ঢাকা সোমবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২৫

জম্মু-কাশ্মীর সীমান্তে যুদ্ধের আশঙ্কা

আরিয়ান স্ট্যালিন
প্রকাশিত: এপ্রিল ২৮, ২০২৫, ১২:৪৪ এএম

জম্মু-কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার পর ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার উত্তেজনা এখন তুঙ্গে। সেনাদের মধ্যে নিয়ন্ত্রণরেখায় (এলওসি) গত শনিবার দিবাগত রাতে আবারও গোলাগুলি হয়েছে। এ নিয়ে ধারাবাহিকভাবে তৃতীয় রাতের মতো গোলাগুলি হলো। ভারতীয় সেনাবাহিনী গতকাল রোববার এ কথা জানিয়েছে। গত মঙ্গলবার কাশ্মীরের পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর হামলাকে কেন্দ্র করে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার সম্পর্ক গত কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে তলানিতে এসে ঠেকেছে। ভারতের অভিযোগ, পাকিস্তান আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন দিচ্ছে। তবে পাকিস্তান ওই হামলায় জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছে। এ নিয়ে ভারতের যেকোনো পদক্ষেপের বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে দেশটি। পেহেলগামে হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার পর দায়ী ব্যক্তিদের খুঁজতে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী বড় ধরনের অভিযান চালাচ্ছে। ভারতীয় পুলিশের দাবি, পলাতক বন্দুকধারীদের মধ্যে দুজন পাকিস্তানি নাগরিক। 

ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মীরের সীমান্তবর্তী গ্রাম আরএস পুরাতে যুদ্ধের শঙ্কায় সামরিক বাংকার পরিষ্কার করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। সম্প্রতি পেহেলগামে ভয়াবহ বিদ্রোহী হামলার পর ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা চরমে পৌঁছেছে, যার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে সীমান্ত অঞ্চলে। সংবাদ সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে স্থানীয় বাসিন্দা বালবীর কৌর বলেন, ‘আমরা সীমান্ত এলাকার বাসিন্দা। ভারতে যা-ই ঘটুক না কেন, তার প্রভাব আগে এসে পড়ে আমাদের ওপর। তাই আমরা আগে থেকেই প্রস্তুতি নিচ্ছি, যাতে কিছু ঘটলে সরকারের চিন্তা না করতে হয় আমাদের নিরাপত্তা নিয়ে। আমরা চাই না, আমাদের কারণে সরকার যেন অতিরিক্ত চাপ অনুভব করে।’ এদিকে, শনিবার রাতেও ভারত ও পাকিস্তানের সেনাদের মধ্যে সীমান্তে গোলাগুলি বিনিময়ের ঘটনা ঘটে। সীমান্তজুড়ে বাড়ছে সামরিক তৎপরতা ও জনমনে উৎকণ্ঠা। স্থানীয়দের দাবি, অতীতে এমন উত্তেজনার সময় তারা ভয়ংকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন, তাই এবার আগাম প্রস্তুতি নিচ্ছেন যেন প্রাণহানি বা ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো যায়।

এদিকে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে গত সপ্তাহে ঘটে যাওয়া সন্ত্রাসী হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা এফবিআইয়ের পরিচালক ক্যাশ প্যাটেল।

রোববার দেওয়া বিবৃতিতে তিনি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ভারত সরকারকে ধারাবাহিক সহায়তা দেওয়ারও আশ্বাস দিয়েছেন বলে এনডিটিভিতে প্রকাশিত এক খবরে জানানো হয়েছে। ‘সন্ত্রাসবাদের অপকর্মে আমাদের বিশ্ব যে ধারাবাহিক হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে’ পেহেলগামে হামলা তা মনে করিয়ে দিচ্ছে, বলেছেন প্যাটেল। ‘এফবিআই কাশ্মীরে সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হামলায় নিহত সবার প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছে। ভারত সরকারকে আমাদের পূর্ণ সমর্থন প্রদান অব্যাহত থাকবে,’ সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম এক্সে লিখেছেন এফবিআইপ্রধান।

হামলার পরদিন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ফোন করে সন্ত্রাসী হামলাটির নিন্দা জানিয়েছিলেন।

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ বলেছেন, পাকিস্তান যেকোনো মূল্যে পানির অধিকার রক্ষা করবে। তিনি বলেন, পানিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া হবে না এবং পাকিস্তান যেকোনো মূল্যেই নিজের পানির অধিকার রক্ষা করবে। শনিবার এই তথ্য জানিয়েছে পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যম জিও নিউজ। ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপকালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী এই মন্তব্য করেন। শেহবাজ শরিফ স্পষ্ট করে বলেন, ভারতশাসিত কাশ্মীরের পেহেলগাম হামলার সাথে পাকিস্তানের কোনো সরাসরি বা পরোক্ষ সম্পর্ক নেই। বরং গত দুই দশকে পাকিস্তান নিজেই সন্ত্রাসবাদের অন্যতম বড় শিকার, যেখানে হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানি এবং বিপুল অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে।

রোববার ‘মন কি বাত’ রেডিও প্রোগ্রামে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, জম্মু-কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় ভারতীয়দের রক্ত টগবগ করছে। যাদের প্রিয়জন এই হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন তাদের বেদনা প্রত্যেক ভারতীয় অনুভব করছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেন, পেহেলগাম হামলা সন্ত্রাসের মাস্টারদের কাপুরুষতার প্রমাণ। কাশ্মীরে শান্তি ফিরে আসছিল। স্কুল ও কলেজগুলোতে প্রাণচাঞ্চল্য ছিল, উন্নয়নকাজের গতি ছিল অতুলনীয়, গণতন্ত্র শক্তিশালী হচ্ছিল, পর্যটকদের সংখ্যা রেকর্ড পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছিল, আয়ের পরিমাণ বাড়ছিল এবং যুবকদের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছিল। দেশ এবং জম্মু ও কাশ্মীরের শত্রুরা এই পরিবর্তন পছন্দ করেনি। মোদি আরও বলেন, ‘২২ এপ্রিলের হামলা প্রত্যেক ভারতীয়ের হৃদয়ে আঘাত দিয়েছে, তার জাতিগত পরিচয় বা ভাষা যা-ই হোক না কেন। আমি অনুভব করছি, প্রতিটি ভারতীয়ের রক্ত টগবগ করছে এই সন্ত্রাসী হামলার ছবি দেখে।’ ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেন, পুরো পৃথিবী ভারতের পাশে আছে। আমি শোকসন্তপ্ত পরিবারগুলোর কাছে আশ্বাস দিতে চাই যে, তারা বিচার পাবেন। এই হামলার পেছনে যারা ছিলেন, তাদের সবচেয়ে কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে। কারণ যারা এই ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা করেছে তারা কাশ্মীরকে ধ্বংস করতে চায়।

বিস্ফোরক এক মন্তব্য করেছেন পাকিস্তানের রেলওয়েমন্ত্রী হানিফ আব্বাসী। তিনি বলেছেন, ভারতকে ঘায়েল করতে তার দেশ পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম শাহীন ও গজনবীর মতো ক্ষেপণাস্ত্রসহ ১৩০টি ক্ষেপণাস্ত্র প্রস্তুত করে রেখেছে। হানিফ আব্বাসী আরও বলেছেন, ‘শাহীন ও গজনবী ক্ষেপণাস্ত্রগুলো আমরা আমাদের ঘাঁটিতে প্রস্তুত করে রেখেছি, সেগুলো প্রস্তুত রাখা হয়েছে হিন্দুস্তানের জন্য। ১৩০টি ক্ষেপণাস্ত্র কেবলমাত্র নমুনা হিসেবে রাখা হয়নি, আপনাদের কোনো ধারণাই হবে না যে পাকিস্তানের কোথায় কোথায় সেগুলো মোতায়েন করা হয়েছে।’ ভারতীয় গণমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারত থেকে পাকিস্তানি দূতাবাসের সামরিক কর্মকর্তাদের বহিষ্কারের মাধ্যমে দেশটির বিরুদ্ধে কূটনৈতিক ব্যবস্থা নেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানি রেলমন্ত্রী এমন মন্তব্য করেছেন।

চলমান উত্তেজনার মধ্যে আরব সাগরে একাধিক অ্যান্টি-শিপ (জাহাজ বিধ্বংসী) ক্ষেপণাস্ত্রের সফল পরীক্ষা চালিয়েছে ভারতীয় নৌবাহিনী। দেশটির নৌবাহিনী বলছে, এ সফলতা দেশের সমুদ্র নিরাপত্তা ও যুদ্ধ প্রস্তুতির ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। প্রতিবেদনে বলা হয়, আরব সাগরে মোতায়েন ভারতীয় যুদ্ধজাহাজ থেকে ব্রহ্মোস ক্ষেপণাস্ত্রসহ ভূমি বিধ্বংসী ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের একাধিক দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করেছে নৌবাহিনী। রোববার (২৭ এপ্রিল) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি। প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতীয় যুদ্ধজাহাজগুলো এই পরীক্ষার মাধ্যমে দূরপাল্লার নির্ভুল আক্রমণের জন্য তাদের প্রস্তুতি প্রদর্শন করেছে। ভারতীয় নৌবাহিনী দাবি করেছে, তারা জাতির স্বার্থ রক্ষার জন্য যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত।

নদীর প্রতিটি ফোঁটা পানির ওপর পাকিস্তানের অধিকার অবিচ্ছেদ্য বলে জানিয়েছে ইসলামাবাদ। রোববার (২৭ এপ্রিল) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যম দ্য ডন। সংবাদমাধ্যমটি বলেছে, পানিচুক্তি নিয়ে পাকিস্তানের অবস্থান স্পষ্ট এবং দৃঢ়। এই চুক্তি কেবল পাকিস্তান ও ভারতের পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতেই বাতিল করা যেতে পারে; কোনো পক্ষ একতরফাভাবে এটি স্থগিত করতে পারে না।

ভারতশাসিত কাশ্মীরে বন্দুকধারীদের হামলার পর পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে সম্পর্কের চরম অবনতি হয়েছে। হুংকার ও পাল্টা হুংকারে বাড়ছে সামরিক সংঘাতের শঙ্কাও। এমন অবস্থায় পাকিস্তানের কাশ্মীরে দেখা দিয়েছে ভয়াবহ বন্যা। ভারত হঠাৎ করে পানি ছেড়ে দেওয়ার পর এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া বন্যার কারণে পাকিস্তানের আজাদ কাশ্মীরের রাজধানী মুজাফফরাবাদে পানি নিয়ে জরুরি অবস্থাও ঘোষণা করা হয়েছে। রোববার (২৭ এপ্রিল) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম দ্য নিউজ ইন্টারন্যাশনাল।

সংবাদমাধ্যমটি বলছে, পাকিস্তানকে কোনো ধরনের পূর্বসংকেত না দিয়েই মুজাফফরাবাদের হাত্তিয়ান বালা এলাকায় ঝিলম নদীতে অতিরিক্ত পানি ছেড়েছে ভারত। এই হঠাৎ পানিপ্রবাহের কারণে মুজাফফরাবাদ প্রশাসন জরুরি ভিত্তিতে ‘পানি জরুরি অবস্থা’ ঘোষণা করেছে। 

হামলার পর সাম্প্রতিক নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানি নাগরিকদের ভিসা প্রত্যাহার করেছে ভারত। এ ছাড়া অবৈধ অভিবাসীদের খুঁজতে অভিযান চালাচ্ছে দেশটির আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এরই ধারাবাহিকতায় দিল্লিতে পাঁচ হাজার পাকিস্তানি নাগরিককে শনাক্ত করা হয়েছে। এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে দেশটির সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি। প্রতিবেদনে বলা হয়, ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো (আইবি) রাজধানীতে বসবাসকারী এই পাকিস্তানিদের দেশে ফেরত নিশ্চিত করতে প্রায় পাঁচ হাজারজনের তালিকা দিল্লি পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছে। ফরেন রিজিওনাল রেজিস্ট্রেশন অফিস (এফআরআরও) ও দিল্লি পুলিশের একটি বিশেষ শাখা  এটি আরও যাচাই ও শনাক্তকরণের জন্য সংশ্লিষ্ট জেলার সঙ্গে কাজ করছে। তবে দীর্ঘমেয়াদি ভিসা থাকা হিন্দু পাকিস্তানি নাগরিকদের ছাড় দেওয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।