*পুলিশে নিয়োগ, পদোন্নতি-বদলি বাণিজ্যে , *মাদকসক্তের প্রমাণ গোয়েন্দা রিপোর্টে , *জ্যোতির অপকর্মের শেষ নেই , *জ্যোতি ৪ দিনের রিমান্ডে, *অবৈধ সম্পদ বিদেশে পাচার
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরাচারী সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দোসর ‘গ্যাং অব ফোর’ এর অন্যতম সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের ছেলে সাফি মুদ্দাসির খান জ্যোতিকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা জেলা পুলিশ। তাকে নেওয়া হয়েছে চার দিনের রিমান্ডে। বাবার ক্ষমতায় ক্ষমতাবান জ্যোতি হাজার কোটি টাকার মালিক বনে যান। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ছেলে হওয়ায় বাবার ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে অর্জিত বিপুল অবৈধ সম্পদ বিদেশে পাচার করেছে বলে একাধিক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। গত সাড়ে ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকার আমলে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ সিন্ডিকেট করে পুলিশসহ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিভাগে নিয়োগ-বদলি, পদোন্নতি এবং কেনাকাটা বাণিজ্যর ওপেন সিক্রেট। মাদকসক্ততার প্রমাণও মিলেছে গোয়েন্দা রিপোর্টে।
শেখ হাসিনার পতনের পর তার সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী ও এমপিদের একের পর এক দুর্নীতি সামনে আসছে। আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের ছেলে বাবার ক্ষমতার অপব্যবহার করে শত শত কোটি টাকা লুটপাট করেছেন। শুধু এসবই না, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জ্যোতির দুর্নীতির ফিরিস্তি এবং অপকর্ম যেন শেষ হবার নয়। রাজধানী ঢাকা একচ্ছত্র আদিপত্য বিস্তার ছিল তার হাতে। বাবার ক্ষমতার কারণে প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাকে সমীহ করে চলত। নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় জ্যোতির অপরাধ কর্মকাণ্ডের সহযোগী হয়ে যেত। জ্যোতি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তারের আতংকে রয়েছে অসাধু সেসব উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
বাবা ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থেকে সাফি মুদ্দাসির খান জ্যোতি পরিবার ও বন্ধুদের নিয়ে গড়ে তোলেন আলাদা সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেট ঢাকাসহ সারা দেশে তাদের প্রভাব বিস্তার করত। প্রতিদিন আসর বসিয়ে কোটি কোটি টাকা আদায় করা হতো। আসরে মাদক সেবন করা হতো বলে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে জানা গেছে। আসরে মাদক আসত খোদ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর এবং পুলিশের কাছ থেকে। নিত্যনৈমিত্তিক এসব মাদকের আসরে হাজিরা দিত পুলিশসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। যার মধ্যে অন্যতম সাভারের আশুলিয়ায় ভ্যানে নিথর দেহের স্তূপ ও পুলিশের পিকআপে ভ্যানে তুলে পোড়ানোর মাস্টারমাইন্ড গ্রেপ্তার হয়ে রিমান্ডে থাকা পুশিল সুপার আব্দুল্লাহিল কাফী। জ্যোতি মাদকাসক্ত ছিল এমন তথ্য পাওয়া গেছে একাধিক গোয়েন্দা প্রতিবেদন থেকে। তাকে একাধিকবার মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসা নিতে হয়েছে বলে একাদিক সূত্র রূপালী বাংলাদেশকে নিশ্চিত করেছে। বাবার ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে অপরাধ সামাজ্য গড়ে তোলা জ্যোতি ছিলেন বেপড়োয়া।
গতকাল শনিবার রাজধানীর আশুলিয়া থানার হত্যাচেষ্টা মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের ছেলে শাফি মোদ্দাসের খান জ্যোতির ৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। এদিন বিকেল ৩টায় তাকে আদালতে হাজির করে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আশুলিয়া থানার উপ-পরিদর্শক আবু তাহের মিয়া সাত দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেন। শুনানি শেষে ঢাকার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সাইফুল ইসলামের আদালত ৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে আদেশ দেন। এর আগে শুক্রবার রাত ৩টার দিকে রাজধানী থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। হাসিনা সরকার পতনের পর থেকে খোঁজ মেলেনি আওয়ামী সরকারের প্রভাবশালী সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের। পুলিশ ও গোয়েন্দারা তার অবস্থান জানার চেষ্টা করছে বলে জানা গেছে।
জানা যায়, গত ১১ সেপ্টেম্বর হত্যাচেষ্টার অভিযোগে ভুক্তভোগী মো. রবিউল সানি বাদী হয়ে আশুলিয়া থানায় মামলা করেন। মামলায় শেখ হাসিনাসহ ৩০ জনকে আসামি করা হয়। এ মামলার ৪ নং এজাহারনামীয় আসামি হলেন শাফি। মামলার উল্লেখযোগ্য অপর আসামিরা হলেন- সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, ইউজিসির সাবেক সচিব ড. ফেরদৌস জামান, ইউজিসির সাবেক সদস্য ড. মুহাম্মদ আলমগীর, ড. বিশ্বজিৎ চন্দ্র চন্দ ও ড. মো. সাজ্জাদ হোসেন।
সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ছেলে জ্যোতি বাবার সিন্ডিকেটের বাইরে নিজস্ব আলাদা একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছিলেন। তার বিরুদ্ধে পুলিশ, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও ফায়ার সার্ভিস থেকে বাবার মতো করেই বস্তায় ভের কোটি কোটি টাকা আদায় করা অভিযোগ রয়েছে। যার মাধ্যমে বাবার মতো হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন জ্যোতি। ঝুঁকি এড়াতে টাকাগুলো পাঠানো হয়েছে দেশের বাইরে।
অভিযোগ রয়েছে, জেলায় পুলিশ সুপার নিয়োগে সর্বনিম্ন ৮০ লাখ থেকে ২ কোটি টাকা পর্যন্ত নিত জ্যোতি চক্র। এই সিন্ডিকেটের আশীর্বাদ ছাড়া পুলিশের কেউ কোনো জেলায় বা গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন পেতেন না। জেলা পুলিশ সুপার হিসেবে পদায়নের ক্ষেত্রে ১ থেকে ৩ কোটি টাকা নিত জ্যোতি সিন্ডিকেট। মূলত প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কোটা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কোটা, আইজিপির কোটা ছাড়াও জ্যোতি আলাদা কোটা বরাদ্দ রাখা হতো। সেই কোটার মাধ্যমে সিন্ডিকেট সদস্যদের কাজে লাগিয়ে ঘুষের অর্থ লেনদেন হতো।
জানা যায়, সাফি মুদ্দাসির জ্যোতির মেসার্স তিতাস বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নামে একটি কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বানিয়ে রাখেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এই প্রতিষ্ঠানের নামেই চলত বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতি। টেকনাফের মিঠাপানির ছড়া ১নং প্লটে ৫ দশমিক ৫০৬৪ একর জমি কেনা হয়। তা ছাড়া লেঙ্গুরবিল মৌজায় একই কোম্পানির নামে লম্বরি ২নং পর্টে কোম্পানির নামে কেনা জমির মূল্য প্রায় সাড়ে ৫ কোটি টাকা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, দুর্নীতিগ্রস্ত আসাদুজ্জামান খান কামাল ও তার ছেলে সাফি মুদ্দাসিরের লুটপাট হাসিনা সরকারের আমলে চরম পর্যায়ে পৌঁছায়। যার বড় উদাহরণ নির্বাচন কমিশনের অমুছনীয় কালি কেনার দুর্নীতির সঙ্গে তার নাম থাকায়। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শুধু অমুছনীয় কালি কিনতেই ১ কোটি ২৪ লাখ টাকা ব্যয় করে সাফি মুদ্দাসির সিন্ডিকেট। এছাড়া আরও ৬ কোটি টাকার অমুছনীয় কালি কেনে নির্বাচন কমিশন। যার টেন্ডার বাগিয়ে নেয় সাফি ও নির্বাচন কমিশনের সচিব জাহাঙ্গীর আলমের আত্মীয়ের যৌথ সিন্ডিকেট।
জানা যায়, রাজধানীর পুরো ধানমন্ডি এলাকায় ছিল তার একচ্ছত্র আধিপত্য। ধানমন্ডি এলাকা বিভিন্ন রেস্টুরেন্টের জন্য বিখ্যাত। আর এসব রেস্টুরেন্ট দেওয়ার জন্য জ্যোতিকে দিতে হতো ১ থেকে ২ কোটি টাকা। টাকা দিলে কোনোরকম যাচাই-বাছাই ছাড়াই মিলত লাইসেন্স। আর লাইসেন্স করতে বাবার প্রভাব খাটাতেন তিনি। শুধু তাই নয়, এসব রেস্টুরেন্ট থেকে যেসব চাঁদা নেওয়া হতো তাও একহাতে সামলাতেন জ্যোতি।
সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নামে শুধু রাজধানীর কারওয়ান বাজার থেকেই প্রতিদিন দেড় কোটি টাকার চাঁদা তোলা হতো। ফুটপাতে ব্যবসা, বাজার, মাদক ব্যবসায়ী ও আবাসিক হোটেল থেকে উঠানো হতো এসব চাঁদা। এ টাকা মন্ত্রীর হাতে পৌঁছে দেওয়ার জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল মন্ত্রীর এপিএস মনির হোসেনসহ আরও দুজনকে। এই টাকার মোটা অংশ পেতেন আসাদুজ্জামান খান কামাল। পাশাপাশি এই টাকার একটা ভাগ পেতেন তার ছেলে জ্যোতি। এ ছাড়াও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে যেসব নিয়োগ বাণিজ্য, টেন্ডার বাণিজ্য হতো তার মোটা অংকের ভাগ পেতেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। আর এসব একহাতে নিয়ন্ত্রণ করতেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এপিএস মনির। তিনি একটা অংশ সাবেক মন্ত্রী ছেলে জ্যোতিকেও দিতেন।
এদিকে, আওয়ামী সরকারের প্রভাবশালী সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল ও তার পরিবারের নামে হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। পাশাপাশি সংস্থাটির অনুসন্ধানে আরও ২০০ কোটি টাকার বেশি মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত অপরাধের প্রমাণ পেয়েছে সংস্থাটির অনুসন্ধান টিম। সব মিলিয়ে আপাতত ৩০০ কোটি টাকার বেশি দুর্নীতির প্রমাণ মিলেছে। আর ওই দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে আসাদুজ্জামান কামাল, তার স্ত্রী লুৎফুল তাহমিনা খান, তার ছেলে শাফি মোদ্দাসির খান জ্যোতি, মেয়ে সোফিয়া তাসনিম খান ও সহকারী একান্ত সচিব মনির হোসেনকে আসামি করে মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানা গেছে। চলতি সপ্তাহের যে কোনো দিনই কমিশনের অনুমোদনক্রমে মামলা করার সম্ভাবনা রয়েছে।
ক্ষমতার অপব্যবহার করে দুর্নীতির মাধ্যমে বিগত আওয়ামী সরকারের প্রভাবশালী সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এবং তার ছেলে সাফি মুদ্দাসির খান জ্যোতিসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। দেশ থেকে পাচার করেছেন হাজার কোটি টাকা। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রাথমিক অনুসন্ধানে একে একে সেসব দুর্নীতির তথ্য বেরিয়ে এসেছে। দুদকের অনুসন্ধানে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামালের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অকাট্য প্রমাণ মিলেছে। নিজ ও পরিবারের সদস্যদের নামে নামে-বেনামে ১০০ কোটি টাকার বেশি স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের প্রমাণ পাওয়া গেছে। যার মধ্যে ব্যাংকের নগদ অর্থ, ঢাকা ফ্ল্যাট ও জমি রয়েছে। অনুসন্ধানে তাদের ব্যাংক হিসাবেই শতকোটি টাকার বেশি অর্থের সন্ধান মিলেছে। এছাড়া তার এপিএস মনিরের বিরুদ্ধে প্রায় ২০ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের প্রমাণ মিলেছে। দুদক টিম ওই পাঁচ জনের বিরুদ্ধে অন্তত ২০০ কোটি টাকার মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত অপরাধের প্রমাণ পেয়েছে। আপাতত এসব কারণেই মামলা সুপারিশ করা হয়েছে। তবে দুদকের তদন্ত কর্মকর্তাদের বিশ্বাস তদন্তে তাদের এর চেয়ে বহুগুণ সম্পদ ও মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত অপরাধের তথ্য পাওয়া যাবে। এ ছাড়া সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামালের অন্যান্য ৫ সহযোগীর বিরুদ্ধেও দুর্নীতির প্রাথমিক প্রমাণ মিলেছে।
এর আগে গত ১ সেপ্টেম্বর সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, তার স্ত্রী লুৎফুল তাহমিনা খান, সাফি মুদ্দাসির খান জ্যোতি ও মেয়ে সাফিয়া তাসনিম খানসহ ১০ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত। দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা মেট্রোপলিটন সিনিয়র স্পেশাল জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেনের আদালত এ আদেশ দেন। দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া অন্যরা হলেনÑ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ধনঞ্জয় কুমার দাস, সাবেক ডিআইজি মোল্যা নজরুল ইসলাম, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব মো. হারন অর রশীদ বিশ্বাস, জনসংযোগ কর্মকর্তা শরীফ মাহমুদ অপু, প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোল্লা ইব্রাহিম হোসেন।
আপনার মতামত লিখুন :