ঢাকা বুধবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
ভ্যানে লাশের স্তূপ ও পুড়িয়ে হত্যা

গণহত্যার মাস্টারমাইন্ড কাফী ক্ষমতার প্রশ্রয়ে বেপরোয়া

রূপালী প্রতিবেদক

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৩, ২০২৪, ১০:৪৩ পিএম

গণহত্যার মাস্টারমাইন্ড কাফী  ক্ষমতার প্রশ্রয়ে বেপরোয়া

আব্দুল্লাহিল কাফী । ছবি: সংগৃহীত

*লাশ পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশদাতার বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে 
*ক্রস ফায়ারের ভয় দেখিয়ে হাতিয়ে নিত মোটা অঙ্কের টাকা
*নানা অপকর্মে গড়েছেন বিপুল পরিমাণ সম্পদ
*আত্মগোপনে পুলিশ কর্মকর্তা আরাফাতসহ অভিযুক্তরা

সাভারের আশুলিয়ায় ভ্যানে নিথর দেহের স্তূপ ও পুলিশের পিকআপে ভ্যানে তুলে পোড়ানোর মাস্টারমাইন্ড আব্দুল্লাহিল কাফী ক্ষমতার প্রশ্রয়ে ছিলেন বেপরোয়া। সাধারণ মানুষকে ক্রস ফায়ারের ভয় দেখিয়ে হাতিয়ে নিত মোটা অঙ্কের টাকা। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের ছেলে শাফি মোদাচ্ছের খান জ্যোতির বন্ধু ছিলেন কাফী। ধানমন্ডিতে সহকারী পুলিশ সুপার (এসি) থাকাকালীন সময়ে জ্যোতির বন্ধু হওয়ায় সেই থেকেই বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তিনি। ধানমন্ডি জোনের দায়িত্ব থাকা অবস্থায় বিভিন্ন মদের বার, হোটেল ও নিউমার্কেটের ফুটপাত থেকে মাসে কোটি কোটি টাকা মাসোয়ারা নিতেন। এ ছাড়া সাভারে গার্মেন্টস ব্যবসায়ীদের ব্ল্যাকমেইল করে হাতিয়ে নিত মোটা অঙ্কের টাকা। তার নির্দেশেই আশুলিয়ায় গণহত্যা চালানোর প্রাথমিক তথ্য মিলেছে। এর বাইরে ঊর্ধ্বতন কোনো পুলিশ কর্মকর্তা জড়িত ছিলেন কি না তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। বর্বর ওই ঘটনার ভিডিও প্রকাশ হওয়ার পর নিজেকে আড়ালে রাখতে বেশ বদলান কাফী। দাঁড়িতে মুখ ঢেকেও শেষ রক্ষা হয়নি তার। আশুলিয়ায় ছাত্র-জনতাকে হত্যার পর আগুনে পুড়িয়ে ফেলার ঘটনায় সংশ্লিষ্টতা পেয়ে ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) আব্দুল্লাহিল কাফীকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। সোমবার রাতে দেশ ত্যাগ করার সময় হযরত শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

গত ৫ আগস্ট আশুলিয়া থানার সামনে গুলি করে মানুষ হত্যার পর তা ভ্যানে তোলা ও পরে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার ঘটনাটি প্রকাশ্য আসার পর গঠন করা হয় চার সদস্যের তদন্ত কমিটি। এ ছাড়াও আলোচিত ইয়ামিন হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পুলিশ সদর দপ্তর গঠিত তদন্ত দলের প্রাথমিক তদন্তে এ ঘটনায় কাফীর ইন্ধন ও নির্দেশের সত্যতা পায় বলে জানা গেছে। পরে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। এদিকে কাফীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন শহীদ শাইখ আসহাবুল ইয়ামিনের বাবা মোহাম্মদ মহিউদ্দিন। এর আগে গত সোমবার সকালে মিরপুর মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী শহীদ শাইখ আসহাবুল ইয়ামিনের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আব্দুুল্লাহিল কাফীকে আসামি করে সাভার মডেল থানায় মামলা করেন ইয়ামিনের বাবা। ওই হত্যাকাণ্ডে গ্রেপ্তার হতে পারেন এমন আশঙ্কা থেকেই তড়িঘড়ি করে দেশ ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করেন কাফী।

জানা গেছে, ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সুপার নিউমারারি পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) আব্দুল্লাহিল কাফীর বিরুদ্ধে দুটি মামলা করা হয়েছে। মামলাগুলোতে তাকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে রিমান্ডের আবেদন করবে পুলিশ।

জানা গেছে, গত ১৮ জুলাই সাভারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দিয়ে পুলিশের গুলিতে নির্মমভাবে প্রাণ হারান শহীদ শাইখ আসহাবুল ইয়ামিন। গুলিবিদ্ধ ইয়ামিনকে পুলিশের সাঁজোয়া যানেই ঘুরিয়ে পরে সড়কে ফেলে দেওয়ার দৃশ্য ভাইরাল হয়। যা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার হয়।

এদিকে সাভারে আল মুসলিম গ্রুপের মানবসম্পদ ও প্রশাসন বিভাগের ডিজিএম আবু রায়হানকে বিনা কারণে আটক করে ভয়ভীতি দেখানো, নাশকতার মামলায় গ্রেপ্তার ও তিন দিনের রিমান্ডে নিয়ে ক্রস ফায়ারের ভয় দেখিয়ে ২৫ লাখ টাকা নেওয়ার গুরুতর অভিযোগ উঠেছে আব্দুুল্লাহিল কাফীর বিরুদ্ধে। আল মুসলিম গ্রুপের অর্থ বিভাগের পরিচালক ফিরোজ আহমেদ বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, আব্দুল্লাহিল কাফীর কাছে জিম্মি ছিল শিল্পাঞ্চলের মালিকরা। তিনি ২৫ লাখ টাকা নিয়ে নিরীহ কর্মকর্তাকে সীমাহীন হয়রানি করেছেন।

কাফীর অপকর্মের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে সাভার মডেল থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাহ জামান বলেন, আজ তার কারণেই আমাদের জীবনে এত বিপত্তি। আসলে আমরা থানায় ছিলাম নামে ওসি। প্রকৃতপক্ষে তিনিই মূলত এসপি হয়ে ওসিগিরি করেছেন। খোদার কসম। কতবার বলেছি, স্যার আপনি নিরীহ মানুষদের ধইরেন না। উনি শোনেন নাই। নিজের মতো কাজ করে গেছেন।

পুলিশের একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রাজধানীর মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে রাখা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার দেশ ত্যাগ করার পরেও কার নির্দেশনায় তিনি গুলি করার জন্য অন্যান্য পুলিশ সদস্যদের নির্দেশ দিয়েছেন? কি ধরনের নির্দেশনা আসছিলেন, গুলি করার জন্য কে নির্দেশ দিয়েছেন, এমন নানা প্রশ্নের উত্তর জিজ্ঞাসাবাদে করা হচ্ছে বলে জানা যায়। এ ছাড়াও পুলিশের এই কর্মকর্তা যদি অপরাধ নাই করতেন তা হলে কেন দেশ ত্যাগ করার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলেন বলে ডিবির এক সূত্র জানান। 

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম পুলিশ কমিশনার (উত্তর) মো. রবিউল হোসেন ভুঁইয়া জানান, বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ২৯ ব্যাচের কর্মকর্তা কাফীর বিরুদ্ধে আশুলিয়াসহ দুটি মামলা হয়েছে। আশুলিয়ায় পুলিশের গাড়িতে নিহতদের মরদেহ পুড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ ক্ষতিয়ে দেখা হচ্ছে। তার সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলেই গ্রেপ্তার দেখানো হবে। এ ছাড়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের অনুমতির অপেক্ষায় রয়েছেন ডিবি।

জানা গেছে, ১৯৮৫ সালে আব্দুল্লাহিল কাফী সিরাজগঞ্জ সদর থানায় জন্মগ্রহণ করেন। শিক্ষাজীবন শেষে ২০১১ সালের আগস্ট মাসে বিসিএস পুলিশ ক্যাডারে যোগদান করেন। দীর্ঘ ১৪ বছরের চাকরির জীবনে তিনি ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি), ঢাকা জেলা পুলিশে কর্মরত ছিলেন। চাকরি জীবনে তিনি বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন বলেও জানা যায়।

আরবি/জেডআর

Link copied!