মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার বাড়াদিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শাহ মো. রফিকুল ইসলাম অ্যাডিশনের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। বিদ্যালয়ের নিযুক্ত কর্মচারীদের পারিবারিক কাজে বাধ্য করাসহ এমপিও বেতনে অন্তর্ভূক্ত করার কথা বলে হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন ভূক্তভোগিরা।
এছাড়াও, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভর্তি ফি, সেশন ফি, বেতন ও পরীক্ষা ফি আদায়, বিদ্যালয়ে শিক্ষক, কর্মচারি নিয়োগ বাণিজ্য, এমপিও ভূক্তকরণের জন্য ঘুষ, সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পের নামে অর্থ লুটপাট, বিদ্যালয়ের মার্কেট নির্মাণ ও ভাড়ার অর্থ গড়মিল, বিদ্যালয়ের আয়-ব্যয়ের হিসাবে অতিরিক্ত ও কাল্পনিক ভাউচারে লাখ লাখ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগ যাচাই ও সত্যতার নিশ্চিতের জন্য তথ্য দিতে গড়িমসি করে নিয়ম অনুযায়ী তথ্যের জন্য আবেদন চেয়েছেন প্রধান শিক্ষক।
স্থানীয়রা ও ভূক্তভোগিরা অভিযোগ করে জানান, ১৯৯৯ সালে প্রধান শিক্ষক যোগদান করেন। এরপর থেকেই তিনি নানা অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ২০০৯ সালের পর থেকে ওই প্রধান শিক্ষক আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে উঠেন। উথলি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টার দায়িত্বপালন করেন। পছন্দ মতো প্রতিবার বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটি গঠনেও তাঁর অপতৎরতা রয়েছে। তিনি লুটপাতে বৈধতার জন্য স্থানীয় প্রভাবশালী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নিয়ে পকেট কমিটি গঠন করে হাতিয়ে নিতেন অর্থ। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে সরকারি নির্ধারিত ফি’র চেয়ে অতিরিক্ত ভর্তি ফি, সেশন ফি বেতন ও পরীক্ষা ফি আদায় করেন। অতিরিক্ত ফি’র কোন রশিদ দেন না তিনি।
তাঁর যোগদানের পর থেকে এ পর্যন্ত বিদ্যালয়ে প্রত্যেক শিক্ষক ও কর্মচারি নিয়োগে বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। তাদের এমপিও ভূক্তকরণের জন্য ঘুষের কথা বলে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। বিদ্যালয়ে সংস্কার কাজ, প্রাচীর নির্মাণসহ সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের নামেমাত্র কাজ করে অর্থ লুটপাটের অভিযোগ রয়েছে। বিদ্যালয়ের জায়গায় বাড়াদিয়া বাজারে পাঁচটি দোকান ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। প্রতিটি কক্ষ ১ লাখ টাকা অগ্রিম ও মাসিক ২ হাজার টাকা ভাড়া দেয়া হয়েছে। মার্কেট নির্মাণ ও ভাড়ার অর্থ গড়মিলের অভিযোগ রয়েছে।
এছাড়া, বিদ্যালয়ের আয়-ব্যয়ের হিসাবে অতিরিক্ত ও কাল্পনিক ভাউচারে লাখ লাখ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে।
২০০৫ সালে নৈশ প্রহরী ও আয়া নিয়োগ দেন প্রধান শিক্ষক। এই নিয়োগপ্রাপ্ত নৈশ প্রহরি মো. বাদশা মিয়া ২০০৪ সালে থেকে বিদ্যালয়ে কর্মরত থাকলেও তাকে নিয়োগ দেখানো হয় ২০০৫ সালেই। ২০১৯ সাল পর্যন্ত দায়িত্বপালন করেছেন বাদশা। তাকে দিয়ে নৈশ প্রহরির দায়িত্বপালন করা ছাড়াও প্রধান শিক্ষকের পারিবারিক কাজ করানো হতো। এমপিওভূক্ত না থাকলও তাকে যথাক্রমে ৮০০, ১৫০০ ও ২০০০ টাকা ভাতা দেয়া হতো। এমপিওভুক্ত করার কথা বলে তার কাছ থেকে প্রধান শিক্ষক ৯ হাজার টাকা ঘুষ নেন। পরে এমপিওভূক্ত না হওয়ায় চাকুরি ছেড়ে দেন তিনি।
এছাড়া সুবিয়াকে বিদ্যালয়ের আয়া নিয়োগ দেয়া হয় ২০০৫ সালে। নিয়োগের ছয় মাস পর্যন্ত ৪০০/৫০০ টাকা মাসিক ভাতা দেয়া হতো। এমপিওভূক্ত না হওয়ায় তিনি বিদ্যালয়ে যাওয়া বন্ধ করে দেন। এরপর ২০১১ সালে এমপিওভূক্ত করার কথা বলে সুবিয়ার কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা ঘুষ ও নিয়োগপত্র নিয়ে নেন প্রধান শিক্ষক। পরে তাকেও আর নিয়োগ দেয়া হয়নি।
এরপর বিদ্যালয়ে মো. রাজিব হোসেনকে নৈশ প্রহরি নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তিনি চাকরি করেন ঢাকায়। প্রধান শিক্ষকের যোগসাজশে হাজিরায় স্বাক্ষর করে মাসিক ৮২৫০ টাকা স্কেলে বেতন তুলে নেন রাজিব। কিন্তু রাজিবের পিতা রশিদ বিদ্যালয়ে নৈশ প্রহরির দায়িত্বপালন করেন। তিনিও প্রধান শিক্ষকের পারিবারিক কাজ করেন। রশিদ বয়স্ক হওয়ায় তাকে নিয়ম অনুযায়ী নিয়োগ দেয়া সম্ভব হয়নি। তাই রাজিবকে নিয়োগ দিয়ে তার পিতাকে দিয়ে দায়িত্বপালন করানো হচ্ছে।
এ বিষয়ে ভূক্তভোগি সাবেক নৈশ প্রহরি মো. বাদশা মিয়া বলেন, ‘২০০৪ সাল থেকে বিদ্যালয়ে নৈশ প্রহরির দায়িত্বপালন করলেও আমাকে নিয়োগ দেয়া হয়ে ২০০৫ সালে। রাতে বিদ্যালয়ে প্রহরির দায়িত্বপালন করলেও দিনে প্রধান শিক্ষকের পারিবারিক কাজ করতে হতো। ২০১৯ সাল পর্যন্ত বিদ্যালয়ে এভাবেই কাজ করেছি। নামেমাত্র বেতন দেয়া হতো। এমপিওভূক্ত করার কথা বলে আমার কাছ থেকে প্রধান শিক্ষক ৯ হাজার টাকা ঘুম নিয়েছেন। কিন্তু বেতন না বাড়ায় চাকুরি দেড়ে দিয়েছি।
আরেক ভূক্তভোগি সুবিয়া অভিযোগ করে বলেন, ‘২০০৫ সালে আমাকে আয়া নিয়োগ দেয়া হয়। ৪০০/৫০০ টাকা আমাকে বেতন দেয়া হতো। তাই ছয় মাস কাজ করে আর বিদ্যালয়ে যাইনি। পরে ২০১১ সালে প্রধান শিক্ষক আমাকে বেতন বাড়ানোর কথা বলে ১০ হাজার টাকা ও নিয়োগপত্র নিয়ে নেন। পরে আর আমাকে নিয়োগ দেয়া হয়নি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিদ্যালয়ের মার্কেটের কয়েকজন ভাড়াটিয়া জানান, ১ লাখ টাকা অগ্রিম ও মাসিক ২ হাজার টাকা ভাড়ায় প্রধান শিক্ষকের কাছ দোকান ঘর ভাড়া নিয়েছেন তারা। কিন্তু, এ সংক্রান্ত কাগজপত্র দেখাতে চাননি তারা।
বর্তমান নৈশপ্রহরি রাজিবের মাতা সাংবাদিকদের বলেন, ‘রাজিব আগে ঢাকায় চাকরি করতো। এখন দুই মাস ধরে রাজিব বাড়িতে আছে।’ মো. রাজিব হোসেন বলেন, ‘আমি জরুরি কাজে ঢাকায় আছি। প্রধান শিক্ষকের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে এসেছি।
গত সোমাবার দুপুরে বিদ্যালয়ে গিয়ে প্রধান শিক্ষকের এসব অভিযোগ যাচাই ও সতত্য নিশ্চিত হতে দাপ্তরিক নথিপত্র দেখে তথ্য চাইলে তিনি গড়িমসি করেন। সাংবাদিকদের সঙ্গে একথা ওকথা বলে তালবাহানা শুরু করেন। নিজের আত্নীয়-স্বজন দেশের প্রভাবশালী পদে কর্মরত আছেন। তাদের পরিচয় তুলে ধরেন। এক পর্যায়ে প্রধান শিক্ষক সরকারি নিয়ম অনুযায়ী ওইসব অভিযোগের বিষয়ে আবেদন দিতে বলেন। পরে তথ্য চেয়ে প্রধান শিক্ষকের কাছে আবেদন দেয়া হয়। এ কারণে তাৎক্ষণিকভাবে তাই প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে ওইসব অভিযোগ যাচাই করা
যায়নি। নথিপত্রের তথ্য পেয়ে যাচাই করলে প্রধান শিক্ষকের নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট প্রমাণ উদঘাটন করা যাবে।
এ ব্যাপারে বাড়াদিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শাহ মো. রফিকুল ইসলাম অ্যাডিশন বলেন, ‘বাদশা ও সুবিয়ার কাছ থেকে কোন টাকা নেয়া হয়নি। রাজিব নিয়মিত নৈশ প্রহরির দায়িত্বপালন করছেন। ৫ লাখ টাকা অগ্রিম নিয়ে মার্কেট নির্মাণ করা হয়েছে। আমি স্ট্রোকের রোগী, তাই অন্যসব অভিযোগের বিষয়ে আমার মনে নেই। বিদ্যালয়ে নথিপত্র দেখতে হবে। আপনারা তথ্য চেয়ে আবেদন দেন।’
প্রধান শিক্ষকের অভিযোগগুলোর বিষয়ে ফোনে জানতে চাইলে শিবালয় উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আবুল খায়ের বলেন, ‘প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো আমার জানা নেই। তাঁর সঙ্গে কথা বলে আপনাদের জানাতে পারবো।’
এ ব্যাপারে শিবালয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও পদাধিকার বলে ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি মো. বেলাল হোসেন বলেন, ‘অভিযোগগুলোর বিষয়ে আমার জানা নেই। লিখিত অভিযোগ পেলে সুষ্ঠু তদন্ত করে ব্যবস্থাগ্রহণ করা হবে।’
আপনার মতামত লিখুন :