ঢাকা রবিবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০২৪

কক্সবাজার-সেন্টমার্টিন রুটে পর্যটক ভোগান্তি

জালালউদ্দিন সাগর, চট্টগ্রাম

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২৮, ২০২৪, ১০:৫৭ এএম

কক্সবাজার-সেন্টমার্টিন রুটে পর্যটক ভোগান্তি

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

দীর্ঘসময় জাহাজ ভ্রমণে বিরক্ত এবং ভোগান্তিতে দিশাহারা কক্সবাজার থেকে সেন্টমার্টিনগামী পর্যটকরা। সীমাহীন যন্ত্রণা ও ভোগান্তি সহ্য করে প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিনে পৌঁছালেও ফেরার পথে ‘কান’ ধরছেন এই পথে দ্বিতীয়বার না যাওয়ার। টেকনাফ রুটে সেন্টমার্টিন যেতে আগে সময় লাগত দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা, জাহাজভেদে বর্তমানে কক্সবাজার থেকে সেন্টমার্টন যেতে সে সময় লাগছে ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা। কক্সবাজার থেকে সেন্টমার্টিন দ্বীপে আসা-যাওয়ায় সময় লাগে ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা। আবহাওয়া প্রতিকূল না থাকলে এই সময় বেড়ে দাঁড়ায় ১৬ থেকে ১৮ ঘণ্টায়।

দীর্ঘ সময় জাহাজে থাকার কারণে অসুস্থ হয়ে পড়েন পর্যটকরা। কারো কারো বমি হয় বারবার, আবার কেউ কেউ মাথা ঘুরে পড়ে যান সিট থেকে। শুধু তাই নয়, দীর্ঘ এই যাত্রায় অসুস্থ হয়ে জ্ঞান হারানোর চিত্র নিত্যদিনের।

অভিযোগ রয়েছে, প্রবাল দ্বীপে পৌঁছানোর পর যাত্রী উঠাতে ১ থেকে দেড় ঘণ্টা সময় দেয় জাহাজ কর্তৃপক্ষ। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে বার আউলিয়া ও কর্ণফুলী এক্সপ্রেস জেটিতে থাকে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা। তবে সাধারণত সর্বোচ্চ ১ ঘণ্টার মধ্যেই কক্সবাজারের উদ্দেশে নোঙর তোলে প্রতিটি জাহাজ। বাধ্য হয়েই পর্যটকদের রাত্রিযাপন করতে হয় সেন্টমার্টিনে। আর এ কারণেই দিনে এসে দিনে ফেরত যাওয়া পর্যটকের সংখ্যা শূন্যের কোঠায়। 

তথ্যানুসন্ধানে আরও জানা গেছে, জোয়ার-ভাটার ওপর নির্ভর করে আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে কক্সবাজার থেকে সেন্টমার্টিনে পৌঁছতে বে ক্রুজার, এলসিটি কাজল, গ্রিন লাইন, বার আউলিয়া ও কর্ণফুলী এক্সপ্রেসের সময় লাগে সাড়ে ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা। আবহাওয়া অনুকূলে না থাকলে সময় বেড়ে দাঁড়ায় ৬ থেকে ৭ ঘণ্টা।

কেয়ারি ক্রুজ অ্যান্ড ডাইন ও কেয়ারি সিনবাদের সময় লাগে সাত থেকে সাড়ে সাত ঘণ্টা আর আবহাওয়া অনুকূলে না থাকলে সময় লাগে ৮ থেকে ৯ ঘণ্টা। কক্সবাজার থেকে সেন্টমার্টিন যেতে ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা সময় লাগে আটলান্টিক ক্রুজের। আবহাওয়া অনুকূলে না থাকলে সময় বেড়ে দাঁড়ায় ৯ ঘণ্টারও বেশি। 

পর্যটকদের অভিযোগ, দিনে এসে দিনে ফেরত যেতে না পারলে জনপ্রতি ১০ হাজার টাকারও বেশি ব্যয় হয় সেন্টমার্টিনে। তিনি আরও বলেন, টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিনে আসা-যাওয়া জনপ্রতি খরচ হতো ১ হাজার টাকা। সেখানে কক্সবাজার থেকে সেন্টমার্টিনে যেতে বর্তমানে খরচ হয় আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা। তিন বা চারজনের একটি পরিবার সেন্টমার্টিনে গেলে ৫০ হাজার ছাড়িয়ে যায় ভ্রমণব্যয়। যে কারণে নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের জন্য গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রবালদ্বীপ ভ্রমণ।

গত ২০ ডিসেম্বর কক্সবাজার থেকে বার আউলিয়ায় শিপে ভ্রমণ করা পর্যটক হামিদুল ইসলাম জানান, সকাল ৮টার দিকে কক্সবাজার থেকে রওনা দিয়েছি, সেন্টমার্টিনে পৌঁছেছি বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে। পথের মধ্যে ১২ বছরের ছেলেটা বমি করতে করতে শেষ। বমি করেছে আমার স্ত্রীও। যোগ করেন এই পর্যটক। তিনি আরও বলেন, শুধু আমরাই নয়, আমাদের সাথে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন।

একই অভিযোগ করেন কেয়ারি সিনবাদে ভ্রমণ করতে আসা পর্যটক ইব্রাহিম। তিনি বলেন, সকাল ৭টার দিকে সেন্টমার্টিনের উদ্দেশে আমরা জাহাজে উঠেছি, সে জাহাজ পৌঁছেছে দুপুর আড়াইটার দিকে। সময় লেগেছে সাড়ে সাত ঘণ্টা।

সেন্টমার্টিনের স্থানীয় বাসিন্দা ও ফটোগ্রাফার আবু তৈয়ব জানান, জাহাজ পৌঁছানোর নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই।  একই জাহাজ কখনোই একই সময়ে আসে না। কোনো কোনো দিন যে জাহাজের ৬ ঘণ্টা লাগে, সে জাহাজই পরদিন আসে ৭ কিংবা ৮ ঘণ্টা পর।

দীর্ঘ সময়ের কারণে যাত্রীভোগান্তির বিষয়টি স্বীকার করেছেন কেয়ারি সিনবাদের মাস্টার জাহাঙ্গীর এবং সারেং আমির। কেয়ারি সিনবাদ জাহাজের মাস্টার জাহাঙ্গীর বলেন, টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিনে যেতে সময় লাগত জাহাজভেদে ২ থেকে আড়াই ঘণ্টা। আর কক্সবাজার থেকে এখন সময় ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা। ফিরে আসতেও একই সময় কিংবা এর চেয়েও বেশি সময় লাগে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, প্রতিদিন আমাদের পানিতে থাকতে হয় ১৪ থেকে ১৬ ঘণ্টা। দীর্ঘ সময় সমুদ্র ভ্রমণ পর্যটকেরা সহ্য করতে পারে না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সীমান্ত নিরাপত্তার কারণে চলতি বছর ১৭ আগস্ট থেকে টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিনগামী পর্যটকবাহী জাহাজ সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। পরে পর্যটনশিল্পের কথা চিন্তা করে টেকনাফ থেকে কক্সবাজারস্থ বিআইডব্লিউটিএ ঘাটে সরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয় মন্ত্রণালয়। গত ২৮ নভেম্বর সেন্টমার্টিনগামী পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচলের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিলেও কক্সবাজার থেকে সেন্টমার্টিনগামী জাহাজ চলাচল শুরু হয় ২ ডিসেম্বর। এদিন ৫২৮ জন যাত্রী নিয়ে চার মাস পর সেন্টমার্টিনের উদ্দেশে বিআইডব্লিউটিএ ঘাট থেকে নোঙর তুলে বার আউলিয়া। ৪ ডিসেম্বর কক্সবাজার থেকে প্রবালদ্বীপের উদ্দেশে ছেড়ে যায় বার আউলিয়া ও কেয়ারি সিনবাদ।

তথ্যানুসন্ধানে আরও জানা গেছে, সর্বোচ্চ ২০০০ পর্যটক যাত্রী নির্ধারণ করে প্রথম সাতটি জাহাজকে যাত্রী পরিবহনের জন্য অনুমোদন দেয় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে বার আউলিয়া পরিবহন করতে পারবে ৫২৮ জন পর্যটক, কর্ণফুলী এক্সপ্রেস ৪৬৬ জন, কেয়ারি ক্রুজ অ্যান্ড ডাইন ১৯৩ জন, কেয়ারি সিনবাদ ২১৫, বে ক্রুজার (০১)  ১৫১ জন, এলসিটি কাজল ১৮৬ জন, আটলান্টিক ক্রুজ ১৮৬ জন, গ্রিন লাইন (০১) পরিবহন করতে পারবে ৭৫ জন পর্যটক। 

বাংলাদেশে পর্যটনশিল্পের ওপর প্রায় ১০ লাখ মানুষ নির্ভরশীল জানিয়ে কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ রশীদ বলেন, যেভাবেই হোক পর্যটনশিল্পকে আমাদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে। তিনি আরও বলেন, সেন্টমার্টিন যাওয়ার সহজ পথ হচ্ছে টেকনাফ। যাত্রী নিরাপত্তা নিশ্চিত করে যেভাবেই হোক, টেকনাফ রুটেই আমাদের ফিরে যাওয়া উচিত। না হয় দিনে দিনে সেন্টমার্টিনের পর্যটনশিল্প হুমকির মুখে পড়বে। তিনি আরও বলেন, আমরা ইনানিতে জেটি নির্মাণ করেছিলাম। ইনানি থেকেও যদি সেন্টমার্টিনগামী জাহাজগুলো ছাড়ার অনুমোতি দেওয়া হতো তাহলে ২ ঘণ্টা সময় কম লাগত।

সমুদ্রপথে দীর্ঘ সময়ের বিষয়টি অবগত আছেন বলে জানিয়েছেন কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন। তিনি বলেন, পর্যটক নিরাপত্তাসহ পারিপার্শ্বিক অনেকগুলো কারণে সেন্টমার্টিনে যাওয়ার রুট পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছি। পরিস্থিতি অনুকূলে এলে আমরা আবারও পুরোনো রুটেই ফিরে যাব উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ভ্রমণের বেশির ভাগ সময় পর্যটকদের পানির মধ্যেই কেটে যায়। যে কারণে শিশুসহ নারীরা নানা সমস্যায় ভোগেন।

বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) মো. সফিউজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন সমুদ্রপথটাই পর্যটকদের জন্য ভালো রুট। এই রুটে টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন যেতে আড়াই থেকে ৩ ঘণ্টা সময় লাগে, যা সহনীয়। পর্যটক ভোগান্তির বিষয়টি নিয়ে ভাববার সুযোগ আছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, পরবর্তী সিজনে যাতে টেকনাফ-সেন্টমার্টিন রুট চালু করা যায়, সে বিষয়টি আলোচনা করব।

আরবি/জেডআর

Link copied!