ঢাকা রবিবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪

পার্বত্য চুক্তির ২৭ বছর শান্তি ফেরেনি পাহাড়ে

মোহাম্মদ ইলিয়াছ, বান্দরবান

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২, ২০২৪, ১২:৩৫ এএম

পার্বত্য চুক্তির ২৭ বছর শান্তি ফেরেনি পাহাড়ে

ছবি: সংগৃহীত

পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি চুক্তির ২৭ বছর অতিবাহিত হলেও এখনো শান্তি ফিরেনি পাহাড়ে। এখনো মানুষ রাতে ঘুমাতে পারে না অস্ত্রের ঝনঝনানিতে। চাঁদাবাজি, খুন, গুম, হত্যা নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এদিকে শান্তি চুক্তির পর থেকে গড়ে উঠেছে আরও ছয়টি সশস্ত্র সংগঠন। এই সশস্ত্র সংগঠনগুলোর আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে এ পর্যন্ত কয়েক শ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটিয়েছে।


পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি সম্প্রদায়গুলোর অধিকার আদায়ে পিসিজেএসএস গেরিলা সশস্ত্র সংগঠন (শান্তিবাহিনী) গড়ে তোলে। সংগঠনটি পার্বত্য চট্টগ্রামে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠায় তংকালীন আওয়ামী লীগ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (পিসিজেএসএস) সঙ্গে এ সমস্যা নিরসনে রাজনৈতিকভাবে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর শান্তি চুক্তি সম্পাদন করে। 

তবে অভিযোগ রয়েছে, চুক্তি-পরবর্তী সময়ে শর্ত ভঙ্গ করে পিসিজেএসএসের সশস্ত্র গেরিলা ‘শান্তিবাহিনী’ বিলুপ্ত ঘোষণা করলেও বাস্তবে এখনো তাদের কার্যক্রম পাহাড়ে বহাল তবিয়তে রয়েছে। তা ছাড়া চুক্তির আগে পাহাড়ে শুধু শান্তিবাহিনী নামে একটি সশস্ত্র সংগঠন ছিল। কিন্তু চুক্তির পর বিগত ২৭ বছরে গড়ে উঠেছে আরও ছয়-ছয়টি সংগঠন। এগুলো হচ্ছে পিসিজেএসএসের সশস্ত্র গ্রুপ, জেএসএস সংস্কার ও তার সশস্ত্র গ্রুপ, ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) ও তার সশস্ত্র গ্রুপ, ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) ও তার সশস্ত্র গ্রুপ, মগ লিবারেশন আর্মি বা মগ পার্টি সশস্ত্র গ্রুপ এবং সর্বশেষ কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ) সশস্ত্র গ্রুপ। 


সশস্ত্র এসব গ্রুপের কারণে পাহাড়ে চাঁদাবাজি, অপহরণ, খুন, গুমও বেড়েছে। এই অবৈধ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য অবৈধ অস্ত্রের চোরাচালান আসছে বিদেশ থেকে প্রতিনিয়ত। এ ছাড়া এদের আধিপত্য বিস্তারের ঘটনায় পাহাড়ে দিনের পর দিন অশান্তি বাড়ছে। বিগত ২৭ বছরে এই সশস্ত্র গ্রুপগুলো ঘটিয়েছে কয়েক শ হত্যাকাণ্ড। বিগত সাত বছরে শুধু বান্দরবানে (২০১৮ থেকে ২০২৪ সাল) সন্ত্রাসীদের হাতে প্রাণ হারিয়েছেন ৭ সেনাসদস্যসহ ৫২ জন পাহাড়ি-বাঙালি মানুষ। এদিকে চুক্তির পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে এখনো সভা-সমাবেশে ব্যস্ত রয়েছে পাহাড়ি-বাঙালি সংগঠনগুলো।

পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান কাজী মো. মজিবর রহমান বলেন, যে কোনো চুক্তির মাধ্যমে দুই পক্ষকে লাভবান করে দিতে হয়। পার্বত্য চুক্তির মাধ্যমে একটি পক্ষকে (পাহাড়ি সম্প্রদায়) লাভবান করা হয়েছে আর অপর পক্ষকে (বাঙালি সম্প্রদায়) ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে। এর ফলে পাহাড়ে এখনো অশান্তি বিরাজমান বলে মনে করেন এই বাঙালি নেতা। 


তবে পাহাড়ি নেতাদের দাবি, চুক্তির মৌলিক শর্তগুলো আজও বাস্তবায়িত হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশন গঠিত হলেও তা এখনো অকার্যকর। তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদের নির্বাচন নেই। পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ আইন অকার্যকর। ফলে প্রতিষ্ঠা পায়নি পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার স্থায়ী রাজনৈতিক সমাধান। 

বিগত আওয়ামী লীগ সরকার চুক্তি বাস্তবায়নের নামে কালক্ষেপণ করেছে দাবি করে বান্দরবান সার্ক মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের সহসভাপতি সেনাবাহিনীর সাবেক সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার অং চ মং মারমা বলেন, চুক্তি বাস্তবায়িত হলে  সশস্ত্র গ্রুপগুলো আর কোনো অজুহাতে পাহাড়ে সক্রিয় থাকতে পারত না। ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) বান্দরবান শাখার সভাপতি উবামং মারমা বলেন, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ায় পাহাড়ের সশস্ত্র গ্রুপগুলো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সুযোগ নিচ্ছে। এ ছাড়া ভারতের মতো প্রতিবেশী দেশ চট্টগ্রামকে অস্থিতিশীল করতে নানাভাবে সংকট সৃষ্টির চেষ্টা করা হচ্ছে এবং ভারতের মিডিয়াগুলো বিভিন্ন প্রোপাগান্ডা ছড়াচ্ছে বলে তিনি মনে করেন।


চুক্তি সম্পাদনকারী অপর পক্ষ পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (পিসিজেএসএস) কেন্দ্রীয় সহসভাপতি ও আঞ্চলিক পরিষদ সদস্য কে এস মং বলেন, বর্তমান অন্তর্বরর্তীকালীন সরকার চুক্তির গুরুত্ব বুঝতে পেরেছে বলেই সরকারিভাবে আনুষ্ঠানিক চুক্তির বর্ষপূর্তি পালনের উদ্যোগ নেওয়ায় আমরা চুক্তি বাস্তবায়ন ও পার্বত্য সমস্যা সমাধানে আশাবাদী।

 তিনি পাহাড়ে খুন, অপরণ ও চাঁদাবাজিতে লিপ্ত থাকা সশস্ত্র গ্রুপগুলোর বিষয়ে বলেন, পাহাড়ে যতগুলো গ্রুপ ও উপ-গ্রুপ রয়েছে, তাদের প্রতি বিশেষ সমর্থন প্রত্যাহার হলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাওয়ার কথা। কারণ জনগণের প্রয়োজনে গ্রুপ ও উপ-গ্রুপগুলো সৃষ্টি হয়নি, তাই এসব গ্রুপ টিকে থাকার কথা নয় বলে মনে করেন এই পিসিজেএসএস নেতা। 
এদিকে স্থানীয় সচেতন মহল মনে করে, শুধু শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নে পাহাড়ে শান্তি ফিরে আসবে না। পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় সব পক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ঐকমত্যের ভিত্তিতে উদ্যোগ নিলে এই সমস্যার সমাধান হবে।

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!