গত ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বদলে যেতে শুরু করে দেশের প্রায় প্রতিটি অঙ্গনের চিত্র। সেই সঙ্গে খোলস পাল্টাতে শুরু করেন একাধিক আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। আর এরই ধারাবাহিকতায় শ্রমিক লীগের পদে থাকা রাজধানীর বিমানবন্দর থানার দেলোয়ার হোসেন দেলু রাতারাতি বনে যান শ্রমিকদলের নেতা।
জানা গেছে, পূর্বের পদ-পদবী গোপন করে নিজেকে শ্রমিক দলের নেতা পরিচয় দিয়ে বিমানবন্দর রেন্ট-এ-কার কাউন্টার ব্যবসা দখলে নিতে রেন্ট-এ-কার অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যদের বিরুদ্ধে বিমানবন্দর থানায় একটি মিথ্যা মামলাও দায়ের করেছেন তিনি।
খোজ নিয়ে জানা যায়, দেলোয়ার হোসেন দেলু ২০১০ সালে বিমানবন্দর থানা শ্রমিকলীগের কমিটিতে দপ্তর সম্পাদক ছিলেন। এছাড়া তিনি ২০২৪ সালের জাতীয় শ্রমিক লীগ, ঢাকা মহানগর উত্তর কমিটির একজন কার্যকরী সদস্য হিসেবে আছেন। কিন্তু তারপরেও দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরই সুবিধাবাদী হিসেবে খোলস পাল্টেছেন তিনি। বর্তমানে নিজেকে শ্রমিক দল নেতা হিসেবে পরিচয় দেন।
গত ২৮ অক্টোবর রেন্ট-এ-কার ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে বিমানবন্দর থানায় মামলা করেন দেলু। রুজু হওয়া সেই মামলা নং-২৮। সেই মামলায় দেলু উল্লেখ করেছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে শ্রমিক লীগের নেতা নুরুল ইসলাম গং গুলশানে খালেদা জিয়ার বাড়ি অবরুদ্ধ করে রাখার জন্য দেলুকে গুলশানের বাড়ির সামনে বালু ভর্তি দুটি ট্রাক দিতে হবে অথবা নগদ টাকা দিতে হবে বলে দাবি করে। বাদী শ্রমিক লীগের নেতাদের দাবি না মানায় তার উপর দেশীয় অস্ত্র নিয়ে হামলা চালানো হয় এবং পা ভেঙে দেয়।
দেলু মামলায় আরও উল্লেখ করেন, তিনি সুস্থ হয়ে থানায় মামলা করতে গেলে থানার ওসি বিএম ফরমান আলী তার মামলা নিতে অস্বীকৃতি জানায়।
তবে বিমানবন্দর থানায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পুলিশ পরিদর্শক বিএম ফরমান আলী ২০১৩ সালে বিমানবন্দর থানায় ওসি হিসেবে কর্মরত ছিলেন না। সে সময় তিনি মতিঝিল থানার ওসি হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন।
আর বিমানবন্দরের বিভিন্ন রেন্ট-এ-কার কাউন্টারের লোকজন এবং অন্যান্য বিভিন্ন সংস্থার লোকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, নব্য শ্রমিকদলের নেতা দেলোয়ার হোসেন দেলু বিমানবন্দর কেন্দ্রিক রেন্ট-এ-কার ব্যবসা দখল করার উদ্দেশ্যে অন্যান্য ব্যবসায়ীদের নামে মিথ্যা মামলা এবং বিভিন্ন লোকজন দিয়ে ব্যবসায়ীদের উপর হামলাসহ বিভিন্নভাবে হয়রানি করছে। দেলুর নিজেরও বিমানবন্দরে আবুল উলাইয়া রেন্ট-এ-কার, চাঁদপুর পরিবহন ও বিমানবন্দর মাইক্রো এন্ড টেক্সি সার্ভিস নামে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সে তার মিথ্যা মামলার কাগজ নিয়ে সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
শুধু তাই নয়, বিমানবন্দরের অন্যান্য রেন্ট-এ-কার ব্যবসায়ীদের সরকারি বিভিন্ন সংস্থা দিয়ে হয়রানি করাসহ তাদের নিকট মামলা থেকে নাম বাদ দেয়ার কথা বলে চাঁদাবাজি করছেন বলেও জানা গেছে।
দেলুর করা মামলায় আসামি হওয়া একজন জানান, দেলোয়ার হোসেন দেলু বিমানবন্দর থানা শ্রমিকলীগের নেতা ছিলেন। তিনি আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় বিমানবন্দর এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন। সরকার পতনের পর পর তিনি নিজেকে শ্রমিক দলের একজন দাবি করেন। সেই সঙ্গে আমাদের নামে মিথ্যা মামলা দিয়ে বিভিন্নভাবে হয়নি করছেন। এছাড়া তিনি মামলা থেকে নাম বাদ দেওয়ার জন্য আমাদের নিকট টাকাও দাবি করছেন।
দেলোয়ার হোসেন দেলুর এই মামলার ৭ নম্বর আসামি মাহাবুব হাওলাদার গণমাধ্যমকে বলেন, আমি শাহাজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ১৯৮৮ সাল থেকে পরিবহন ব্যবসা করে আসছি। শ্রমিকলীগ নেতা দেলোয়ারও এখানে ব্যবসা করেন। ২০১০ সালে তিনি শ্রমিকলীগের বিমানবন্দর থানার দপ্তর সম্পাদক হন। শ্রমিকলীগের পদ পাওয়ার পর থেকে তিনি পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি এবং দালালি করতেন বিমানবন্দর এলাকায়। তিনি ২০২৪ সালে মহানগর উত্তর শ্রমিকলীগের কার্যকরি সদস্য হন।
তিনি আরও বলেন, গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর দেলু নিজেকে শ্রমিকদলের কর্মী দাবি করে আমার কাউন্টারে হামলা চালিয়ে আমার কাউন্টারের স্টাফ এবং সুপারভাইজারের বিমানবন্দরের পাস সহ কাউন্টারের রিসিট বই নিয়ে যায় এবং কাউন্টার থেকে সুপারভাইজারকে বের করে দেয়। সেই সঙ্গে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন। দেলু বলেন, এখন থেকে এই কাউন্টার তিনি পরিচালনা করবে। আমি যদি তাকে কাউন্টার না দেই, তবে দেলু আমার নামে বিভিন্ন মামলা দেওয়ার ভয় দেখায়। তিনি দুইশত জনের মতন লোকের নাম লিস্ট করে মামলা করার জন্য পরে ১৬৬ জন ব্যক্তির নিকট টাকা নিয়ে বাকি ৩৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন।
এই মামলার এক নম্বর আসামি নুরুল ইসলাম বলেন, দেলোয়ার হোসেন দেলু কখনোই শ্রমিক দল করতেন না। তিনি শুরু থেকেই আওয়ামী লীগের রাজনীতি করে আসছেন। শ্রমিকলীগের কমিটিতে থেকে ৪৯নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর এবং ঢাকা মহানগর উত্তর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক আনিসুর রহমান নাঈমের সাথে বালুর ব্যবসা করতেন। সরকার পতনের পর পর আওয়ামী লীগের খোলস পাল্টে বর্তমানে তিনি শ্রমিক দলের কিছু সন্ত্রাসী বাহিনীর সাথে হাত মিলিয়ে বিমানবন্দর এলাকায় কাউন্টার দখল করতে মিথ্যা মামলা দিয়ে ব্যবসায়ীদেরকে হয়রানি করছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দেলোয়ার হোসেনে দেলু বলেন, আমি শ্রমিক দল করি। আমি কখনোই শ্রমিক লীগের সদস্য ছিলাম না। আমার নামে মিথ্যা কাগজপত্র তৈরি করে আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।
২০১০ সালে বিমানবন্দর থানা শ্রমিকলীগের দপ্তর সম্পাদক এবং ঢাকা মহানগর উত্তর শ্রমিক লীগের কমিটিতে পদে থাকতে দেখা গেছে, এ বিষয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভাই আমি আপনার সাথে সামনাসামনি বসে চা খাবো। এখন একটু ব্যস্ত আছি বলে ফোন কেটে দেন।
মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে বিমানবন্দর থানা অফিসার ইনচার্জ (ওসি) এরশাদ আহামেদ বলেন, মামলাটি বর্তমানে তদন্তাধীন। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা অভিযান পরিচালনা করে আসামিদের গ্রেপ্তারের জন্য চেষ্টা চালাচ্ছেন।
আপনার মতামত লিখুন :