রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) অকার্যকর গত ৩৪ বছর ধরে। এর ফলে অধিকার আদায় ও মেধা বিকাশে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর নতুন করে বিষয়টি সামনে এসেছে। ক্যাম্পাসের চায়ের দোকান থেকে সর্বত্রই চলছে রাকসু কার্যকর করা নিয়ে নানা আলোচনা।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, ইতিপূর্বে ক্ষমতায় থাকা সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠন ক্যাম্পাসে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করে সিট বাণিজ্য ও দখলদারিসহ নানা অপকর্মে লিপ্ত ছিল। সাধারণ শিক্ষার্থীদের সুবিধা-অসুবিধা দেখা বা মেধা বিকাশে সৃজনশীল কোন কার্যক্রম ছিল না। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাকসুকে সত্যিকার অর্থে কার্যকর করে শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধা ও মেধা বিকাশের ক্ষেত্র হিসেবে গড়ে তোলা প্রয়োজন।
জানা গেছে, রাবি প্রতিষ্ঠার পর প্রথম রাকসুতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৫৬- ৫৭ মেয়াদে। ওই সময় নাম ছিল রাজশাহী ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (রাসু)। মাঝখানে আইয়ুব খানের শাসনামলে এর কার্যক্রম বন্ধ থাকার পর ১৯৬২ সালে এটি যাত্রা শুরু করে রাকসু নামে। এখন পর্যন্ত ১৪ বার রাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৭০ থেকে ১৯৭২ সাল কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। পরে সামরিক শাসনামলে ১৯৭৫ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত এবং ১৯৮১ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত বন্ধ ছিল এই ছাত্র সংসদের নির্বাচন। সর্বশেষ রাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৮৯-৯০ মেয়াদের জন্য। অর্থাৎ দীর্ঘ ৩৪ বছর ধরে বন্ধ রয়েছে রাকসুর কার্যক্রম।
দ্রুততম সময়ের মধ্যে রাকসু সচলের দাবি জানিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। এ বিষয়ে রাবি সংসদের সমন্বয়ক মাসুদ রানা বলেন, রাকসু কার্যকর করা শিক্ষার্থীদের প্রাণের দাবি। ক্যাম্পাসে যেন অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি না হয় এবং ছাত্রদের অধিকার আদায়ের সুষ্ঠু ধারা সৃষ্টি হয় এজন্য রাকসু কার্যকর কোন বিকল্প নেই। প্রশাসন পুরোপুরি সচল হওয়ার পরে প্রথম দাবি হবে অবিলম্বে রাকসু কার্যকর করা।
বিশ্ববিদ্যালয় শাখা জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সদস্য সচিব মাহমুদুল মিঠু বলেন, আমরা রাকসু সচল করার পক্ষে। এখানে শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিরা নেতৃত্ব দিক এটা আমরা চাই। আমরা ২০১৯ সালে ডাকসু চালু হওয়ার পরে আন্দোলন করেছি রাকসুর দাবিতে। আমরা প্রশাসনকে তিনবার স্মারকলিপি দিয়েছিলাম।
বিগত দিনে যারা রাকসুতে নেতৃত্ব দিয়েছেন তারা এখন বড় রাজনৈতিক দলগুলোর কেন্দ্রীয় নেতা। তারা এমপি-মন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করছেন। এটা রাজনীতির পাঠাগার। এই পাঠাগার থেকে একটা সুষ্ঠু ধারার রাজনীতি হোক।
রাকসুর ১৯৮৮-৮৯ মেয়াদের সহ-সভাপতি (ভিপি) রাগীব আহসান মুন্না বলেন, রাকসু শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৭৩ সালে অর্ডিন্যান্সের বিধান না, এটা রাজনীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার মাধ্যম। বর্তমানে নতুন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে এবং সংস্কারের মধ্য দিয়ে বৈষম্যবিরোধী সমাজের কথা বলা হচ্ছে। ছাত্র রাজনীতিকে কল্যাণমূখী, মেধাভিত্তিক ও যুক্তির অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠানগুলোতে দাঁড় করানো প্রয়োজন। আমি মনে করি, সময় এসেছে। ছাত্রদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সাথে কথা বলে রাকসু চালু করা দরকার।
অবিলম্বে রাকসু নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন রাবির আরবি বিভাগের ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী নুরুল্লাহ আলম নুর। তিনি বলেন, রাকসু দীর্ঘদিন অচল থাকায়, আমাদের দাবিদাওয়া ও যৌক্তিক আন্দোলনগুলোতে সঠিক প্রতিনিধিত্ব পাচ্ছি না। যদি রাকসু সক্রিয় থাকত, তাহলে জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের স্বার্থ আরও সুসংগঠিতভাবে উপস্থাপন করা যেত। নতুন উপাচার্যের কাছে প্রধান চাওয়া হলো, দ্রুত রাকসু নির্বাচন আয়োজন করা এবং শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাপত্তা এবং সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের নবনিযুক্ত উপাচার্য অধ্যাপক ড. সালেহ্ হাসান নকীব বলেন, রাকসু নিয়ে আমরা অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে চিন্তা করছি। একটা প্রক্রিয়া শুরু করব যত দ্রুত সম্ভব।
জুলাই বিপ্লবে ছাত্রদের যৌক্তিক অধিকারের আন্দোলনে ছাত্রলীগ, বহিরাগত, পুলিশ, বিজিবি ও র্যাবের হামলার স্বীকার হয় শিক্ষার্থীরা। এরই মাঝে সরকার থেকে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণা আসে।
এ সময় ছাত্র আন্দোলন দমাতে স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় গুলো বন্ধ এবং অনির্দিষ্টকালের জন্য হলত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হয়। এই নির্দেশের প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা ক্ষোভে ফেটে পড়লেও তাদের হলত্যাগে বাধ্য করা হয় এবং দমননীতি অবলম্বন করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসন। যদি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে আইন অনুযায়ী ছাত্রদের প্রতিনিধিত্ব থাকত তাহলে এমন একপেশে সিদ্ধান্ত আসতে পারত না বলে মনে করেন শিক্ষার্থীরা। পরবর্তীতে শিক্ষার্থীরা সরকারকে ৯ দফা দাবি দেয়।
তার ভিতর অন্যতম ছিল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দলীয় লেজুড়ভিত্তিক ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করে ছাত্র সংসদ সচল করা।
আপনার মতামত লিখুন :