বহুল আলোচিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জের পৃষ্ঠপোষক ও বনানী থানার সাবেক পরিদর্শক (তদন্ত) সোহেল রানা এবার লেবাননে গ্রেপ্তার হয়েছে। ইন্টারপোলের সহায়তায় দেশটির আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গত জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে তাকে গ্রেপ্তার করে বলে জানা গেছে।
সোহেলকে দেশে ফেরাতে শিগগির লেবাননে যাচ্ছে পুলিশের বিশেষ টিম। এর আগে ২০২১ সালের ৪ সেপ্টেম্বর পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলার চ্যাংরাবান্ধা সীমান্ত থেকে গ্রেপ্তার করে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)। এরপর জামিন পেয়ে লেবাননে পালিয়ে যায়।
ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জের ফাঁদে ফেলে ৫৪৭ জন গ্রাহকের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ পাওয়া যায় তার বিরুদ্ধে। এর আগে ২০২৩ সালের ২৯ জানুয়ারি প্রতারণার অভিযোগে আলোচিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জের পৃষ্ঠপোষক ও বরখাস্ত হওয়া বনানী থানার পরিদর্শক শেখ সোহেল রানাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে সরকারের পদক্ষেপ জানতে চান হাইকোর্ট।
ওইদিন শুনানিতে আইজিপির প্রতিবেদন তুলে ধরে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী জানিয়েছিলেন, সোহেল রানার বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের রেড নোটিস জারি করা আছে। ২০২৩ সালের ১৬ জানুয়ারি পাওয়া তথ্য অনুসারে- ভারতে অবৈধ অনুপ্রবেশের কারণে তিনি তিন বছরের সাজাপ্রাপ্ত হয়ে প্রেসিডেন্সি কারেকশনাল হোম আলীপুরে আটক ছিলেন। জামিন নিয়ে পরে সেখান থেকে সোহেল রানা পালিয়ে গেছেন।
জানা যায়, কাফেলো নামে পর্তুগালের এক নাগরিক সোহেল রানার বন্ধু। তার সঙ্গে যোগাযোগ করে ভারতীয় পাসপোর্ট ব্যবহার করে পর্তুগালের ভিসা নিয়ে ওই দেশে পালিয়ে যান সোহেল রানা। সেখান থেকে তিনি পরে লেবাননে চলে যান। জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের ইন্টারপোলের শাখা কার্যালয় ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরোর (এনসিবি) এআইজি আলী হায়দার চৌধুরী এ প্রতিবেদককে বলেন, লেবাননে সোহেল রানা আটকের বিষয়টি আমরা জানতে পেরেছি। বিষয়টি নিয়ে আমরা কাজ করছি।
সূত্র জানায়, লেবাননে পুলিশের একটি টিম পাঠাতে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও পুলিশ সদর দপ্তরের সমন্বয়ে একটি টিম পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নোটারি করে পুলিশ সদর দপ্তরের মাধ্যমে ৭ ফেব্রুয়ারি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
বর্তমানে সোহেল রানা, তার কথিত স্ত্রী নাজনীন নাহার, বোন সোনিয়া মেহজাবিন ও ভগ্নিপতি মাশুকুর রহমানের নামে অসংখ্য মামলা আছে। এসব মামলায় প্রতারণা, অর্থ আত্মসাৎ, অর্থ পাচারসহ (মানি লন্ডারিং) বিভিন্ন অভিযোগ আনা হয়েছে। সোনিয়া ও মাশুকুর এখন কারাগারে আর নাজনীন পলাতক।
মাশুকুর রহমান কাশিমপুর-৪ হাইসিকিউরিটি কারাগারে রয়েছে এবং তার স্ত্রী সোনিয়া মেহজাবিন রয়েছে কাশিমপুর-৩ মহিলা কারাগারে। তারা কারাগারে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা পান বলে বিভিন্ন সুত্রে জানা গেছে। এছাড়া সম্প্রতি কাগজপত্র জালজালিয়াতি করে হাইকোর্ট থেকে জামিন নিলেও পরে এ বিষয়ে ভোরের কাগজে সংবাদ প্রকাশ হলে তার জামিন ঝুলে যায়।
সোহেল রানার যত সম্পদ
পুলিশের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীর শাহজাদপুরে একটি, গুলশান মডেল টাউনে একটি, নিকেতনে দুটি ও বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ই–ব্লকে একটি ফ্ল্যাট আছে সোহেল রানার।
গুলশানে একটি বাণিজ্যিক ভবনে ৯ কোটি টাকায় স্পেস (জায়গা) কিনেছেন তিনি। এ ছাড়া বসুন্ধরা ও পূর্বাচলে দুটি প্লট এবং গুলশান ও উত্তরায় তিনটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সন্ধান পাওয়া গেছে তাঁর। রাজধানীর বাইরে নিজ জেলা গোপালগঞ্জে এবং খাগড়াছড়িতে জমি কিনেছেন তিনি।
সোহেল রানার এই বিপুল অর্থসম্পদ নিয়ে পুলিশ অনুসন্ধান করার কথা জানিয়েছিল। কিন্তু পরে সেটা এগোয়নি। এ ছাড়া থাইল্যান্ডের পাতায়ায় সোহেল রানার সুপারশপ, জমি ও ফ্ল্যাট, পর্তুগালের লিসবনে সুপারশপ, বার ও রেস্তোরাঁ, ফিলিপাইনের ম্যানিলায় বার এবং নেপালের কাঠমান্ডুতে একটি বার ও ক্যাসিনো আছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। কোনো কোনো পুলিশ কর্মকর্তা মনে করেন, সোহেল রানা স্থলপথে ভারত হয়ে নেপাল যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন।
সোহেল রানা বছর ছয় আগে পদোন্নতি পেয়ে পুলিশের পরিদর্শক হন। এর আগে দীর্ঘদিন গুলশান ও বাড্ডা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) ছিলেন।
গুলশান বিভাগের পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সোহেল ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত গুলশান থানার এসআই থাকাকালে কূটনৈতিক এলাকার দায়িত্ব পালন করেন। তখন বিভিন্ন দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ গড়ে ওঠে। সোহেল বিভিন্ন দেশে লোক পাঠিয়েছেন বলেও তথ্য পেয়েছে পুলিশ।
গুলশানের পর সোহেল রানা ২০১৫ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত মালিবাগে পুলিশের বিশেষ শাখায় (এসবি) কর্মরত ছিলেন। পরে পদোন্নতি পেয়ে পরিদর্শক হলেও ২০২০ সালের ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত এসবিতে ছিলেন তিনি। এরপর চার মাস পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্র্যান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটে ছিলেন সোহেল। পরে ২০২০ সালের ২৮ মে বনানী থানায় পরিদর্শকের দায়িত্ব পান। দেশ ছাড়ার আগে ওই পদেই ছিলেন তিনি।
২০২১ সালের ১৮ আগস্ট ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে গুলশান থানায় মামলা হয়। এরপর সোহেল রানার নাম আলোচনায় আসে। সোহেল রানার বিরুদ্ধে হওয়া মানি লন্ডারিং আইনের মামলা তদন্ত করছেন সিআইডির পরিদর্শক মোহাম্মদ ছাদেক আলী। মামলার অগ্রগতি প্রসঙ্গে ছাদেক আলী বলেন, সোহেলের বিষয়ে তথ্য চেয়ে ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে (বিএফআইইউ) চিঠি পাঠানো হয়েছে। সেই তথ্যও এসেছে
আপনার মতামত লিখুন :