ঢাকা: দুই সপ্তাহে রেকি করে ভুক্তভোগী শিশুর মায়ের সঙ্গে সাক্ষ্য গড়ে তুলেন ফাতেমা আক্তার শাপলা। পরে পরিকল্পনা করে সাবলেট ভাড়া নিয়ে আজিমপুরের বাসায় উঠেন তিনি ৷ বাসায় ওঠার একদিনের মধ্যেই ডাকাতি কার্যক্রম করেন চক্রটি। ডাকাতিকালে সন্তোষজনক মালামাল না পাওয়ায় ৮ মাসের শিশুকে নিয়ে মুক্তিপণ দাবির পরিকল্পনা করেন। কিন্তু শিশু ডাকাতির ঘটনা জানাজানি হলে মুক্তিপণ আর চাওয়া হয় নি ৷
এই ঘটনায় ভুক্তভোগী শিশুর বাবা আবু জাফরকে নজরদারিতে রেখেছে র্যাব। ফাতেমা আক্তার শাপলাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। উদ্ধার করা হয়েছে শিশু আরিশা জান্নাত জাইফাকে। শুক্রবার দিবাগত রাতে আদাবর এলাকা থেকে তাকে উদ্ধার করা হয়।
শনিবার (১৬ নভেম্বর) র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল মুনীম ফেরদৌস এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
তিনি বলেন, শিশু জাইফার মায়ের সঙ্গে সম্প্রতি সম্পর্ক গড়ে তোলে অপহরন চক্রের প্রধান ফাতেমা আক্তার। শিশুটির মা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্টেনোগ্রাফার হিসেবে কর্মরত। তিনি মন্ত্রণালয়ের বাসে যাতায়াতকালে কৌশলে ওই বাসে ওঠেন অপহরনকারী ফাতেমা। নানানভাবে অপহৃতের মায়ের সঙ্গে সু-সম্পর্ক গড়ে তোলেন।
একপর্যায়ে শিশুর মায়ের সঙ্গে সাবলেটে একই বাড়ি থাকার পরিকল্পনাও করেন তারা। ঘটনার দিন আজিমপুরে ভুক্তভোগী শিশুটির বাড়িতে প্রবেশ করেন অপহরনকারী ফাতেমা আক্তার। এসময় কৌশলে ভুক্তভোগীকে ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হয়। এরপর ফাতেমার তিনজন সহযোগী ওই বাড়িতে প্রবেশ করে। বাড়িতে থাকা নগদ ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা, প্রায় সাত ভরি স্বর্ণালঙ্কার লুট করা হয়। এরপর শিশু মেয়ে আরিশা জান্নাতকে অপহরন করে আনা হয়। রাখা হয় অপহৃতের আদাবর নবীনগর হাউজিংয়ে। সেখান থেকে গতকাল রাতে র্যাব শিশুটিকে উদ্ধার করে।
লে. কর্নেল মুনীম ফেরদৌস বলেন, অপহৃত ভিকটিম ৮ মাস বয়সী শিশু কন্যা আরিসা জান্নাত জাইফাকে উদ্ধার করে তার পরিবারের নিকট হস্তান্তর করা হয়েছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃত উক্ত ডাকাতি ও অপহরণের সাথে তার সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে তথ্য প্রদান করে।
ভিকটিম আরিসা জান্নাত জাইফা এর মায়ের নাম ফারজানা আক্তার। ভিকটিমের মা চাকরি করেন এবং ভিকটিমের পিতা বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। রাজধানীর আজিমপুরের লালবাগ টাওয়ার এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় ভিকটিমের পরিবার বিগত ৩ বছর যাবৎ বসবাস করে আসছেন।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, অপহরণের দুই সপ্তাহ পূর্বে ভিকটিমের মায়ের সাথে অফিসে যাতায়াত করার সময় গ্রেফতারকৃত শাপলার পরিচয় হয়। এসময় গ্রেফতারকৃত শাপলা ভিকটিমের মায়ের কাছে তার নাম রাইসা এবং তার বাড়ি নওগাঁ জেলা বলে মিথ্যা পরিচয় প্রদান করে। আসামি ফাতেমা আক্তার শাপলা আরো জানায় যে, সে অবিবাহিত এবং একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ ২য় সেমিস্টারের ছাত্রী। পড়ালেখার পাশাপাশি সে সচিবালয়ের পরিবহন পুলে অফিস সহায়ক হিসেবে চাকুরি করে বলে জানায়।
গ্রেপ্তারকৃত ফাতেমা আক্তার ভিকটিমের মা ফারজানা আক্তারকে আরো জানায় যে, তার ঢাকায় থাকার জন্য সাবলেট হিসেবে একটি ভাল রুম দরকার এবং তাকে সাবলেট হিসেবে ভিকটিমের বাসায় ভাড়া দিলে সারাদিন বাসায় পড়াশোনার পাশাপাশি ভিকটিমকে দেখভালও করতে পারবে। ভিকটিমের মা ভিকটিমের দেখাশুনার কথা চিন্তা করে গ্রেফতারকৃত ফাতেমা আক্তারকে সাবলেট হিসেবে বাসা ভাড়া দেয়ার জন্য রাজি হয়। পরবর্তীতে গ্রেফতারকৃত ফাতেমা আক্তার গত ১৪ নভেম্বর বিকালে বাসায় আসে এবং ভিকটিমের মাকে ২০০০ টাকা অগ্রিম ভাড়া হিসেবে প্রদান করে বাসায় রাত্রি যাপন করে। পরের দিন সকালে গ্রেফতারকৃত ফাতেমা আক্তার ভিকটিমের মা ফারজানা আক্তারকে জানায় যে, গ্রাম থেকে তার চাচাতো ভাই চাল নিয়ে তার বাসায় আসবে। পরবর্তীতে সকাল সাড়ে ৮টায় ঘটিকায় গ্রেফতারকৃত ফাতেমা আক্তার তার চাচাতো ভাই পরিচয়ে ৩ ব্যক্তিকে বাসায় নিয়ে আসে। বাসায় আসার পর আলাপচারিতার এক পর্যায়ে গ্রেফতারকৃত ফাতেমা আক্তার ও তার কথিত চাচাতো ভাইয়েরা ধারালো অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে ভিকটিমের মাকে ওড়না দিয়ে হাত-পা বেঁধে ফেলে।
এসময় গ্রেপ্তারকৃত ফাতেমা আক্তার ও তার সহযোগীরা বাসার স্বর্ণালংকার ও নগদ অর্থসহ মূল্যবান মালামাল লুট করে ভিকটিম জাইফাকে নিয়ে গ্রেফতারকৃতের বাসায় চলে আসে এবং তার সহযোগীরা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর গ্রেফতার এড়াতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় আত্মগোপন করে। পরবর্তীতে গোয়েন্দা নজরদারী ও তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় রাজধানীর মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিং এলাকা থেকে ভিকটিম জাইফাকে উদ্ধার পূর্বক অপহরণের পরিকল্পনাকারী ফাতেমা আক্তারকে গ্রেফতার করা হয়। উল্লেখ্য, গ্রেফতারকৃত ফাতেমা আক্তার ও তার সহযোগীরা মুক্তিপণ আদায় করার পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু ঘটনাটি বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দ্রæত ছড়িয়ে পড়ার কারণে দেশব্যাপী ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হলে তারা ভিকটিমের পরিবারের নিকট মুক্তিপণ দাবী করতে পারেনি বলে জানায়।
গ্রেপ্তারকৃত মোছা. ফাতেমা আক্তার শাপলা একজন গৃহিনী। সে ২০১০ সালে তার পরিবারের সাথে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বসবাস শুরু করে। সে ২০১২ সালে বগুড়ার একটি স্কুল থেকে এসএসসি এবং ২০১৪ সালে রাজধানীর একটি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে। পরবর্তীতে রাজধানীর অপর একটি কলেজে মার্কেটিং বিষয়ে অনার্সে ভর্তি হয়ে পড়াশোনা শুরু করলেও তা শেষ করেনি। পরবর্তীতে ২০২৩ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় এবং বিগত ৩-৪ মাস পূর্বে মোহাম্মদপুর নবীনগর হাউজিং এলাকায় তার স্বামীর নিজস্ব ফ্লাটে বসবাস শুরু করে।
গ্রেপ্তারকৃত আসামির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন বলেও জানান র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল মুনীম ফেরদৌস।
আপনার মতামত লিখুন :