ইকবাল হোসেন ইমাদ। ইসলামী ছাত্রশিবিরের গুরুত্বপূর্ণ নেতা। সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা শাখার সেক্রেটারি। দিন ভালো যাচ্ছিল না তার দলের। খুব সহসা দিন ফেরারও লক্ষণ দেখছিলেন না। অথচ তার খায়েশ ছিল শুধু দলের নেতা হওয়া নয়, জনপ্রতিনিধি হওয়া, ক্ষমতার চেয়ার পাওয়া। একদম ক্ষমতার প্রথম ধাপ থেকেই তিনি শুরু করতে চেয়েছিলেন। তাই নজর পড়ে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের চেয়ারটার ওপর। কিন্তু তিনি যে রাজনীতি করেন, তাতে তার সে খায়েশ সহসা পূরণ হওয়ার ছিল না। ধৈর্যও ছিল না অত বেশি। তাই সিদ্ধান্ত খোলস পাল্টানোর।
একেবারে তৎকালীন সরকার দল আওয়ামী লীগের ছায়ায় আশ্রয় নিতে চাইলেন। দলবদল অতটা সহজ ছিল না। ‘অনুপ্রবেশ’ ঠেকাতে যখন আওয়ামী লীগ সোচ্চার, তখনই তিনি টাকার থলে নিয়ে হাজির। খোলস পাল্টে ঠিকই জায়গা করে নিলেন দলের হাইকমান্ডের সুনজরে। ভাগিয়ে নিলেন ইউপি চেয়ারম্যানের নমিনেশন। তাও তার স্বভাববিরোধী রাজনৈতিক দলÑ আওয়ামী লীগের। আ.লীগ বড় অংকের অর্থের বিনিময়ে বিক্রি হয়ে তার হাতেই নমিনেশন তুলে দেয়। ফলে ২০২১ সালের ১১ নভেম্বর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার রণিখাই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
বিষয়টি সে সময় ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি হয়। চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে স্থানীয় রাজনীতিতে তার পরিচিতি হয়ে ওঠে ‘নৌকার মাঝি শিবির নেতা’ হিসেবে।
স্থানীয় রাজনৈতিক সূত্র জানায়, তিনি সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নাসির উদ্দিন খানের মাধ্যমে বড় অংকের টাকা লেনদেনে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড থেকে টিকিট ভাগিয়ে নিয়েছিলেন। এতে সহায়তা করেছিলেন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা, দলের সাংগঠনিক সম্পাদক ও নমিনেশন কমিটির সদস্য আহমদ হোসেন। এ দুজনের হাত ধরেই তিনি শিবির নেতা থেকে হয়ে ওঠেন নৌকার মাঝি।
এদিকে যখন তাকে নিয়ে এলাকায় ব্যাপক প্রতিক্রিয়া, তখন তিনি নিজেকে আওয়ামী লীগের প্রমাণ করতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। দলের হয়ে নিজের প্রাক্তন সংগঠনের বিরুদ্ধে নেমে পড়েন মাঠে। সর্বশেষ কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় তিনি সামনের সারিতে থেকে ছাত্রদের রুখে দেওয়ার সব চেষ্টা চালিয়ে যান। ছাত্রদের ওপর হামলা হয় তার নেতৃত্বে। এ হামলার ঘটনায় থানায় দায়ের করা হয় মামলাও। সেই মামলায় রণিখাই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেন ইমাদকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
গতকাল সোমবার বেলা আড়াইটার দিকে উপজেলা পরিষদ কমপ্লেক্স থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। বর্তমানে তার পূর্বের দল জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবির যখন আবার সক্রিয় রাজনীতিতে এবং ক্ষমতার কাছাকাছি, তখন সেই জামায়াত-শিবিরকে প্রত্যাখ্যান করা ইকবাল হোসেন ইমাদ আওয়ামী লীগের হয়ে পুলিশের হাতে আটক। এ নিয়ে কোম্পানীগঞ্জসহ ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনামুখর সিলেট। অনেকে বলছেন, দল ও আদর্শের সঙ্গে এটি বিশ্বাসঘাতকতারই শাস্তি। নিজের দল ছেড়ে নৌকার মাঝি হওয়াই এখন তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার যেমন ধ্বংসের মুখে তেমনি ক্ষমতায় থাকার খায়েশও বিলীনের পথে।
সূত্র জানায়, ২০২১ সালের ইউপি নির্বাচনে উপজেলা ছাত্রশিবিরের শীর্ষ নেতা হয়েও মনোনয়ন ভাগিয়ে নেওয়ায় সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। ইসলামী ছাত্রশিবিরে তার দায়িত্ব পালনের তথ্য-প্রমাণসহ গণমাধ্যমে এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ এবং পক্ষে-বিপক্ষে সংবাদ সম্মেলনও হয়। কিন্তু প্রার্থিতা বাতিল না করে তার ওপরই ভরসা রাখে আওয়ামী লীগ! অবশেষে তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়নে নৌকা প্রতীকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। সে সময় অভিযোগ করা হয়, স্থানীয় আওয়ামী লীগের মনোনয়ন তালিকা উপেক্ষা করে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের মাধ্যমে তিনি মনোনয়ন পেয়েছিলেন। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা ও জেলা আওয়ামী লীগ তার মনোনয়ন প্রাপ্তিকে ‘অনুপ্রবেশ’ বলে অভিহিত করে।
এমন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্যে ২০২১ সালের ১১ নভেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ইকবাল হোসেন ইমাদ তিন হাজার ৭২২ ভোট পেয়ে চেয়ারম্যান পদে বিজয়ী হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী শামস উদ্দিন শাহীন ভোট পান ২ হাজার ৫৯৫টি।
৫ আগস্টের আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে সরকারের পক্ষে মাঠে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। আন্দোলনের বিরোধিতা করে তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও সোচ্চার ছিলেন। আন্দোলনের বিরুদ্ধে নানা রকম পোস্ট দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে প্রচার চালান। ৫ আগস্ট সরকারের পতনের পর ইকবাল হোসেন ইমাদ আত্মগোপনে চলে যান। কিছুদিন আত্মগোপনে থেকে সোমবার উপজেলা পরিষদ কমপ্লেক্সে স্থানীয় সরকারের একটি সভায় অংশ নিয়ে ফেরার পথে গ্রেপ্তার হন তিনি।
আপনার মতামত লিখুন :