ঢাকা মঙ্গলবার, ০১ অক্টোবর, ২০২৪

মূর্তিমান আতঙ্ক ওসি ফরমান আলী

মোস্তাফিজুর রহমান সুমন

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৩০, ২০২৪, ০৩:০৩ পিএম

মূর্তিমান আতঙ্ক ওসি ফরমান আলী

ছবি সংগৃহীত

ঢাকা: আওয়ামী লীগের দেড় দশকের দুঃশাসনে রাজধানীতে মূর্তিমান আতঙ্ক ছিল ওসি বিএম ফরমান আলী। গোপালগঞ্জের পুলিশ হিসেবে পরিচিত পাওয়া এই ওসির কুকীর্তির শেষ নেই। সরকারি চাকরিতে পাওয়া বেতন আর তার সম্পদের মধ্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক। অদৃশ্য কারণে এত দিন দুদকসহ বিভিন্ন সংস্থা তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি।

অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে ফরমান আলীকে ওসির দায়িত্ব থেকে সরিয়ে নিলেও তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত শত অভিযোগের তদন্ত এখনো শুরু করেনি কোনো সংস্থা। জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের সময় ফরমান আলী ছিলেন উত্তরা পশ্চিম থানার ওসি। সহিংসতায় সবচেয়ে বেশি প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে উত্তরায়। বর্তমানে তিনি খাগড়াছড়ি জেলায় পুলিশ ট্রেনিং সেন্টারে কর্মরত।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে (ডিএমপি) দীর্ঘদিন ধরে একাধিক থানার ওসির দায়িত্ব পালন করা গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার পুলিশ এবং দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পরিবারের ঘনিষ্ঠজন বিএম ফরমান আলীর বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই। নিরাপরাধ লোকজনকে ধরে টাকার জন্য হয়রানি, ভুক্তভোগীদের অভিযোগ আমলে না নিয়ে আসামিদের পক্ষ নেওয়ার অভিযোগ তার বিরুদ্ধে বেশুমার। সাধারণ মানুষের সঙ্গে খারাপ আচরণ করাও তার কাছে স্বাভাবিক ঘটনা।

পুলিশের একজন পরিদর্শক হয়ে লাখ লাখ টাকা খরচ করে ঢাকার একটি অভিজাত ক্লাবের ডোনার সদস্য হওয়ার ঘটনাতেও বিস্মিত করেছিল খোদ পুলিশের সদস্যদের। চাঁদাবাজি দুর্নীতি অপকর্মের পাহাড় গড়েও এখনো বহাল তবিয়তে বিতর্কিত ওসি ফরমান আলী।

ওসি ফরমান সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আসেন ২০১৭ সালে ২৮ মার্চ রাজধানীর বনানীর রেইনট্রি হোটেলে আয়োজিত জন্মদিনের পার্টিতে দুজন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীকে আমন্ত্রণ করে সেখানে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করা হয়। এই অভিযোগ আনা হয়েছিল মামলায়। ধর্ষণের ঘটনায় প্রভাবশালী ধর্ষকদের পক্ষ নেওয়ার পর থেকে। ঘটনার শিকার দুই ছাত্রীকে আইনি সহায়তা না দিয়ে উল্টো গালাগাল করে থানা থেকে বের করে দেন সে সময়। ‘গুণধর’ এই ওসিকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে পুলিশ বিভাগেও চলে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা। এরপরও সেই থেকে ডিএমপির গুরুত্বপূর্ণ থানাগুলোতে ওসি হন। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার শেষ সময় পর্যন্ত ছাত্র-জনতার আন্দোলন রুখে দিতে দমন-পীড়ন চালান, করেন গুলি। বর্তমানে থানার ওসির দায়িত্ব থেকে তাকে সরিয়ে নিলেও অদৃশ্য ক্ষমতায় তিনি বহাল তবিয়তে রয়েছে পুলিশ বিভাগে।

পুলিশের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, ওসি ফরমান আলী পুলিশ বিভাগে খুবই প্রভাবশালী। তার নানা কুকীর্তি ও অপকর্মের বিষয়ে পুলিশের ঊর্ধ্বতন মহল শুরু থেকেই অবগত। তবে মাথার ওপর প্রভাবশালী ব্যক্তিদের আশীর্বাদ থাকায় কখনোই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। এমনকি পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও তাকে ‘সমীহ’ করে চলেন বলে কথা চালু রয়েছে। স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কারণে গণভবনে অবাধ যাতায়াতের কথা সবাই জানতেন। প্রধানমন্ত্রী সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের কারণেই ফরমান খোদ বিভাগে ছিল মূর্তিমান আতঙ্ক। ডিআইজি পদমর্যাদার কর্মকর্তারাও তার মাধ্যমে অর্থের বিনিময়ে লোভনীয় পদ বাগিয়ে নিতেন।

ওসি ফরমানের সঙ্গে কাজ করা একাধিক পুলিশ সদস্য জানিয়েছেন, তিনি ঘুষ, মাদক, চোরাকারবারি, চাঁদাবাজি, অপহরণ, নির্যাতন, মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো, অবৈধভাবে আটক করে টাকা আদায়সহ নানা ধরনের অপকর্মে যুক্ত ছিলেন। সিনিয়র কর্মকর্তাদের নির্দেশ মানতে না ফরমান আলী। টুঙ্গিপাড়ায় বাড়ি এবং শেখ হাসিনার পরিবারের ঘনিষ্ঠ এই পরিচয়ে দাপিয়ে বেড়াতেন পুলিশ বিভাগে। তার ভয়ে মুখ খুলতে সাহস পেতেন না কোনো সিনিয়র-জুনিয়র কোনো পুলিশ সদস্য।

পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানান, শুধু গোপালগঞ্জ বাড়ি এই যোগ্যতায় মতিঝিল, বনানী, বিমানবন্দর, যাত্রাবাড়ী, উত্তরা পশ্চিম থানাতে ওসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। যদিও দুর্নীতি এবং জনগণকে হয়রানি করে টাকা কামানো ছাড়া আর কোনো যোগ্যতা তার নাই। দুর্নীতির মাধ্যমে কামিয়েছে শতকোটি টাকা টুঙ্গিপাড়া এবং ঢাকায় গড়ে তুলেছেন শত কোটি টাকার খামারবাড়ি, ফ্ল্যাটসহ এবং অন্যান্য সম্পদ। দুদকের মাধ্যমে তার ঘুষ চাঁদাবাজি দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত সম্পদের অনুসন্ধানের দাবি সহকর্মীদের। যাত্রাবাড়ীতে থাকা অবস্থায় টাকার জন্য লোক মেরে ফেলাতে তার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়। তারপরও তার গডফাদার ডিএমপি কমিশনার হাবিব তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নিয়ে তাকে উত্তরা পশ্চিম থানায় পোস্টিং দেয়। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় ওসি ফরমান উত্তরা আব্দুল্লাহপুর, হাউস বিল্ডিং এবং আজমপুর এলাকায় নির্বিচারে গুলি করে নিরীহ ছাত্র-জনতাকে খুন করে। তার বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে আইনের আওতায় এনে বিচারের দাবি জানিয়েছেন তারা।

আরবি/এস

Link copied!