ঢাকা শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪

গ্রেপ্তার হয়নি শেখ হাসিনার স্বজনরা

মোস্তাফিজুর রহমান সুমন

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২১, ২০২৪, ০৯:১৯ পিএম

গ্রেপ্তার হয়নি শেখ হাসিনার স্বজনরা

ছবি সংগূহীত

ঢাকা: সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর তার আত্মীয়স্বজনের বিরুদ্ধে সারাদেশে ডজন-ডজন মামলা হলেও এখন পর্যন্ত কেউ গ্রেপ্তার হননি। হাসিনার দেশ ত্যাগের সঙ্গে সঙ্গে গত দেড় দশকের ক্ষমতাশালী আত্মীয়স্বজনরাও যেন হারিয়ে গেছেন। গুঞ্জন রয়েছে, বেশির ভাগ স্বজন হাসিনার আগেই দেশ ছেড়েছেন। আবার অনেকে দেশেই গা-ঢাকা দিয়েছেন। এদিকে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় হওয়া হাসিনার স্বজনদের মামলার তদন্তে অগ্রগতি নেই বললেই চলে।

কোটা সংস্কার থেকে হাসিনার পদত্যাগের এক দফা দাবির পরিপ্রেক্ষিতে রাজপথে নেমে আসা ছাত্র-জনতার ওপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য এবং তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ও দলের নেতাকর্মীদের গুলিতে শত শত মানুষের প্রাণহানি হয়। আহত হয় ২০ হাজারের বেশি মানুষ। প্রায় ১ হাজার মানুষ চিরতরে পঙ্গু হয়ে যায়। চোখ হারায় হাজারখানেক মানুষ। হাসিনার দোসররা বল প্রয়োগ করে ছাত্র-জনতাকে দমিয়ে রেখে আন্দোলন রুখে দিতে চেয়েছিল। স্বৈরাচারী হাসিনার মতো তার আত্মীয়স্বজনরাও দেশব্যাপী হত্যাযজ্ঞের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিল।

শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর থেকেই দলের মন্ত্রী-এমপি ও বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা কেউ দেশ ছেড়েছেন, কেউ আছেন আত্মগোপনে। ইতোমধ্যে (গতকাল শনিবার পর্যন্ত) গ্রেপ্তার হয়েছেন হাসিনার সহচর ৩৩ জন মন্ত্রী, উপমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও এমপি। এ ছাড়া বিভিন্ন পর্যায়ের গ্রেপ্তারকৃত নেতাকর্মীদের সংখ্যা ১০০ পার হয়েছে বলে পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে। তবে শেখ হাসিনার আত্মীয়স্বজনদের এখনো গ্রেপ্তার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। যদিও হাসিনা-রেহানা এবং তাদের সন্তানেরা ৫ আগস্টের আগে থেকেই দেশের বাইরে অবস্থান করছেন।

জানা গেছে, রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শেখ হাসিনার আত্মীয়স্বজনদের বেশির ভাগ সদস্যই এখন আর দেশে নেই। ৫ আগস্টের আগে-পরে তারা দেশ ছেড়ে গেছেন। গত ৫ আগস্ট সামরিক বিমানে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা ও তার ছোট বোন শেখ রেহানা। ওই দিন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ছাড়া তাদের আত্মীয়স্বজনদের আর কোনো সদস্য দেশে ছিলেন না। শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। তার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক পরিচালক হিসেবে দিল্লিতে কর্মরত। সরকারের পতনের সময় তিনি দিল্লিতেই ছিলেন। দিল্লিতে যাওয়ার পর তার মা এবং খালার সঙ্গে সায়মার সাক্ষাৎ হয়। শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক ব্রিটিশ মন্ত্রী, তিনি লন্ডনে বসবাস করা। শেখ রেহানার ছেলে রেদওয়ান সিদ্দিক সরকার পতনের সময় দেশে ছিলেন না। ছোট মেয়ে আজমিনা সিদ্দিক রূপন্তীও যুক্তরাজ্যে থাকেন।

গত ৩ আগস্ট ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনার আত্মীয় সদস্য ঢাকা দক্ষিণ সিটি মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। শেখ ফজলে নূর তাপসের বড় ভাই শেখ ফজলে শামস পরশ আওয়ামী যুবলীগের চেয়ারম্যান। তিনি দেশে আছেন নাকি বিদেশে এ নিয়ে সংগঠনের কারও কাছে তথ্য নেই। যুবলীগের একজন নেতা জানিয়েছেন, ফজলে শামস পরশ আন্দোলন চলাকালে কোনো একসময় তিনি বিদেশে গেছেন।

এদিকে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম দেশ ছাড়তে পারেনি বলে জানা গেছে। শেখ সেলিমের সন্তানেরাও দেশে লুকিয়ে রয়েছেন। বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্য হিসেবে বরিশালে প্রভাবশালী নেতা আবদুল হাসানাত আব্দুল্লাহ ছোট ছেলেকে নিয়ে ভারতে চলে গেছেন। তার আরেক ছেলে বরিশাল সিটির সাবেক মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ এবং আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর ছোট ভাই সিটির বর্তমান মেয়র সেরনিয়াবাত আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ দেশেই আত্মগোপনে আছেন।

বঙ্গবন্ধুর একমাত্র ভাই শেখ আবু নাসেরের ছেলে ও শেখ হাসিনার চাচাতো ভাই বাগেরহাট-১ আসনের সাবেক এমপি শেখ হেলাল সরকার পতনের আগেই দেশ ছেড়ে গেছেন। তবে তার ছেলে বাগেরহাট-২ আসনের সাবেক এমপি শেখ সারহান নাসের তন্ময় দেশ ছাড়তে পারেননি। তিনি দেশেই আত্মগোপনে আছেন। শেখ হেলালের ভাই খুলনা-২ আসনের সাবেক এমপি শেখ সালাউদ্দীন জুয়েলকে সরকার পতনের পর টুঙ্গিপাড়ায় আছেন বলে জানা গেছে।

শেখ হাসিনার ভাতিজা মাদারীপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী লিটন এবং তার ভাই ফরিদপুর-৪ আসনে সাবেক সংসদ সদস্য মুজিবুর রহমান চৌধুরী ওরফে নিক্সন চৌধুরী দেশেই আত্মগোপনে রয়েছেন। রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী এসব মন্ত্রী-এমপি ছাড়াও তাদের সন্তানেরাও আত্মগোপনে রয়েছেন। ৫ আগস্টের পর তাদের প্রকাশ্য দেখা যায়নি।

জানা গেছে, শেখ পরিবাররে সদস্যদের মধ্যে যারা দেশে আত্মগোপনে তাদের অনেকেই গোপালঞ্জ জেলায় আবার অনেকেই রাজধানী ঢাকায় অবস্থান করছেন। তাদের আত্মগোপনে থাকতে গোয়েন্দা সংস্থা বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন সদস্যদের শেল্টারে রয়েছেন। গুঞ্জন রয়েছে অনেকে ক্যান্টনমেন্টে আশ্রিত অবস্থায় আছেন। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর ৫০০ অধিক রাজনীতিবিদসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ প্রাণহানির ভয়ে সেনাবাহিনীর আশ্রয় পান। সেনাপ্রধান আশ্রয় নেওয়াদের সংখ্যা বললেও তাদের নাম প্রকাশ করেনি।

শেখ হাসিনার দেড় দশকের ক্ষমতার আমলে তার পরিবার এবং আত্মীয়স্বজনরা হাজার হাজার কোটি টাকা দুর্নীতি করেছেন, অবৈধভাবে অর্জিত সম্পদ বিদেশে পাচার করেছেন। দেশের প্রধানমন্ত্রী পদে শেখ হাসিনা আর এটিকে ব্যবহার করে তারই আত্মীয়স্বজনরা মন্ত্রী-এমপি হয়েছেন। ঘুষ, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, টেন্ডারবাজি, নিয়োগ-বদলি বানিজ্য করে মালিক হয়েছেন অবৈধ সম্পদের। দেশের বিভিন্ন স্থানে হাসিনার আত্মীয়স্বজনদের বিরুদ্ধে জোরপূর্বক জমি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দখলের অভিযোগ পুরোনো। ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে দিনের পর দিন অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়লেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা হয়নি। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ মদদে দেশজুড়ে তারা রামরাজত্ব কায়েম করেছিল।

শেখ হাসিনার আত্মীয়স্বজনদের দৃশ্যমান কোনো রোজগার না থাকলেও তাদের চলনে-বলনে এবং জীবনযাপন ছিল রাজা-বাদশাদের মতো। রাজপ্রাসাদে বসবাসের পাশাপাশি হাজার হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ গড়ে তুলে প্রত্যেকে আলাদা আলাদা সাম্রাজ্যের মালিক বনে যান। স্বৈরাচার হাসিনার আত্মীয়স্বজনদের ত্রাসে সাম্রাজ্যের রোশানলের শিকার হয়েছেন অসংখ্য মানুষ। ব্যবসায়ীরা তাদের মোটা অঙ্কের চাঁদা দিতে বাধ্য হতো। তাদের সরকারি উন্নয়ন কাজে কমিশন বাণিজ্য, নিয়োগ-বদলি বাণিজ্য ওপেস সিক্রেট। হাসিনার আত্মীয়স্বজনদের দরবারে ডাক পড়লে হাজির হতে হতো। চাহিদামতো কাজ করা বা মোটা অঙ্কের অর্থ দেয়াটা ছিল শিরোধার্য।

ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দুই কন্যা দেশ থেকে পালিয়ে যান। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে ভারতে পালান। বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা বর্তমানে সেখানে দিল্লির আতিথিয়তায় রয়েছেন। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ছিলেন হাসিনা সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টার দায়িত্বে। আর মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল অটিজমবিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। জাতিসংঘের একটি পদে থেকে ভারতে অবস্থান করছেন।

বঙ্গবন্ধুর ছোট কন্যা শেখ রেহানা যুক্তরাজ্যের নাগরিক, বর্তমানে বড় বোনের সঙ্গে ভারতে অবস্থান করছেন। শেখ হাসিনা সরকারের আমলে প্রায় সময়ই তিনি দেশে অবস্থান করতেন। তার বড় মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচনে লন্ডনের একটি আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। ছোট মেয়ে আজমিনা সিদ্দিক রূপন্তীও যুক্তরাজ্যে থাকেন। আর শেখ রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক আওয়ামী লীগের সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের (সিআরআই) দায়িত্বে রয়েছেন। জানা গেছে, এখন তিনি ফিনল্যান্ডে অবস্থান করছেন।

আরবি/এস

Link copied!