দেশজুড়ে চুয়াডাঙ্গার খেজুরের গুড় ও নলেন পাটালির সুখ্যাতি আছে। স্বাদে-গন্ধেও অতুলনীয়। খেজুর গুড় ও নলেন পাটালি বেচাকেনাকে কেন্দ্র করে এখন জমজমাট ৩০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী সরোজগঞ্জ হাট। হাটের দিন এখানে দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসছেন ব্যাপারীসহ ক্রেতা-বিক্রেতা।
চুয়াডাঙ্গা-ঢাকা মহাসড়কের সদর উপজেলার কুতুবপুর ইউনিয়নের সরোজগঞ্জ মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে শীত মৌসুমে সপ্তাহে দুই দিন সোমবার ও শুক্রবার এই গুড়ের হাট বসে। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত চলে বেচাকেনা। এরপর ছোট-বড় ট্রাকসহ বিভিন্ন যানবাহনে সারা দেশে পৌঁছে যায়।
চুয়াডাঙ্গা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যনুযায়ী, বর্তমানে জেলায় দুই লাখ ৭২ হাজার খেজুরগাছ রয়েছে। এর অর্ধেকই সদর উপজেলায়। এ জেলা থেকে প্রতি মৌসুমে প্রায় দুই হাজার ৭০০ মেট্রিক টন গুড় উৎপাদিত হয়। তবে গাছিদের অভাব এবং নতুন করে গাছ রোপণ না করায় খেজুর গাছের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। প্রতিনিয়ত বাড়ছে চাহিদা, যারফলে তুলমামূলক উৎপাদন কম হচ্ছে।
সোমবার (৬ জানুয়ারি) সরেজমিনে দেখা যায়, বিদ্যালয়ের মাঠে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে কৃষকেরা গুড়ভর্তি মাটির কলস করে নলেন টালি নিয়ে বসে আছেন। বাতাসে ভেসে আসছে মিষ্টি একটা গন্ধ। ক্রেতারা হাতে থাকা লোহার শিক দিয়ে গুড় ও পাটালি ভেঙে মুখে পুরে পরীক্ষা করছেন। দরদাম ঠিক হলেই গুড়ের কলসগুলো মাঠের এক পাশে সাজানো হচ্ছে। প্রতিটি কলসের গায়ে সাংকেতিক চিহ্ন দেওয়া হচ্ছে, যাতে পরে দ্রুত খুঁজে পাওয়া যায়। ব্যাপারীদের পাশাপাশি অনেকেই নিজের পরিবার ও স্বজনদের বাড়িতে পাঠাতেগুড় কিনে নিয়ে যাচ্ছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেল, মাটির হাঁড়ি বা ভাঁড়ের আকার ও ওজনভেদে দাম ওঠানামা করে। প্রতিকেজি গুড় ২০০-২৫০ টাকা এবং এক ভাঁড় গুড় ৯০০-২৬০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা হচ্ছে।
হাট সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রতিবছর এ হাট থেকে বেচাকেনার পরিমাণ দাঁড়ায় ৫০-৬০ কোটি টাকা। ঢাকা, চট্টগ্রাম, মেহেরপুর, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, পাবনা, বরিশাল, ময়মনসিংহ, মাগুরা, রাজবাড়ী, পঞ্চগড়, সিলেট, খুলনা, রংপুরসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ক্রেতারা আসেন গুড় কিনতে।
বরিশাল থেকে আসা ব্যবসায়ী আমিনুল হক বলেন, এবার গুড়ের দাম বেশি কিন্তু সরবরাহ কম। তবে গুড়ে ভেজাল নেই। এছাড়া এ হাটে ব্যাপারীরা বেশ নিরাপত্তা পান। তাই ইচ্ছেমতো গুড় কেনা যায়।
গুড় কিনতে এসেছেন শফিকুল ইসলাম। তিনি রুপালী বাংলাদেশকে বলেন, এই হাটে ভেজালমুক্ত গুড়-পাটালি পাওয়া যায় বলেই এর সুনাম সারাদেশে। তবে দাম কিছুটা বেশি এই হাটে।
স্থানীয়রা জানান, প্রতিবছর শীত মৌসুমে সারাদেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি খেজুর গুড়ের বেচাকেনা হয় এই হাটে। স্বাদে ও গন্ধে এখানকার গুড়
অতুলনীয়। মৌসুমের প্রায় পুরো সময়জুড়ে হাজারো ক্রেতা-বিক্রেতার ভিড়ে জমজমাট থাকে এই হাট।
চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার খেজুরা গ্রামের গুড় ব্যবসায়ী বাবুল বলেন, এ হাটে খাঁটি গুড় পাওয়া যায়। এখানকার গুড়ে কোনো ভেজাল নেই। বহু জায়গা থেকে ব্যাপারী আসে এখানে।
আনারুল ইসলাম নামের একজন চাষি বলেন, গত বছর ২৫টি গাছ প্রস্তুত ছিল। এবার সে সংখ্যা কমে ১২টিতে নেমেছে। গাছ থেকে যেটুকু রস
পাওয়া যাচ্ছে তা দিয়ে গুড় তৈরি করা হচ্ছে।
বাজার কমিটি জানিয়েছে, এ হাট থেকে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হয় গুড়। এ হাটে বিক্রি হওয়া বেশির ভাগ গুড়ই এলাকার কৃষক ও গাছিরা তাদের বাড়িতে যত্নের সঙ্গে তৈরি করেন। এতে চিনি বা কোনও রাসায়নিক নেই। কিছুটা খয়েরি রঙের হলেও এসব গুড় পুরোটাই খাঁটি।
চুয়াডাঙ্গা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মাসুদুর রহমান সরকার রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, শীত মৌসুমে প্রতিটি গাছ থেকে অন্তত ১০-১২ কেজি গুড় পাওয়া যায়। সে হিসেবে প্রতিবছর গড়ে দুই হাজার ৭০০ মেট্রিক টন গুড় উৎপাদিত হয়। সরোজগঞ্জ খেজুর গুড়ের দেশের প্রধান হাট। এখানে সপ্তাহে প্রায় দুই কোটি টাকার গুড় বেচাকেনা হয়।
তিনি আরও বলেন, নানা কারণে গাছের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। গাছের সংখ্যা বৃদ্ধি না পেলে ভবিষ্যতে গুড়ের উৎপাদন কমে যাবে। এতে ঐতিহ্যবাহী
সরোজগঞ্জ হাটের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়তে পারে।
আপনার মতামত লিখুন :