রূপালী প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ৪ জুন, ২০২৪, ০৪:১১ পিএম

অনলাইন সংস্করণ

ভাড়াটিয়া ছদ্মবেশে নারীদের স্বর্ণালংকার হাতিয়ে নিতেন তারা

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

দেশের বিভিন্ন এলাকায় ভাড়াটিয়া ছদ্মবেশে বাসায় প্রবেশ করে অভিনব কায়দায় প্রতারণার মাধ্যমে নারীদের স্বর্ণালংকারসহ মূল্যবান সামগ্রী হাতিয়ে নেয়া প্রতারক চক্রের অন্যতম মূলহোতাসহ দুজনকে নরসিংদী থেকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব।

গ্রেপ্তারকৃতরা হল- মো. আলী হাসান সোহেল (৫৫) ও মোছা. সালমা (৫৩)। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় একটি স্বর্ণের চেইন, দুটি স্বর্ণের কানের দুল, একটি ইমিটেশন নেকলেস, প্লাস্টার মোম, দুটি মোবাইল এবং নগদ ৫০০ টাকা।

রাজধানীর কারওয়ান বাজার র‍্যাব মিডিয়া সেন্টারে মঙ্গলবার আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান র‍্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার আরাফাত ইসলাম।

তিনি বলেন, গত ৩০ এপ্রিল খুলনার বানরগাতী এলাকার একটি বাড়ি থেকে ভাড়াটিয়া সেজে বাড়ির মালিকের স্ত্রীকে কৌশলে স্বর্ণালংকারসহ মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে যায়। এ ঘটনায় ভুক্তভোগীর স্বামী খুলনার সোনাডাঙ্গা থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন।

এছাড়াও কমিল্লা, নরসিংদী, চট্টগ্রাম, যশোর, খুলনা ও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ভাড়াটিয়া সেজে বাড়ির নারীদের সঙ্গে সখ্যতা তৈরি করে অভিনব কায়দায় তাদের কাছ থেকে স্বর্ণালংকার, টাকা-পঁয়সাসহ মূল্যবান জিনিসপত্র হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনা পরিলক্ষিত হয়।

চাঞ্চল্যকর এমন একাধিক ঘটনায় দেশের বিভিন্ন এলাকার সাধারণ জনগণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। র‌্যাব ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তারের লক্ষ্যে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে। গতকাল সোমবার রাতে র‌্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র‌্যাব-১১ যৌথ আভিযানিক দল নরসিংদী জেলার সদর থানাধীন বাসাইল এলাকায় অভিযান চালিয়ে খুলনার বানরগাতী এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভাড়াটিয়া সেজে নারীদের সম্মোহন করে অভিনব কায়দায় তাদের কাছ থেকে স্বর্ণালংকারসহ মূল্যবান সামগ্রী হাতিয়ে নেয়া প্রতারক চক্রের অন্যতম মূলহোতাসহ দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার আরাফাত ইসলাম বলেন, ভুক্তভোগীর স্বামী আব্দুর রহমানের খুলনার বানরগাতী এলাকায় পঞ্চমতলা একটি বাড়ি রয়েছে। বাড়ির একটি রুম ভাড়া দেওয়ার বিজ্ঞপ্তি দেখে গত ২৮ এপ্রিল স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে দুজন এসে বাসা ভাড়া নেওয়ার কথা বলে। পরবর্তীতে গ্রেফতার আলী হাসান সোহেল জানায়, তিনি দীর্ঘ দিন প্রবাসে ছিলেন এবং বর্তমানে খুলনার মোহাম্মদ নগরে বাড়ি নির্মাণ করবেন এজন্য কয়েক মাসের জন্য বাসা ভাড়া নিয়ে থাকবে।

তিনি বলেন, পরবর্তীতে বাসা ভাড়া চূড়ান্ত করে অগ্রিম ভাড়া বাবদ ২ হাজার টাকা প্রদান করে চলে যায়। ঘটনার দিন সকালে গ্রেফতার আলী হাসান সোহেল তার সহযোগী গ্রেফতার সালমাকে নিয়ে ভুক্তভোগীর ভবনের ৩য় তলায় আসেন। এসময় তাদের হাতে প্লাস্টিকের বালতিতে কিছু মাছ ও টুল ছিল। বাড়িতে এসে গ্রেফতাররা ভুক্তভোগীকে জড়িয়ে ধরে খুব আন্তরিকতার সঙ্গে কুশলাদি বিনিময় করতে থাকে।

এসময় ভুক্তভোগীর স্বামী রুমের ভেতরে প্রবেশ করলে গ্রেফতার আলী হাসান সোহেলের কথিত স্ত্রীর কৌশলে ভুক্তভোগীর ৫ম তলার একটি রুমে নিয়ে গিয়ে ভুক্তভোগীর গলায় ও হাতে থাকা স্বর্ণালংকার পরিস্কার করে দেয়ার কথা বলে কৌশলে তা খুলে নিয়ে দ্রুত পালিয়ে যায়।

একই কৌশলে খুলনার খালিশপুর, দৌলতপুর ও পশ্চিম বানিয়াখামার, কুমিল্লা, নরসিংদী, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় গ্রেফতাররা বাসা ভাড়া নেওয়ার কথা বলে এসে বাড়ির নারীদের সঙ্গে সখ্যতা তৈরি করে কৌশলে স্বর্ণালংকার, টাকা-পঁয়সাসহ মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে পালিয়ে যায়।

তিনি আরও বলেন, এছাড়াও গ্রেপ্তাররা যশোর ও চট্টগ্রামে একই কৌশলে প্রতারণার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল। এভাবে দেশের বিভিন্ন এলাকায় স্বর্ণলাংকারসহ মূল্যবান জিনিসপত্র হাতিয়ে নেওয়ার একাধিক চক্র তাদের যোগসাজশে এই প্রতারণার কাজগুলো করতো।

কমান্ডার আরাফাত বলেন, গ্রেপ্তার আলী হোসেন চক্রটির মূলহোতা। এই চক্রের সদস্য সংখ্যা ৭/৮ জন। আলী হাসান ও তার মামী ৩-৪ বছর ধরে অভিনব কায়দায় মানুষের কাছ থেকে স্বর্ণালাংকার, টাকা-পঁয়সাসহ মূল্যবান জিনিসপত্র হাতিয়ে নিয়ে আসছে। গ্রেপ্তাররা বাসা ভাড়ার বিজ্ঞপ্তি দেখে বিভিন্ন বাসায় গমন করে এবং স্বর্ণালংকার পরিহিত নারীদের টার্গেট হিসেবে নির্বাচন করে। গ্রেপ্তাররা বাড়ি ভাড়ার অগ্রিম টাকা দিয়ে যাওয়ার কিছু দিন পরে বাসায় নারিকেল, দুধ, তাজা মাছ, ফলমূলসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র উপহার হিসেবে নিয়ে আসে। এগুলো তাদের নিজের গ্রামের বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছে বলে ভুক্তভোগীদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে সখ্যতা তৈরি করে।

পরবর্তীতে স্বর্ণালংকার পরিষ্কার করে দেয়ার নাম করে ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে অলঙ্কার নিয়ে শুরুতেই গ্রেপ্তাররা প্লাস্টার মোম দিয়ে গ্রেপ্তারকৃতদের কাছে থাকা ইমিটেশনের স্বর্ণালংকার পরিষ্কারের অভিনয় করে এবং তাদের স্বর্ণের দোকান আছে বলে ভুক্তভোগীদের জানায়।

তিনি বলেন, একটি বালতিতে রিঠা ফল ভেজানো ফেনাযুক্ত পানিতে একটি প্লাস্টার মোমের দলা রাখা থাকে যা ফেনার জন্য ভুক্তভোগীরা দেখতে পায় না। পরবর্তীতে অনুরূপ অন্য একটি প্লাস্টার মোমের দলার মধ্যে ভুক্তভোগীদের স্বর্ণালংকার গুলো ঢুকিয়ে পরিষ্কারের কথা বলে এই দলাটিও একই বালতিতে রেখে দেয়।

র‍্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক আরও বলেন, কিছুক্ষণ পরে বালতিতে আগে থেকে রাখা ফাঁকা দলাটি তুলে একটি বাটিতে রেখে ঢাকনা লাগিয়ে ভুক্তভোগীদের ফ্রিজে রাখতে বলে। সঙ্গে এ কথাও বলে দেয় যে, আধা ঘন্টার আগে এই বাটি খোলা যাবে না, কেননা এর ভেতরে এসিড পানি আছে। পরবর্তীতে গ্রেপ্তাররা এসিড মিশ্রিত বালতির পানি বাইরে ফেলে দেওয়ার নাম করে স্বর্ণসহ প্লাস্টারের দলা নিয়ে ঘটনাস্থল থেকে কৌশলে পালিয়ে যায়।

এছাড়াও গ্রেপ্তাররা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে যেন তাদেরকে চিনতে না পারে সেজন্য তারা বোরকা এবং মুখে মাস্ক ব্যবহার করতো। একই কৌশলে ৩ জুন নরসিংদীর বাসাইল এলাকার একটি বাড়িতে স্বর্ণালংকার চুরি করে পালানোর সময় চুরি করা স্বর্ণালংকারসহ তারা র‌্যাব-১১ কর্তৃক হাতেনাতে গ্রেপ্তার হয়।

গ্রেপ্তার আলী হোসেন একজন স্বর্ণকার এবং সালমা তার অন্যতম সহযোগী। আলী হোসেন এর আগে আশুলিয়ায় একটি স্বর্ণের দোকান ছিল। তিনি ৩-৪ বছর ধরে বিভিন্ন জায়গায় এই প্রতারণার কাজ করে আসছে।

এ সকল প্রতারক চক্র দেশের বিভিন্ন এলাকায় ভাড়াটিয়া সেজে নারীদের সরলতার সুযোগ নিয়ে তাদের সঙ্গে সখ্যতা তৈরি করে অভিনব কায়দায় প্রতারণার মাধ্যমে স্বর্ণালংকারসহ মূল্যবান সামগ্রী হাতিয়ে নিতো।

র‍্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, এসকল প্রতারক চক্র থেকে আপনারা সর্তক থাকবেন এবং প্রতারিত হবেন না। যারা বাড়ি ভাড়া দিয়ে থাকেন তারা অবশ্যই ভাড়াটিয়াদের জাতীয় পরিচয়পত্র যাচা-বাচাই করে বাড়ি ভাড়া দিবেন, অন্যথায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করা হলো।

মন্তব্য করুন