ঢাকা মঙ্গলবার, ০১ অক্টোবর, ২০২৪
ওসি ফরমান

চাঁদাবাজি-দুর্নীতি-অপকর্মে সম্পদের পাহাড়

মোস্তাফিজুর রহমান সুমন

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৩০, ২০২৪, ০৩:২২ পিএম

চাঁদাবাজি-দুর্নীতি-অপকর্মে সম্পদের পাহাড়

ছবি সংগৃহীত

ঢাকা: আওয়ামী লীগের দেড় দশকের দুঃশাসনে রাজধানীতে মূর্তিমান আতঙ্ক ছিল ওসি বিএম ফরমান আলী। গোপালগঞ্জের পুলিশ হিসেবে পরিচিত পাওয়া এই ওসির কুকীর্তির শেষ নেই। চাঁদাবাজি-দুর্নীতি-অপকর্ম করে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। সরকারি চাকরিতে পাওয়া বেতন আর তার সম্পদের মধ্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক। অদৃশ্য কারণে এত দিন দুদকসহ বিভিন্ন সংস্থা তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি।

অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে ফরমান আলীকে ওসির দায়িত্ব থেকে সরিয়ে নিলেও তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত শত অভিযোগের তদন্ত এখনো শুরু করেনি কোনো সংস্থা। জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের সময় ফরমান আলী ছিলেন উত্তরা পশ্চিম থানার ওসি। সহিংসতায় সবচেয়ে বেশি প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে উত্তরায়। বর্তমানে তিনি খাগড়াছড়ি জেলায় পুলিশ ট্রেনিং সেন্টারে কর্মরত।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে (ডিএমপি) দীর্ঘদিন ধরে একাধিক থানার ওসির দায়িত্ব পালন করা গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার পুলিশ এবং দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পরিবারের ঘনিষ্ঠজন বিএম ফরমান আলীর বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই।

নিরাপরাধ লোকজনকে ধরে টাকার জন্য হয়রানি, ভুক্তভোগীদের অভিযোগ আমলে না নিয়ে আসামিদের পক্ষ নেওয়ার অভিযোগ তার বিরুদ্ধে বেশুমার। সাধারণ মানুষের সঙ্গে খারাপ আচরণ করাও তার কাছে স্বাভাবিক ঘটনা। পুলিশের একজন পরিদর্শক হয়ে লাখ লাখ টাকা খরচ করে ঢাকার একটি অভিজাত ক্লাবের ডোনার সদস্য হওয়ার ঘটনাতেও বিস্মিত করেছিল খোদ পুলিশের সদস্যদের।

চাঁদাবাজি দুর্নীতি অপকর্মের পাহাড় গড়েও এখনো বহাল তবিয়তে বিতর্কিত ওসি ফরমান আলী।

ওসি ফরমান সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আসেন ২০১৭ সালে ২৮ মার্চ রাজধানীর বনানীর রেইনট্রি হোটেলে আয়োজিত জন্মদিনের পার্টিতে দুজন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীকে আমন্ত্রণ করে সেখানে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করা হয়। এই অভিযোগ আনা হয়েছিল মামলায়। ধর্ষণের ঘটনায় প্রভাবশালী ধর্ষকদের পক্ষ নেওয়ার পর থেকে। ঘটনার শিকার দুই ছাত্রীকে আইনি সহায়তা না দিয়ে উল্টো গালাগাল করে থানা থেকে বের করে দেন সে সময়। ‘গুণধর’ এই ওসিকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে পুলিশ বিভাগেও চলে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা। এরপরও সেই থেকে ডিএমপির গুরুত্বপূর্ণ থানাগুলোতে ওসি হন। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার শেষ সময় পর্যন্ত ছাত্র-জনতার আন্দোলন রুখে দিতে দমন-পীড়ন চালান, করেন গুলি। বর্তমানে থানার ওসির দায়িত্ব থেকে তাকে সরিয়ে নিলেও অদৃশ্য ক্ষমতায় তিনি বহাল তবিয়তে রয়েছে পুলিশ বিভাগে।

ওসি ফরমানের সঙ্গে কাজ করা একাধিক পুলিশ সদস্য জানিয়েছেন, তিনি ঘুষ, মাদক, চোরাকারবারি, চাঁদাবাজি, অপহরণ, নির্যাতন, মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো, অবৈধভাবে আটক করে টাকা আদায়সহ নানা ধরনের অপকর্মে যুক্ত ছিলেন। সিনিয়র কর্মকর্তাদের নির্দেশ মানতে না ফরমান আলী। টুঙ্গিপাড়ায় বাড়ি এবং শেখ হাসিনার পরিবারের ঘনিষ্ঠ এই পরিচয়ে দাপিয়ে বেড়াতেন পুলিশ বিভাগে। তার ভয়ে মুখ খুলতে সাহস পেতেন না কোনো সিনিয়র-জুনিয়র কোনো পুলিশ সদস্য।

পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানান, শুধু গোপালগঞ্জ বাড়ি এই যোগ্যতায় মতিঝিল, বনানী, বিমানবন্দর, যাত্রাবাড়ী, উত্তরা পশ্চিম থানাতে ওসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। যদিও দুর্নীতি এবং জনগণকে হয়রানি করে টাকা কামানো ছাড়া আর কোনো যোগ্যতা তার নাই। দুর্নীতির মাধ্যমে কামিয়েছে শতকোটি টাকা টুঙ্গিপাড়া এবং ঢাকায় গড়ে তুলেছেন শত কোটি টাকার খামারবাড়ি, ফ্ল্যাটসহ এবং অন্যান্য সম্পদ। দুদকের মাধ্যমে তার ঘুষ চাঁদাবাজি দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত সম্পদের অনুসন্ধানের দাবি সহকর্মীদের। যাত্রাবাড়ীতে থাকা অবস্থায় টাকার জন্য লোক মেরে ফেলাতে তার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়।

জানা গেছে, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে নানান অপকর্মের অভিযোগে পুলিশের চাকরি চলে যায় ফরমান আলীর। ওই সময় তার নির্যাতিত হয়ে তার চাকরি গেছে এমন অজুহাতে ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তিনি চাকরি ফিরে পান। এর পরই বেপরোয়া হয়ে পড়েন।

হাসিনার গত ১৫ বছরে একাধিকবার অপরাধীর খাতায় নাম উঠেছে পুলিশ কর্মকর্তা এ বি এম ফরমান আলীর বিরুদ্ধে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনি বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হয়েছেন বলে তথ্য রয়েছে। একজন ওসির মাসিক বেতন সাকল্যে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা। সরকারি চাকরিজীবীদের কিছু বিধিমালা থাকে। সেইসব বিধিমালাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চাকরিতে বহাল রয়েছেন তিনি। নেয়া বিভাগীয় ব্যবস্থাও।

উত্তরায় কিশোর গ্যাংয়ের আশ্রয়দাতাঃ
রাজধানীর উত্তরায় ২০১৭ সালের ৬ জানুয়ারি দুই কিশোর গ্যাংয়ের দ্বন্দ্বে খুন হয়েছিল স্কুলছাত্র আদনান কবির (১২)। র‌্যাব এ ঘটনায় অভিযান চালিয়ে ‘ডিসকো বয়েজ’ ও ‘নাইন স্টার গ্রুপ’-এর আটজনকে গ্রেপ্তার করেছিল। তারা সবাই এখন জামিনে। এই দুই কিশোর গ্যাং আবারও ফিরেছে সেই ভয়ংকর চেহারায়। কারাগার থেকে বের হওয়ার পর এই গ্যাংয়ের সদস্যরা প্রতিনিয়ত হুমকি দিচ্ছে আদনানের পরিবারকে।  উত্তরা পশ্চিম থানায় ওসির দায়িত্ব পালনের সময় ওসি ফরমান কিশোর গ্যাংয়ের এই দুটি গ্রুপকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেন।

ওসি ফরমানের মদদ পেয়ে এই দুই কিশোর গ্যাংয়ের অত্যাচারে  সম্প্রতি উত্তরা ছাড়তে বাধ্য হয়েছে আদনানের পরিবার। আলোচিত চাঞ্চল্যকর সেই ঘটনার ছয় বছর পেরিয়ে গেলেও বিচার পায়নি আদনানের পরিবার। উত্তরায় কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য এতটুকুও কমেনি, বরং বেড়েছে। সেখানে কিশোর গ্যাং কালচার দিন দিন ভয়ংকর হয়ে উঠছে। মাদকের নেশায় জড়িয়ে পড়া থেকে শুরু করে চাঁদাবাজি, চুরি, ছিনতাই, যৌন হয়রানি, মাদক ব্যবসাসহ নানা ধরনের মারাত্মক অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে তারা।

৭০ লাখ টাকায় উত্তরা ক্লাবের সদস্যঃ
ওসি ফরমান আলী অর্ধকোটি টাকা খরচ করে সদস্যপদ নেন অভিজাত উত্তরা ক্লাবের। এ নিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয় পুলিশ বিভাগেও। তবে প্রভাবশালী ফরমানের বিরুদ্ধে মুখ খোলেননি কেউ। সূত্র জানায়, ক্লাবটির তিন ক্যাটাগরির সদস্যপদের মধ্যে দাতা সদস্যপদ নেয় ওসি ফরমান। দাতা সদস্য বা ডোনার ক্যাটাগরির পদ নিতে কমপক্ষে ৬৫ থেকে ৭০ লাখ টাকা প্রয়োজন হয়। চাকরিরত একজন ওসি কী করে এ বিপুল অঙ্কের টাকার বিনিময়ে সদস্য হলেন তা নিয়ে ক্লাবটির সদস্যদের মধ্যেও রয়েছে আলোচনা। ফরমান আলীর মেম্বারশিপ নম্বর ডিএম ৩৯৫।

আরবি/এস

Link copied!