রাজশাহী পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষের (ওয়াসা) পানির দাম গত তিন বছরের ব্যবধানে বেড়েছে তিন গুণ। চলতি বছর আরো ৩০ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। অথচ বিগত বছরের তুলনায় পানির মান বৃদ্ধি পায়নি। আবার দাম বাড়ানোর প্রস্তাবে জনমনে তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করছে।
অথচ রাজশাহী ওয়াসার সুপেয় পানি পেতে গ্রাহকদের অপেক্ষা করতে হবে গোদাগাড়ীতে নির্মাণাধীন ট্রিটমেন্ট প্লান্টের কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত। তার আগেই পানির দাম বাড়াতে মনোযোগ দিয়েছে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ। তিন বছর আগে পানির দাম বাড়ানো হয়েছিল তিন গুণ। এবার ৩০ শতাংশ পানির দাম বাড়াতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছে ওয়াসা।
কাগজপত্রে দেখা গেছে, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাজশাহী ওয়াসা পানির দাম তিন গুণ বাড়িয়ে দেয়। এতে আবাসিক গ্রাহকদের জন্য প্রতি ইউনিট বা এক হাজার লিটার পানির দাম ২ টাকা ২৭ পয়সা থেকে ৬ টাকা ৮১ পয়সা এবং বাণিজ্যিক গ্রাহকদের জন্য প্রতি ইউনিট ৪ টাকা ৫৪ পয়সা থেকে ১৩ টাকা ৬৬ পয়সায় গিয়ে দাঁড়ায়। এবার এই পানির দাম ৩০ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।
গত বছরের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত ওয়াসার ১৬তম বোর্ড সভায় পানির দাম বাড়ানোর এই প্রস্তাব অনুমোদিত হয়। এরপর সম্প্রতি সেটি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে অনুমোদনের জন্য। অনুমোদন পেলে আবাসিক গ্রাহকদের জন্য প্রতি ইউনিট পানির দাম বেড়ে ৮ টাকা ৮৫ পয়সা এবং বাণিজ্যিক গ্রাহকদের জন্য প্রতি ইউনিট ১৭ টাকা ৭০ পয়সায় গিয়ে দাঁড়াবে।
অথচ রাজশাহী ওয়াসার পানির মান পানযোগ্য নয়। ২০১৮ সালে রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) একদল গবেষক ওয়াসার পানি নিয়ে গবেষণা করেন। তারা শহরের ৪০টি পয়েন্টের পানি সংগ্রহের পর পরীক্ষা করেন। এতে দেখা যায়, এই পানি জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। গবেষণায় উঠে আসে, এতে বেশি মাত্রার আয়রনের উপস্থিতি রয়েছে।
পরে ২০২১ সালে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর শহরের ১০৪টি পয়েন্টের পানি পরীক্ষা করে। এই পানিতে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর ‘কলিফর্ম’ ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেই একই পানিই সরবরাহ করা হচ্ছে। আবার পানির দাম বেশি বলেও নাগরিক সমাজে ক্ষোভ আছে। সম্প্রতি এক মানববন্ধনে পানির দাম কমানোর দাবি জানান রাকসুর সাবেক ভিপি রাগিব আহসান মুন্না। রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদও দাম কমানোর দাবি তোলে নানা সময়। এরই মধ্যে ওয়াসার পানির দাম বাড়ানোর প্রস্তাবটি সামনে এসেছে।
ওয়াসার কর্মকর্তারা জানান, রাজশাহী নগরে দৈনিক পানির চাহিদা প্রায় ১৩ কোটি ৫০ লাখ লিটার। তবে ওয়াসা সরবরাহ করতে পারে ১০ দশমিক ৭ কোটি লিটার। ফলে প্রতিদিন ২ দশমিক ৮ কোটি লিটার পানির ঘাটতি দেখা দেয়। বর্তমানে রাজশাহী ওয়াসা ১২৩টি গভীর নলকূপ ব্যবহার করে এবং ৮৫৯ কিলোমিটার পাইপলাইনের নেটওয়ার্কের মাধ্যমে তার ৪৮ হাজার ৫২৭টি পরিবার এবং ৭২১টি বাণিজ্যিক গ্রাহককে পানি সরবরাহ করে। এক ইউনিট বা এক হাজার লিটার পানি সরবরাহ করতে ওয়াসা ৯ টাকা ৩০ পয়সা ব্যয় করে।
ওয়াসার বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ২৩ কোটি ৫২ লাখ টাকার পরিচালন ব্যয়ের বিপরীতে ২৫৫ কোটি ইউনিট পানি বিক্রি করে এবং ১৭ কোটি ৭২ লাখ টাকা পাওয়া যায় এই পানি বিক্রি করে। অর্থাৎ প্রায় ছয় কোটি টাকা লোকসান হয়েছে ওয়াসার। এই লোকসান কমাতেই দফায় দফায় পানির দাম বাড়ানোর পক্ষে রাজশাহী ওয়াসা।
রাজশাহী ওয়াসার উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (অর্থ ও প্রশাসন) নাদিম সারোয়ার বলেন, ‘পানিতে ভর্তুকি কমানোর জন্য সরকারের একটি নির্দেশনা ছিল। এখনো ওয়াসা লোকসানে আছে। দেশের সব মানুষের টাকায় ভর্তুকি দিয়ে ওয়াসাকে চলতে হচ্ছে। কিন্তু আমরা এই জনগণের সবাইকে পরিষেবা দিতে পারি না। সে জন্য গ্রামীণ জনগণের টাকায় শহরের মানুষকে স্বল্প খরচে পানি সরবরাহ করা অনৈতিক। ফলে পানির দাম বাড়াতে হচ্ছে।’
তবে সিদ্ধান্তটি অযৌক্তিক বলছেন নাগরিক সমাজের নেতারা। কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) রাজশাহী জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা মামুন জানান, পানির শুল্ক বাড়ানোর প্রস্তাব অযৌক্তিক। প্রতিদিন প্রায় ৩ কোটি লিটার পানি লিকেজ, অপচয় বা চুরির কারণে নষ্ট হয়, যার ফলে ওয়াসার বার্ষিক ক্ষতি হয় ৯ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। এই অপচয় কমানোর দিকে মনোযোগী হয়ে ওয়াসা লোকসান কমাতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘পানির ক্ষতি কমানো এবং দুর্নীতি ও অনিয়ম নির্মূলে কার্যকর পদক্ষেপ না নিয়ে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ পানির শুল্ক বাড়াচ্ছে, যা কখনোই মেনে নেওয়া যায় না। এর প্রতিবাদ হওয়া উচিত।’
রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জামাত খান বলেন, ‘ওয়াসার পানি এখনো পানযোগ্য নয়। গৃহস্থালির কাজেও ব্যবহার করা যায় না। এমন পানির দাম দফায় দফায় বাড়ানো হতে পারে না। দাম বাড়ানোর চেয়ে পানির মান বাড়ানোর দিকে ওয়াসার আগে মনোযোগ দেওয়া উচিত।’ এতে জনগণের ওপর বাড়তি চাপ পড়বে। তাই মান বাড়াতে বেশি মনোযোগী হতে হবে।
ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী পারভেজ মামুদ বলেন, ‘আমরা পানির মান বাড়াতেও মনোযোগী। সে জন্যই গোদাগাড়ীতে ট্রিটমেন্ট প্লান্ট করা হচ্ছে। পদ্মার পানি সেখানে পরিশোধন করে রাজশাহী শহরে আনা হবে পাইপলাইনে। চীন এই প্রকল্পে অর্থায়ন করছে। গত বছরের জুনে এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। শেষ হবে ২০২৭ সালের জুনে। এ পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি ১৭ শতাংশ। এই কাজটি শেষ হওয়ার পরই সুপেয় পানি পাওয়া যাবে। আমরা সর্বত্র সুপেয় পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছি।
আপনার মতামত লিখুন :