কোনো যাত্রী পাওয়া যায় না। সবাই ইকোনমি ক্লাসে যাতায়াত করেন। ফলে বিজনেস ক্লাস খালি থাকে। এতে লোকসান গুনতে হয় বিমানকে। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের প্রধান নির্বাহী ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সাফিকুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, সিলেট-ম্যানচেস্টার রুটটি অলাভজনক বলে বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিমান বোর্ড। এ রুটে বিজনেস ক্লাস খালি থাকে। শুধু ইকোনমি ক্লাসের যাত্রী দিয়ে রুট চালানো সম্ভব না। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের সিলেট জেলা ব্যবস্থাপক শাহনেওয়াজ মজুমদার বলেন, সিলেট থেকে ম্যানচেস্টার রুটে ফ্লাইট বন্ধ হওয়ার ব্যাপারে তাদের কাছে এখনো কোনো নির্দেশনা আসেনি। ফলে ফ্লাইট বন্ধ হয়ে গেছে বা যাবে সেটি বলা যাচ্ছে না।
সিলেট-ম্যানচেস্টার রুট বন্ধের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর সিলেট ও পুরো ইংল্যান্ডের বাংলাদেশি কমিউনিটিতে চরম ক্ষোভ ও অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। রুট চালু রাখার দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠছেন তারা। ইতোমধ্যে লন্ডনে বাংলাদেশ হাই কমিশন, ম্যানচেস্টারে সহকারী হাই কমিশন ও সিলেটে একাধিক স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে সিভিল অ্যাভিয়েশনসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে। সিলেটে নেওয়া হচ্ছে গণস্বাক্ষর কর্মসূচি। ক্ষোভ দেখা দিয়েছে অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ-অ্যাটাবেও। সংগঠনের নেতারা রুট বন্ধের পেছনে স্বার্থান্বেষী মহল ও বিমানের ভেতরে থাকা ‘সিলেট বিদ্বেষ’কে দায়ী করছেন।
অ্যাটাব সিলেট জেলার সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান রুশো চৌধুরী বলেন, বিমান লোকসানের কথা বলে তাদের সিদ্ধান্তকে জায়েজ করতে চাইছে। এ অভিযোগ সঠিক নয়। উল্টো আমাদের যাত্রীরা সিট পান না। এই রুটে সিট খালি আসে না। বিমানের সবচেয়ে লাভজনক রুট হওয়ার পরও রহস্যজনক কারণে বিমান কর্তৃপক্ষ রুটটি বন্ধ করতে চাইছে। এটি তাদের ভুল সিদ্ধান্ত।
সিভিল এভিয়েশন সূত্র জানায়, বর্তমানে প্রতি সপ্তাহে সরাসরি সিলেট-ম্যানচেস্টার রুটে দুটি ও হিথ্রো বিমানবন্দরে চারটি ফ্লাইট পরিচালনা করছে বাংলাদেশ বিমান। লন্ডন প্রবাসী সিলেটিদের কথা চিন্তা করে ২০২০ সালে শুরু হয় সিলেট-ম্যানচেস্টার রুটে সরাসরি ফ্লাইট। শুরুতে এ রুটে তিনটি ফ্লাইট পরিচালিত হতো। তবে, গত অক্টোবর থেকে বন্ধ করা হয় একটি। বাকি দুটি ফ্লাইট চলছিল। এটিও বন্ধ করার পরিকল্পনা নিয়েছে সিভিল অ্যাভিয়েশন। এ লক্ষ্যে বিমান তার গ্রাহকদের এপ্রিল পর্যন্ত ফ্লাইট বুকিং নিচ্ছে। ১ এপ্রিল থেকে পরের দিনগুলোর জন্য তারা টিকিট দিচ্ছে না। ফলে ধরে নেওয়া হচ্ছে, এ দিন থেকেই এই রুটে বিমানের ফ্লাইট বন্ধ হয়ে যাবে।
প্রবাসীরা জানান, ম্যানচেস্টার শহর নর্থ ইংল্যান্ডে অবস্থিত। এর আশপাশে অন্তত ৩ লাখ প্রবাসী বাস করেন, যাদের বেশি সংখ্যকই সিলেটি। ম্যানচেস্টার-সিলেট সরাসরি ফ্লাইট চালু থাকায় তার পার্শ্ববর্তী বার্মিংহাম, নিউক্যাসল, সান্ডারল্যান্ড, গ্রেটার ম্যানচেস্টার ও পুরো স্কটল্যান্ডের প্রবাসীরা সুবিধা পেয়ে থাকেন। তারা সরাসরি ফ্লাইটের জন্য লন্ডন শহরের হিথ্রোতে না গিয়ে কাছের ম্যানচেস্টার থেকে সিলেটের পথে যাত্রা করতে পারেন। এতে ভোগান্তি ও সময় কম লাগায় রুটটি ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছিল। এ রুটে টিকিট পাওয়া অনেকটা সোনার হরিণের মতো এবং চড়ামূল্যের হলেও বিমান বাংলাদেশ সেটি স্বীকার করতে নারাজ।
এদিকে রুট বন্ধের খবরে ক্ষুব্ধ হয়ে বিপুলসংখ্যক কমিউনিটি নেতা ম্যানচেস্টার থেকে সিলেটে এসেছেন। তারা গত রোববার দুপুরে সিলেটে বিমান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। এ সময় প্রবাসী নেতারা অফিসের সামনে প্রতিবাদ কর্মসূচির আয়োজন করেন। এতে যুক্তরাজ্য থেকে আসা বেশ কয়েকজন প্রবাসী নেতা বক্তব্য রাখেন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট এমরান আহমদ চৌধুরী ও প্রচার সম্পাদক লোকমান আহমদ। প্রবাসী নেতাদের দাবি, বেসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয়ের একজন সিনিয়র সচিব ওই রুটে ফ্লাইট বন্ধের টালবাহানা করছেন। সিলেট জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট এমরান আহমদ চৌধুরী বলেন, অতীতে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছিল বিমান। এর ধারাবাহিকতায় মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে একটি লাভজনক রুটকে অলাভজনক দেখিয়ে সিলেটবিদ্বেষী একটি অংশ ফ্লাইট বন্ধের ষড়যন্ত্র করছে।
সিলেটবাসী কখনো বিমানের এ সিদ্ধান্ত মানবে না। বিষয়টি নিয়ে আমাদের তরফ থেকেও বিমান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করা হচ্ছে।
অপরদিকে ইংল্যান্ডে প্রবাসীদের প্রতিবাদ ও ক্ষোভের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশি কমিউনিটি নেতাদের সঙ্গে গত সোমবার ম্যানচেস্টারে বৈঠকে বসে বাংলাদেশ বিমান। বিমানের পক্ষে এতে অংশ নেন কান্ট্রি ম্যানেজার শামসুল করিম চৌধুরী। বৈঠকে তিনি বাস্তবতা তুলে ধরলে প্রবাসীরা যেকোনো মূল্যে ফ্লাইট পরিচালনা অব্যাহত রাখার দাবি জানান। এ সময় তিনি বিষয়টি ঢাকাকে অবহিত করে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেন।
ইংল্যান্ড প্রবাসী ও যুক্তরাজ্য বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক জসিম উদ্দিন সেলিম বলেন, বেশি ভাড়া দিয়েও আমরা এই রুটে যাচ্ছি-আসছি। যা বিরলই বলা চলে। তবুও লোকসানের অজুহাত দিয়ে কর্তৃপক্ষ রাষ্ট্রীয় এই সংস্থার ফ্লাইট বন্ধ করার পাঁয়তারা করছে। তিনি বন্ধ নয়, আরও ফ্লাইট বাড়ানোর দাবি জানান বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষের প্রতি। এ জন্য সরকারের উপর মহলের সুদৃষ্টি কামনা করেন।
বার্মিংহামের স্থায়ী বাসিন্দা ও সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলা সদরের আল আমিন বলেন, আমাদের দাবি ও আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে রুটটি চালু হয়েছে। চার বছরের মাথায় এসে সেই রুট বন্ধ করতে চাইছে কর্তৃপক্ষ। এটি তাদের ভুল সিদ্ধান্ত। এ থেকে অবশ্যই সরে আসতে হবে।
আপনার মতামত লিখুন :