ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

‘ইয়াবা সম্রাট’ বদি গ্রেপ্তারে স্বস্তিতে কক্সবাজার

মোস্তাফিজুর রহমান সুমন

প্রকাশিত: আগস্ট ২১, ২০২৪, ১০:০৯ পিএম

‘ইয়াবা সম্রাট’ বদি গ্রেপ্তারে স্বস্তিতে কক্সবাজার

আব্দুর রহমান বদি । ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা: কক্সবাজারের ইয়াবা শীর্ষ কারবারি সাবেক বিতর্কিত সংসদ সদস্য আব্দুর রহমান বদি র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) হাতে গ্রেপ্তার হওয়ায় স্বস্তিতে কক্সবাজার জেলা বাসিন্দারা। বদির সহযোগী ইয়াবা কারবারি এবং জেলার অন্য ইয়াবা গডফাদার-ব্যবসায়ীরা গ্রেপ্তার আতঙ্কে গাঢাকা দিয়েছে। বদির চার ভাইসহ পরিবাবের ২৬ সদস্য সরকারের মাদক তালিকায় নাম এসেছে। আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য হয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠে বদি। সারা দেশের মানুষ তাকে ইয়াবা বদি নামেই চেনে। আওয়ামী লীগ সরকারে শীর্ষ পর্যায়ের ‘শেল্টারে’ দুই দশক ধরে রাজত্ব কক্সবাজারসহ চট্টগ্রামের অঞ্চলের ইয়াবা তথা মাদক ব্যবসার। মিয়ানমার থেকে আসা ইয়াবার চালানের ৯০ ভাগ বদির সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে, এমনটাই গোয়েন্দা তথ্য।

বিভিন্ন সময় কক্সবাজার-টেকনাফ কেন্দ্রীক ইয়াবা সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উঠেছে সরকারি গোয়েন্দা প্রতিবেদনে। গণমাধ্যমগুলোতে দুই দশকে ভূরি ভূরি প্রতিবেদন প্রকাশ হলেও ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। যদিও বদির বিরুদ্ধে উঠা অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেন বারবার। আওয়ামী লীগের শেল্টারে দুই দশক রাজত্ব করেছেন শেখ হাসিনার আস্থাভাজন বিতর্কিত এই এমপি।

অবশেষে গত মঙ্গলবার রাতে চট্টগ্রাম জিইসি মোড় এলাকা থেকে গ্রেপ্তারের পর বদিকে গতকাল বুধবার কক্সবাজারের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম হামিমুন তামজিদের আদালতে হাজির করা হয় তাকে। এ সময় বিচারক তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। বদি কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও টেকনাফ পৌর আওয়ামী লীগ সভাপতি।

তবে চলতি বছরের ১৭ এপ্রিল আব্দুর রহমান বদির দুই ভাইয়ের সংশ্লিষ্টতা পায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। কক্সবাজারের ১০ মাদক গডফাদারের মামলা তদন্ত করতে গিয়ে তাদের সংশ্লিষ্টতা মিলেছে বলে জানায় সংস্থাটি। বদি তার প্রকাশ্য ব্যবসার আড়ালে ইয়াবা পাচারে জড়িত। আর তার সম্পদের একটি বড় অংশই আসে মিয়ানমার থেকে মাদক এনে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর এবং বেশ কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও বদিকে মাদকের গডফাদার হিসেবে চিহ্নিত করেছে একাধিকবার। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইয়াবার অন্য বড় পাচারকারী বা স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বদির মতের বিরুদ্ধে গিয়ে এই কাজ করতে পারবেন না। প্রতিবেদন অনুযায়ী বদির ভাই মুজিবুর রহমান ও আবদুল শুক্কুর এবং চাচাতো ভাই মং মং সেনও ইয়াবার গডফাদার। একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, কক্সবাজারে ইয়াবার ১২০ জন তালিকাভুক্ত পাচারকারী আছে। আর সবার আগে নাম আছে বদির।

কক্সবাজারের টেকনাফের ইয়াবা সাম্রাজ্য দীর্ঘদিন ধরে বদি ও তার পরিবারের নিয়ন্ত্রণে। নবম ও দশম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী হিসেবে কক্সবাজার-৪ (উখিয়া-টেকনাফ) আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হন বদি। দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হওয়ায় একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি তিনি।  তবে এ দুই নির্বাচনে তার স্ত্রী শাহীন আক্তার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে এমপি হন। মাদক চোরাকারবারে পৃষ্ঠপোষক হিসেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকায় বদির নাম আছে। এ তালিকায় গডফাদার হিসেবে বদির চার ভাইসহ পরিবারের অন্তত ২৬ জনের নাম রয়েছে।  গত মে মাসে নির্বাচনী বিরোধের জের ধরে টেকনাফ উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান নুরুল আলমকে লক্ষ্য করে গুলি করার অভিযোগ ওঠে বদির বিরুদ্ধে।  এই ঘটনায় জিডি করেছিলেন নুরুল আলম।

মিয়ানমার থেকে দেশে ইয়াবা আনার অন্যতম রুট টেকনাফ। অভিযোগ রয়েছে, বদির পৃষ্ঠপোষকতায় ইয়াবা কারবার চলত। বদির ভাই ও আত্মীয়স্বজন নিয়ন্ত্রণ করেন ইয়াবা আনার রুট। ক্ষমতার প্রভাবে ইয়াবা গডফাদাররা সব সময় থাকেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা, পুলিশ প্রশাসন, বিজিবি, কোস্টগার্ড, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকায় নাম এলেও তারা প্রকাশ্যে ইয়াবার রাজ্যে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। ইয়াবা কারবারিরা এতটাই প্রভাবশালী, আইনশৃঙ্খলা কমিটির বৈঠকে বিষয়টি তুলতেও কেউ সাহস করেন না। 

২০০২ সালে টেকনাফ পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হন বদি। ২০০৮ সালে কক্সবাজার-৪ আসনে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। জনপ্রতিনিধি হওয়ার ২৩ দিনের মাথায় টেকনাফ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রের সহকারী প্রিসাইডিং অফিসারকে মারধর করেন। তার হাতে হেনস্তার শিকার হন টেকনাফের বন বিভাগের কর্মকর্তা। ভোটার তালিকা তৈরা করাকে কেন্দ্র করে একজন স্কুল শিক্ষক তার হাতে নির্যাতনের শিকার হন। এর পর জড়িয়ে পড়েন টেন্ডারবাজি, জমি দখল, চাঁদাবাজিতে। 

২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে কক্সবাজার-৪ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে সংসদ সদস্য হন তিনি। এর পর থেকে চোরাচালান, ইয়াবা কারবার, মানব পাচারসহ রোহিঙ্গা আশ্রয়-প্রশ্রয় নিয়ে জড়ান নানা অপকর্মে। ইয়াবাকাণ্ডে বদিকে নিয়ে বিতর্ক উঠলে পরের নির্বাচনে ওই আসনে তার স্ত্রী শাহীন আক্তারকে মনোনয়ন দেয় আওয়ামী লীগ। এমপি থাকার সময়ে ১০ বছর নানাভাবে আলোচিত-সমালোচিত নাম আবদুর রহমান বদি। ভাই, স্ত্রী, মামা, ভাগিনাসহ স্বজনদের নিয়ে ইয়াবা ব্যবসার অভিযোগেই বেশি সমালোচিত তিনি। এমনকি অবৈধ সম্পদের অভিযোগে দুদকের করা দুর্নীতির মামলায় সাজাও হয়। অভিযোগ আছে, টেকনাফের ইয়াবা নিয়ন্ত্রণ করে বদির পরিবারই। বদির পরিবারের ইয়াবা সিন্ডিকেট সদস্যরা হলেন এমপি বদির আপন ভাই মো. আবদুল শুক্কুর, মজিবুর রহমান ওরফে মুজিব কমিশনার, শফিকুল ইসলাম, সৎভাই আবদুল আমিন, ফয়সাল রহমান, ভাগিনা আবদুর রহমান দারোগার ছেলে নিপু, শাহেদ কামাল, এমপির মামা হায়দার আলী ও এমপির মামাতো ভাই কামরুল ইসলাম রাসেল। তারাই পুরো টেকনাফ স্থলবন্দর দখল করে রাজত্ব করেন। এ ছাড়া ইয়াবা পাচারে ব্যবহৃত গাড়ির তালিকায়ও রয়েছে বদি পরিবারের গাড়ির নাম। এদিকে বদিকে গ্রেপ্তারের খবরে টেকনাফের মানুষের মাঝে স্বস্তি ফিরেছে। মুহূর্তে এ খবর সীমান্তজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।

টেকনাফের বাসিন্দা মোহাম্মদ আবদুল্লাহ বলেন, ‘বদি ইয়াবা সম্রাট। তার কারণে দেশজুড়ে মাদক ছড়িয়ে পড়ে। বদি এবং তার স্ত্রী এমপি থাকাকালীন প্রভাব খাটিয়ে শতকোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। বিশেষ করে মাদক চোরাচালান ও স্বর্ণ পাচারে জড়িত ছিলেন দীর্ঘদিন। বদি অবৈধ টাকায় দেশে-বিদেশে বিপুল পরিমাণ সম্পদ গড়েছেন। 

বদি ১৯৯৬ সালে বিএনপির মনোনয়ন চেয়েছিলেন। পরে ২০০৮ সালে তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান। ওই বছর মনোনয়নপত্রের সঙ্গে জমা দেওয়া হলফনামায় বদি জানান, তিনি বাড়ি ও দোকান ভাড়া থেকে বছরে এক লাখ ৭৬ হাজার টাকা, সঞ্চয়পত্র ও শেয়ার থেকে ৯১ হাজার ৯৮ টাকা এবং ৩৩ হাজার ৬০০ টাকা আয় করেন লবণ মাঠ থেকে। অর্থাৎ তার বার্ষিক আয় তিন লাখ টাকার কম ছিল সে সময়। সে সময় তিনি জানান, তার ওপর নির্ভরশীলরা বছরে দুই লাখ ২৫ হাজার টাকা আয় করেন।

তবে ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে বদি জানান, তিনি কৃষি থেকে চার হাজার ৬৫০ টাকা, বাড়ি ও অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া থেকে দুই কোটি আট লাখ, ব্যবসা থেকে পাঁচ কোটি ৩২ লাখ, সঞ্চয়পত্র ও শেয়ার থেকে আট কোটি পাঁচ লাখ এবং লবণের মাঠ থেকে ৯১ হাজার টাকা আয় করেন বছরে।

এই হিসাবে তখন বদির বছরে আয় দাঁড়ায় ১৫ কোটি ৪৬ লাখ টাকা এবং তার ওপর নির্ভরশীলদের আয় দাঁড়ায় তিন কোটি ৪৮ লাখ টাকা। এই আওয়ামী লীগ নেতা ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নেননি। তার স্ত্রী শাহীন আক্তার পান আওয়ামী লীগের মনোনয়ন।

আরবি/জেডআর

Link copied!