কক্সবাজারের রামুর পেঁচারদ্বীপ (মেরিন ড্রাইভ ও রেজুখাল সংলগ্ন) এলাকায় সরকারি ভূমিতে মারমেইড বিচ রিসোর্ট কর্তৃপক্ষ অবৈধভাবে স্থাপনা নির্মাণকাজ অব্যাহত রেখেছে। ঝাউবিথী কেটে বালুচর দখল, সৈকত দ্বিখণ্ডিত করে নতুন কাঠের সেতু নির্মাণ এবং ফের বালুচরে থার্টিফার্স্ট নাইটের অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে আনিসুল হক চৌধুরী ওরফে এলিয়েন সোহাগ।
সরকারি প্রায় সাড়ে ৬ একর ভূমিতে এ ধরনের অবৈধ দখলদারিত্বের কাজ অব্যাহত রাখলেও জেলা প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তর ও বনবিভাগ রহস্যজনক নীরবতা পালন করছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর ও বনবিভাগ দুটি নামমাত্র মামলা করে অনেকটা নিশ্চুপ রয়েছে। গত ১৫-১৬ বছর ধরে এ ধরনের পরিবেশ ও রাষ্ট্রবিরোধী কাজ অব্যাহত রেখেছে মারমেইড বিচ রিসোর্ট কর্তৃপক্ষ।
কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কে ‘মারমেইড বিচ রিসোর্টে’র বিরুদ্ধে সমুদ্রসৈকত দখলের অভিযোগ নতুন নয়। থার্টিফার্স্ট নাইট পালনে ডিজে ও মদের পার্টির জন্য বিশেষ জোন তৈরি করেছে ঝাউবিথীর বাগানে। সেখানে ঝাউগাছ কাটা হয়েছে তিন শতাধিক। যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘ফুল মুন বিচ পার্টি’। সমুদ্রসৈকত রক্ষায় কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগ কর্তৃক রোপণ করা ঝাউবিথী উপড়ে ফেলা হয়েছে। ফলে পরিবেশের পাশাপাশি ক্ষতির মুখে পড়ছে দেশের একমাত্র ‘মেরিনড্রাইভ সড়ক’।
এ ছাড়াও অভিযোগ উঠেছে স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, আইসিটি মন্ত্রী জুনায়েদ আহমদ পলক, শেখ পরিবারের এক নাতিসহ একাধিক মন্ত্রী-প্রভাবশালী নেতার বলয় দেখিয়ে একের পর এক সৈকতের বালিয়াড়ি দখল করেছেন মারমেইড রিসোর্টটির মালিক আনিসুল হক চৌধুরী সোহাগ। নিজেকে শেখ পরিবারের একজন দাবি করা সোহাগ একের পর এক দখল চালিয়ে গেলেও প্রশাসনের কেউ সেদিকে নজর দেননি অদৃশ্য কারণে।
জানা গেছে, ২০১০ সালের ২২ জুলাই কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের তৎকালীন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. রফিকুল ইসলাম স্মারক নং-৪২৬/২০১০ মূলে পেঁচারদ্বীপ মৌজার বিএস ১নং খাস খতিয়ানের বিএস ১২১৪ দাগের আন্দর ৫.৩০ একর জমিতে অবৈধ দখলদার হিসেবে ‘মারমেইড ক্যাফে’ নামক কটেজ রেস্টুরেন্ট ও আবাসিক নির্মাণ করে ব্যবসা পরিচালনা করায় জমির অবৈধ দখল ছেড়ে দিতে ও অবৈধ স্থাপনা সরানোর জন্য নোটিশ দেন।
এর আগে সহকারী কমিশনার (ভূমি), রামু গত ০১/১২/২০০৯ ও ০৭/১২/২০০৯ তারিখে তাকে দুই দফা নোটিশ দিলে তার কোনো কারণ দর্শানোর জবাব না দিয়ে অবৈধ দখলের মাধ্যমে ব্যবসা চালু রাখে। ওই অবৈধ দখলীয় জমি থেকে উচ্ছেদ করার লক্ষ্যে ওই সময়ে উচ্ছেদ মামলা নং-০২/১০-১১ রুজু করা হয় এবং ওই উচ্ছেদ মামলায় উচ্ছেদ কার্যক্রম চালানোর জন্য ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করা হয়। অবৈধ দখলীয় জমি থেকে অবৈধ স্থাপনা সরানোর নোটিশ দিলেও আওয়ামী লীগ নেতাদের চাপের মুখে উচ্ছেদ করতে পারেনি। এর ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি প্রশাসনের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে বহমান খালের ওপর অবৈধ একটি সেতু নির্মাণ করেছে। যে সেতুর ওপর দিয়ে যেতে হবে ডিজে ও মদের জোনে। পর্যটনের দোহাই দিয়ে পরিবেশবিধ্বংসী কর্মকাণ্ড চললেও সবাই অদৃশ্য কারণে চুপ ছিল।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলে কিছু দিনের জন্য গা ঢাকা দেয় সোহাগ। পরে ওইসব জমি উদ্ধারে উদ্যোগ নেয় জেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসক মো. সালাহ উদ্দিনের নির্দেশে ২১ নভেম্বর দিনব্যাপী অভিযান চালিয়ে প্রায় ৭ একর সরকারি জমি দখলমুক্ত করা হয়।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিনের নির্দেশে রামু উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) সাজ্জাদ জাহিদ রাতুলের নেতৃত্বে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ কার্যক্রম চালানো হয়। সৈকত দ্বিখণ্ডিত করে নির্মিত কাঠের সেতু ভেঙে দেওয়া হয়। অভিযানে বালুচরে গড়ে তোলা অন্তত ৩০টি অবৈধ কটেজ গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়।
সৈকতে ঝাউবিথী কেটে স্থাপনা নির্মাণের ঘটনায় বনবিভাগ বাদী হয়ে মারমেইড বিচ রিসোর্ট কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বন আইনে মামলা দায়ের করেছেন। এ ছাড়া পরিবেশের ক্ষতি করায় পরিবেশ অধিদপ্তরও একটি মামলা দায়ের করেছে।
সরেজমিনে মারমেইড বিচ রিসোর্টে দেখা যায়, উচ্ছেদ অভিযানে ভেঙে দেওয়া কাঠের সেতুর পাশে নতুন করে আরও একটি কাঠের সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। পর্যটক বা স্থানীয়রা নির্মিত সেতু দিয়ে সেখানে প্রবেশ করতে চাইলে বাধা দেওয়া হয়।
নতুনভাবে নির্মিত সেতু পেরিয়ে দেখা গেছে, আবারও শত শত ঝাউবিথী কেটে তৈরি করা হয়েছে নাচ-গানের মঞ্চ, কফি শপ বা মদের বার সাদৃশ্য বিশেষ জোন। সৈকতে ঝাউবিথী কেটে নতুনভাবে অবকাঠামো তৈরি করেছে মারমেইড বিচ রিসোর্ট।
মারমেইড বিচ রিসোর্টের কয়েকজন কর্মচারী জানিয়েছেন, সৈকত দখল করে গড়ে তোলা ঝাউবিথীর ভেতর থার্টিফার্স্ট নাইটের অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে। প্রতিজন ৩৫০০ টাকা হারে টিকিটও বিক্রি করা হচ্ছে। আর প্রতি মাসে একটি বিশেষ ‘ডিজে পার্টি’ হয় সেখানে। সাড়ে তিন হাজার টাকায় জনপ্রতি ফি নেওয়া হয়। টিকিটধারীই শুধু সেখানে যেতে পারে।
‘বিশেষ ডিজে’ পার্টিতে কী কী থাকে বা খাবার কী থাকেÑ জানতে চাইলে কর্মচারীরা বলেন, তেমন কিছু না, শুধু বিদেশি বিয়ার ও মদ থাকে আর নারীদের দিয়ে নাচ-গান।
রামু ভূমি অফিসের এক কর্মকর্তা জানান, মূলত মারমেইড বিচ রিসোর্টটি পড়েছে রামু উপজেলার খুনিয়াপালং ইউনিয়নে। প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে উন্মুক্ত প্রবাহমান খালের ওপর মারমেইড বিচ কর্তৃপক্ষ দুটি সেতু নির্মাণ করে। মারমেইড বিচ কর্তৃপক্ষ প্রভাবশালী হওয়ার কারণে কোনো কিছুই তোয়াক্কা করছে না।
তারা সম্প্রতি রাতের আঁধারে সেতুটি নির্মাণ করে অবৈধভাবে। বিষয়টি প্রশাসনের দৃষ্টিগোচর হয়। এ ব্যাপারে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনকে অভিযোগ আকারে জানালে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এসে বিষয়টি দেখে চলে যায়। শুনেছি প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই মারমেইড বিচ কর্তৃপক্ষ সেতুটি খালের ওপর দৃশ্যমান রেখেছে এবং সরকারি প্রায় সাড়ে ৬ একর জমি দখল করেছে।
জেলা প্রশাসক বরাবর দাখিলকৃত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, মারমেইড বিচ রিসোর্টের বিশাল এলাকার অধিকাংশই খাসজমি ও সৈকতের বেলাভূমি। অল্পসংখ্যক জমি কিনে পাশের খাসজমি ও সৈকতের বালিয়াড়ির জমির মধ্যেই গড়ে উঠেছে মারমেইড বিচ রিসোর্ট। তিনটি দাগের ৬ একর ৭০ শতক সরকারি জমি দখল, চরভরাট ও শ্রেণি পরিবর্তন করে ৭৮ লাখ ২৫ হাজার টাকার ক্ষতি করা হয়েছে।
একাধিক সূত্র জানিয়েছে, শেখ পরিবার ও তাদের মন্ত্রীদের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে এবং কমিশন দিয়ে সমুদ্রসৈকতের বিশাল এলাকা দখলে রেখে গলাকাটা বাণিজ্য চালিয়ে আসছিল মারমেইড বিচ কর্তৃপক্ষ। সরকার পতন হলেও মারমেইড সোহাগের দখলবাজি থেমে নেই।
তথ্যমতে, বালিয়াড়ি, পাথরময় জোয়ার-ভাটা অঞ্চল, উপকূলীয় জলাভূমি ও কোরালসহ সামুদ্রিক দ্বীপ রক্ষায় কক্সবাজারের সৈকত এলাকাকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) হিসেবে ঘোষণা করে ১৯৯৯ সালের ১৯ এপ্রিল এ-সংক্রান্ত গেজেটও প্রকাশ করে সরকার।
এ নির্দেশনা মতে, ১২০ কিলোমিটার সমুদ্রসৈকত, সৈকতের ঝাউ গাছসমৃদ্ধ ৩০০ মিটারে যেকোনো স্থাপনা নির্মাণ ও উন্নয়ন নিষিদ্ধ ও ৫০০ মিটার সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করা হয়। কিন্তু সম্প্রতি মারমেইড বিচ রিসোর্ট কর্তৃপক্ষ সেই আদেশ অমান্য করে সবকিছুই তৈরি করেছেন।
এ ছাড়া, ২০১৭ সালে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) করা এক রিটের বিপরীতে ‘ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান ফর কক্সবাজার টাউন অ্যান্ড সি আপ টু টেকনাফ’ মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী জোয়ার-ভাটার মধ্যবর্তী লাইন থেকে প্রথম ৩০০ মিটার ‘নো ডেভেলপমেন্ট জোন’ উল্লেখ করে এ এলাকায় কোনো স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না বলে নির্দেশনা দেন উচ্চ আদালত। এর সঙ্গে যুক্ত হয় কউকের মাস্টারপ্ল্যান। এ প্ল্যান বাস্তবায়নে কউক সমুদ্রসৈকতের ৩০০ মিটারে কোনো স্থাপনা নির্মাণ থেকে বিরত থাকতে প্রচার চালানো হয়। রহস্যজনক কারণে উচ্চ আদালতের আদেশ বাস্তবায়ন না হওয়া দুঃখজনক বলে মনে করেন পরিবেশবাদীরা।
যদি দ্রুত সময়ের মধ্যে ইসিএ এলাকায় সব ধরনের অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ করা না হয় পরিবেশগত বড় হুমকিতে পড়বে পর্যটন নগরী কক্সবাজার। তাই এখনই সময় দখলদাররা যতই প্রভাবশালী হোক তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।
কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের আওতাধীন হিমছড়ি টহল ফাঁড়ির ওসি মো. কামরুজ্জামান সুভন বলেন, ‘রাতের আঁধারে যারা ঝাউবিথী কেটেছে তাদের বিরুদ্ধে আমরা মামলা দায়ের করেছি। আবারও ঝাউগাছ কাটার অভিযোগ পেয়েছি। মারমেইড কর্তৃপক্ষ সেখানে অবকাঠামো তৈরি করেছে, সে বিষয়ে উপজেলা প্রশাসন দেখবেন। এটি আমাদের দায়িত্ব না। গাছ কাটার ঘটনায় আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
মারমেইড বিচ রিসোর্টের মালিক আনিসুল হক চৌধুরী সোহাগের মুঠোফোনে একাধিকবার চেষ্টা করলেও তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। ক্ষুদেবার্তা পাঠালেও তার জবাব দেননি তিনি। এদিকে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে বক্তব্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন মারমেইড বিচ রিসোর্টের ইয়াছিন আরাফাত।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ সালাউদ্দিন বলেন, সরকারি জমি হোক আর ব্যক্তিগত জমি হোক, যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোনো অবকাঠামো নির্মাণের সুযোগ নেই। খাস বা সৈকতের বালিয়াড়ির জমিতে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখা হবে। একবার উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়েছে। আবার দখল করলে আবারও চলবে অভিযান।
আপনার মতামত লিখুন :