ঢাকা বুধবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

উদ্ধার হয়নি পুলিশের লুণ্ঠিত ২০৬৬ আগ্নেয়াস্ত্র

শহিদুল ইসলাম রাজী

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৬, ২০২৪, ০১:১৭ এএম

উদ্ধার হয়নি  পুলিশের লুণ্ঠিত ২০৬৬ আগ্নেয়াস্ত্র

ছবি: সংগৃহীত

*অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে সর্বসাধারণের সহযোগিতা চেয়েছে পুলিশ
*অবৈধ অস্ত্রের জোগানদাতাদেরও খোঁজা হচ্ছে 
*হদিস মেলেনি ৩ লাখ ২০ হাজার ৬৬০টি গুলির


রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে চলছে যৌথ বাহিনীর অভিযান। বৈধ, অবৈধ ও থানা-ফাঁড়ি থেকে লুণ্ঠিত সব ধরনের অস্ত্র উদ্ধারে সশস্ত্র বাহিনীর সহায়তায় এ যৌথ অভিযান চলমান।

গত মঙ্গলবার থেকে অভিযান শুরু হলেও গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত কী পরিমাণ লুণ্ঠিত কিংবা অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, আসামি আটক বা গ্রেপ্তারের কোনো তথ্য জানানো হয়নি। তবে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে সর্বসাধারণের সহযোগিতা চেয়েছে পুলিশ। অবৈধ অস্ত্র-সংক্রান্ত কোনো তথ্য থাকলে জাতীয় জরুরি সেবা ট্রিপল নাইনে ফোন করে অথবা সংশ্লিষ্ট থানাকে অবহিত করতে অনুরোধ জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্যে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। দেশে তৈরি হয় অরাজক পরিস্থিতি। আন্দোলনে অনেক থানা ও পুলিশ ফাঁড়িতে ভাংচুর এবং আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। লুট করা হয় পুলিশের অস্ত্র গোলাবারুদ। আত্মগোপনে চলে যান ক্ষমতাচ্যুত সরকারের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী-এমপিসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও আওয়ামী লীগের নেতারা।

পুলিশের হিসাব অনুযায়ী, ৫ হাজার ৮২৯টি বিভিন্ন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র ও ৬ লাখ ৬ হাজার ৭৪২টি গুলি লুট হয়। এর মধ্যে সর্বশেষ গত ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৩ হাজার ৭৬৩টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার হয়। এখনো উদ্ধার হয়নি পুলিশের লুট হওয়া ২ হাজার ৬৬টি বিভিন্ন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, যৌথ বাহিনীর অভিযানে লুট হওয়া অস্ত্র যেমন উদ্ধারে গুরুত্ব দেওয়া হবে, তেমনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় ব্যবহৃত অবৈধ অস্ত্রেরও সন্ধান করা হবে। কারা এসব অস্ত্রের জোগানদাতা, খোঁজা হবে তাদেরও। এ ছাড়াও রাজনৈতিক পরিচয় বহনকারী সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ দুর্বৃত্তদেরও আইনের আওতায় আনা হবে যৌথ অভিযানে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা যায়, এবারের যৌথ অভিযান হবে মূলত জেলা ও শহরভিত্তিক। জেলা ম্যাজিস্ট্রেটরা (জেলা প্রশাসক) অভিযান সমন্বয় করবেন। মহানগর এলাকায় পুলিশ কমিশনাররা সংশ্লিষ্ট সব বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় অভিযান পরিচালনা করবেন। তাদের সার্বিক সহযোগিতায় থাকবে সশস্ত্র বাহিনী। উপকূলীয় অঞ্চলে সহযোগিতায় থাকবে কোস্টগার্ড। সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে স্থানীয় প্রশাসনের চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয়সংখ্যক বিজিবি সদস্য অভিযানে থাকবেন। জেলা প্রশাসনের চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয়সংখ্যক আনসার সদস্যও মোতায়েন থাকবে এ অভিযানে।

জানা গেছে, গত ২৫ আগস্ট ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত বেসামরিক জনগণকে দেওয়া আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স স্থগিত করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে গোলাবারুদসহ আগ্নেয়াস্ত্র সংশ্লিষ্ট থানায় জমা দিতে বলা হয়। এ ছাড়া এর আগে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স থেকে থানার লুণ্ঠিত অস্ত্র ও গোলাবারুদ ৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে জমা দিতে বলা হয়। নির্দিষ্ট তারিখের পরে কারও কাছে পুলিশের লুট হওয়া আগ্নেয়াস্ত্র পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও জানানো হয়। এরপর গত মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বুধবার রাত ১২টা থেকে যৌথ বাহিনীর অপারেশন শুরু হওয়ার ঘোষণা দেন।

পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স সূত্রে জানা গেছে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের প্রেক্ষাপটে রাজধানী ঢাকার কমপক্ষে ২০টি থানাসহ দেশের বিভিন্ন থানা ও ফাঁড়ি থেকে অন্তত ৫ হাজার ৮২৯টি বিভিন্ন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র লুট হয়। এর মধ্যে ৩ হাজার ৭৬৩টি বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। এখনো উদ্ধার হয়নি লুট হওয়া ২ হাজার ৬৬ আগ্নেয়াস্ত্র। এ ছাড়া ৬ লাখ ৬ হাজার ৭৪২টি গুলি লুট হয়। এর মধ্যে উদ্ধার হয়েছে ২ লাখ ৮৬ হাজার ৮২টি গুলি। এখনো উদ্ধার হয়নি ৩ লাখ ২০ হাজার ৬৬০টি গুলি।

পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ছাত্র আন্দোলনের সময় বিভিন্ন থানা ও ফাঁড়ি থেকে বিভিন্ন ধরনের টিয়ার গ্যাসের সেল লুট হয়েছে ৩১ হাজার ৪৪টি। এরমধ্যে উদ্ধার হয়েছে ২২ হাজার ১৩৯টি। এখনো উদ্ধার হয়নি ৮ হাজার ৯০৫টি টিয়ার গ্যাসের সেল। বিভিন্ন ধরনের টিয়ার গ্যাস গ্রেনেড লুট হয়েছে ১ হাজার ৪৫৫টি, উদ্ধার হয়েছে ৭০৪টি। উদ্ধার হয়নি ৭৫১টি। এছাড়া ৪ হাজার ৬৯২টি সাউন্ড গ্রেনেড লুট হয়। এরমধ্যে উদ্ধার হয়েছে ২ হাজার ১১৬টি, এখনো উদ্ধার হয়নি ২ হাজার ৫৭৬টি। কালার স্মোক গ্রেনেড লুট হয়েছে ২৯১টি। এরমধ্যে উদ্ধার হয়েছে ২১৩টি। এ ছাড়াও সেভেন/মাল্টিপল ব্যাংস্টন গ্রেনেড, ফ্ল্যাশ ব্যাং/৬ ব্যাং গ্রেনেড ও হ্যান্ড হেল্ড টিয়ার গ্যাস স্প্রে (ক্যানিস্টার) লুট হয়। এরমধ্যে কিছু উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। পুলিশ জানায়, এসব অস্ত্র দুর্বৃত্তদের হাতে রয়ে গেছে। এটি আইনশৃঙ্খলার জন্য বড় হুমকি হিসেবে দেখা হচ্ছে। বেশি অস্ত্র লুট হয়েছে সিরাজগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নরসিংদী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও খুলনা এলাকা থেকে।

পুলিশ সদর দপ্তর থেকে বলা হয়েছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় বিভিন্ন থানা ও ফাঁড়ি থেকে লুট হওয়া দুই হাজার ৬৬টি অস্ত্র এবং ৩ লাখ ২০ হাজার ৬৬০ রাউন্ড গুলি এখনো উদ্ধার হয়নি। লুট হওয়া অস্ত্রের মধ্যে ৭.৬২ বোরের রাইফেল আছে ১ হাজার ১৪৭টি। ৭.৬২ বোরের পিস্তল ১ হাজার ৫৫৬টি।

আন্দোলনের সময় সব মিলিয়ে পুলিশের। ৫ হাজার ৮২৯টি অস্ত্র ও ৬ লাখ ৬ হাজার ৭৪২ রাউন্ড গুলি লুট হয়েছে। অস্ত্র ছাড়াও ৩১ হাজার ৪৪ রাউন্ড টিয়ার গ্যাসের সেল, ৪ হাজার ৬৯২ রাউন্ড সাউন্ড গ্রেনেড লুট হয়। যেসব অস্ত্র উদ্ধার হয়নি তা নিয়ে বড় ধরনের অপরাধ সংঘটিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) একটি সূত্র জানিয়েছে, ঢাকার বিভিন্ন থানা, ফাঁড়ি থেকে পুলিশের ১ হাজার ৪৯৮টি আগ্নেয়াস্ত্র লুট হয়েছে। লুণ্ঠিত অস্ত্রসহ যেকোনো অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে যৌথ অভিযানের কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নের কৌশল নির্ধারণের ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে ডিএমপি হেডকোয়ার্টার্স। 

পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, ঘোষণা দেওয়া সত্ত্বেও ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত যেসব ব্যক্তিকে অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে মাত্র ৩০ শতাংশ অস্ত্র জমা হয়েছে। বাকি ৭০ শতাংশ যারা জমা দেননি, তাদের অস্ত্র অবৈধ হয়ে গেছে। এখন কারও কাছে ২০০৯ সালের পরের লাইসেন্স করা অস্ত্র-গুলি পাওয়া গেলে অস্ত্র আইনে মামলা হবে। এসব অস্ত্র দিয়ে ছাত্র-জনতার মিছিলে গুলি ও হামলার অভিযোগ রয়েছে।

গত ৬ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন এলাকায় লাইসেন্স করা অস্ত্র দিয়ে ছাত্র-জনতার ওপর গুলিবর্ষণ করতে দেখা যায়। যার পরিপ্রেক্ষিতে লাইসেন্স করা অস্ত্র থানায় জমা দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। গত সোমবার তার সময়সীমা শেষ হয়। এরপরই শুরু হয় যৌথ অভিযান।

পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর বলেন, (বুধবার) ১২টা থেকে অভিযান শুরু হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে কিছু আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার হয়েছে তার রেজাল্ট এখনো আসেনি। রেজাল্ট পাওয়া গেলেই জানিয়ে দেওয়া হবে।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল মো. মুনীম ফেরদৌস বলেন, যৌথ অভিযানের নির্দেশনা অনুযায়ী বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে বৈধ অস্ত্র, যেগুলো এখনো জমা পড়েনি। পুলিশের লুণ্ঠিত আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় ব্যবহৃত অবৈধ অস্ত্র। এ ছাড়াও অবৈধ অস্ত্রের জোগানদাতা এবং তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীরাও অভিযানের আওতায় থাকবে।

অস্ত্র উদ্ধারে সহায়তা চেয়েছে ডিএমপি চলমান যৌথ অভিযানে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের বিষয়ে সর্বসাধারণের সহযোগিতা চেয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। 

গতকাল ডিএমপির এক বিজ্ঞপ্তিতে এই সহযোগিতা চাওয়া হয়। এতে বলা হয়, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে পরিচালিত যৌথ অভিযানে পুলিশকে তথ্য দিয়ে সহায়তার অনুরোধ করেছে ডিএমপি। গতকাল বুধবার স্থগিতকৃত লাইসেন্সের অধীন থানায় জমা না হওয়া আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ এবং পুলিশসহ বিভিন্ন বাহিনী, সংস্থার বেহাত, হারানো অস্ত্রসহ সব ধরনের অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে যৌথ অভিযান শুরু হয়েছে। আপনার কাছে অবৈধ অস্ত্রের তথ্য থাকলে অনুগ্রহপূর্বক এ বিষয়ে পুলিশকে অবহিত করুন। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ এ মহানগরীকে অবৈধ অস্ত্রমুক্ত করতে বদ্ধপরিকর।

যেভাবে তথ্য প্রদান করা যাবে: আপনার কাছে অবৈধ অস্ত্র সংক্রান্তে কোনো তথ্য থাকলে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ এ ফোন করতে পারেন বা নিকটস্থ থানাকেও অবহিত করতে পারেন। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের হোয়াটস অ্যাপ নম্বরেও জানিয়ে দিতে পারেন। হোয়াটসঅ্যাপ নং: ০১৩২০-০৩৭৮৭০, ০১৩২০-০৩৭৮৭১

আরবি/জেডআর

Link copied!