ঢাকা সোমবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

শিক্ষাজীবন নিয়ে হুমকির মুখে ছাত্রলীগ, ধোঁয়াশায় প্রশাসন

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৩০, ২০২৪, ০১:০১ পিএম

শিক্ষাজীবন নিয়ে হুমকির মুখে ছাত্রলীগ, ধোঁয়াশায় প্রশাসন

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

আওয়ামী সরকারের শাসনকালে সবচেয়ে আলোচিত-সমালোচিত দলটির ভ্রাতৃপ্রতীম ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ। সর্বশেষ কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার বড় অভিযোগ রয়েছে সংগঠনটির বিরুদ্ধে। এর পরই গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর থেকে ক্যাম্পাসছাড়া ছাত্রলীগ। সংগঠনটির নেতাকর্মদের মধ্যে কেউ কেউ গ্রেপ্তার হলেও আত্মগোপনে রয়েছেন অনেকে। সাহস পাচ্ছেন না নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরতে। এর মধ্যে রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের সাবেক তিন নেতাকর্মীকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় আরও বেশি আতঙ্কগ্রস্ত নেতাকর্মীরা। পড়াশোনা শেষ না হওয়া বহু ছাত্রলীগ নেতাকর্মী এখন শিক্ষাজীবন নিয়ে শঙ্কায়। তারা নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকারের দাবিও তুলছেন।

তবে গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও সক্রিয় অন্য ছাত্রসংগঠনের নেতারা বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের ভাষ্য, ‘যাদের হাতে শিক্ষার্থীদের রক্ত ঝরেছে, যাদের হামলায় নিহত, আহত, পঙ্গুত্ববরণ করেছেন শিক্ষার্থীরা, তাদের ক্যাম্পাসে ফেরার নৈতিক অধিকার নেই।’

এদিকে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছেন, যারা অপরাধ করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। একাডেমিক শাস্তির পাশাপাশি প্রয়োজনে ফৌজদারি আইনে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষই মামলা করবে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের আইন হাতে তুলে নেওয়া ঠিক হবে না।

জানা গেছে, দেশে চালু থাকা ৫৪টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে অন্তত ৪৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের সক্রিয় কমিটি ছিল। পাশাপাশি বেসরকারি প্রায় ৭৫টি বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্তত ১ হাজার ২০০ সরকারি-বেসরকারি কলেজে ছাত্রলীগের কমিটি রয়েছে। শুধু কমিটিতে জায়গা পাওয়া নেতার সংখ্যাই কয়েক লাখ।

এখানে কোনো ছাড় নয়। যারা অপকর্ম করেছে, তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। তাদের হাতে এখনো রক্তের দাগ। আগে বিচার হবে। পরে তাদের ক্লাসে ফেরার অধিকার নিয়ে ভাবা যাবে। - সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ

ছাত্রলীগের নেতৃত্বে থাকা অনেকের ছাত্রজীবন শেষ আবার কারও ছাত্রজীবন শুরু। ফলে তাদের শিক্ষাজীবন বা পড়ালেখা শেষ করা নিয়ে ব্যাপক সংশয় দেখা দিয়েছে।

নিরাপত্তা চাইলেও ‘আশা দেখছে না’ ছাত্রলীগ

সরকার পতনের পর নিজ বাড়িতেও থাকছেন না অধিকাংশ নেতা। ধাক্কা সামলে সবাই ধীরে ধীরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছেন। ক্যাম্পাসে নির্যাতনের প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তোফাজ্জল হত্যাকাণ্ডের পর ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বরাতে গণমাধ্যমে বিবৃতিও পাঠানো হয়।

শিক্ষার্থী হিসেবে সবারই ক্লাস ও পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার অধিকার রয়েছে।

যারা অপরাধ করেছে, তাদের জন্য আইন আছে। অনেক ছাত্রলীগ নেতা এ

আন্দোলনে কোনো হামলায় অংশ নেয়নি। তারপরও তাদের দায় নিতে হচ্ছে।

আমরা নিরাপত্তার দাবি জানাচ্ছি। কিন্তু সেভাবে কোনো আশ্বাস মিলছে না।

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সবশেষ কমিটির উপ-দপ্তর সম্পাদক শিহাব উদ্দিন

ছাড় না দেওয়ার পক্ষে সব ছাত্রসংগঠনগুলো

ক্যাম্পাসে সহাবস্থান চেয়েও পায়নি ছাত্রদল। গোপনে থাকতে বাধ্য হয়েছে ছাত্রশিবির। বাম ছাত্র সংগঠনগুলো সকাল-বিকাল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের হাতে মার খেয়েছেন, লাঞ্ছিত, অপমানিত হয়েছেন। সরকার পতনের পর সবাই ভিন্ন ভিন্ন মতাদর্শের পক্ষে তর্কে জড়ালেও ছাত্রলীগ প্রশ্নে প্রায় সবাই একমত।

‘ছাত্রলীগ হত্যা, নির্যাতন করেছে। চাঁদাবাজি-দখলের রাজত্ব করেছে।

সাধারণ শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে এসব খুনি, চাঁদাবাজ ও নির্যাতনকারীদের

দেখতে চায় না। ছাত্রলীগ প্রশ্নে সাধারণ শিক্ষার্থীদের যে অবস্থান,

ছাত্রদলেরও একই অবস্থান। তাদের একাডেমিক শাস্তি ও আইন

অনুযায়ী বিচার দুটোই চাই আমরা।

 

জানতে চাইলে ঢাবি ছাত্রদলের সভাপতি গণেশ চন্দ্র রায় সাহস 

ঢাবি ছাত্রশিবিরের সভাপতি সাদিক কায়েম বলেন, ‘আমাদের নেতাকর্মীরা আইন হাতে তুলে নেওয়ার মতো অপরাজনীতিতে বিশ্বাস করে না। তবে ফ্যাসিস্টদের রুখতে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে থেকে কাজ করবে শিবির।’

ছাত্রদল ও শিবির এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন

ছাত্রদল ও শিবিরের মতো প্রায় একই অবস্থান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের। সংগঠনটির অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ এক গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এখানে কোনো ছাড় নয়। যারা অপকর্ম করেছে, তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। তাদের হাতে এখনো রক্তের দাগ। আগে বিচার হবে। পরে তাদের ক্লাসে ফেরার অধিকার নিয়ে ভাবা যাবে।’

কেউ ক্যাম্পাসে এলে মারধর করার ব্যাপারে আমরা শিক্ষার্থীদের নিরুৎসাহিত করছি। কারও অপরাধ থাকলে তাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হবে। আবার অপরাধীরা হঠাৎ ক্যাম্পাসে এসে যাতে বিশৃঙ্খল কিছু না ঘটাতে পারে, সেজন্য সতর্কও থাকবে প্রশাসন।- ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অবস্থান ধোঁয়াশা

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যে গণহত্যা চালানো হয়েছে, তাতে অন্যতম সহযোগী ছিল ছাত্রলীগ। ফলে তাদের ক্যাম্পাসে ফেরা ও ক্লাস-পরীক্ষায় বসতে দেওয়ার ব্যাপারে অন্য ছাত্রসংগঠন ও শিক্ষার্থীদের কঠোর অবস্থানের কারণে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও অস্পষ্ট অবস্থানে। তবে শিক্ষার্থীসহ সবার প্রতি তারা আহ্বান জানান, যাতে কেউ আইন হাতে তুলে না নেয়।

কেউ ক্যাম্পাসে এলে মারধর করার ব্যাপারে আমরা শিক্ষার্থীদের নিরুৎসাহিত করছি। কারও অপরাধ থাকলে তাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হবে। আবার অপরাধীরা হঠাৎ ক্যাম্পাসে এসে যাতে বিশৃঙ্খল কিছু না ঘটাতে পারে, সেজন্য সতর্কও থাকবে প্রশাসন।

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান 

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ হাসান নকীব বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বা তার আগে ছাত্রলীগের নাম ব্যবহার করে কারা শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতন চালিয়েছে, শৃঙ্খলাবিরোধী কাজ করেছে, তা খতিয়ে দেখার উদ্যোগ নিয়েছি। অভিযোগগুলো তদন্ত করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা কমিটির মাধ্যমে জড়িতদের প্রমাণ পাওয়া গেলে একাডেমিকভাবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

এদিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) প্রক্টর অধ্যাপক এ কে এম রাশিদুল আলম বলেন, ‘সব শিক্ষার্থীর ক্যাম্পাসে আসার অধিকার আছে। আবার ক্যাম্পাস কিন্তু অপরাধীদের জন্য নয়। এজন্য অপরাধে জড়িতরা ক্যাম্পাসে এসে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করলে প্রশাসন ব্যবস্থা নেবে।’

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. রেজাউল করিম অবশ্য আশাবাদী রেখে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত জবিতে এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। শিক্ষার্থীরা অপরাধে জড়িতদের চিহ্নিত করে প্রশাসনকে জানালে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

‘শিক্ষার্থী অপরাধী হলেও নিরাপত্তা দেওয়া উচিত’

শিক্ষার্থী কোনো অপরাধে জড়িয়ে পড়লেও নিরাপত্তা পাওয়া তার অধিকার বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। 

তিনি বলেন,

বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ছাত্রদের অপরাজনীতি, অপরাধে জড়িয়ে পড়া আমাদের দেশে নতুন কিছু নয়। কেউ অপরাধে জড়ালে তার দুদিক থেকে শাস্তি হতে পারে। প্রথমত বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সাময়িক বহিষ্কার, ছাত্রত্ব বাতিল অথবা স্বল্প মেয়াদে বহিষ্কার করতে পারে। দ্বিতীয়ত ফৌজদারি আইনে তার নামে মামলা হতে পারে সেটা আদালতে বিচার হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ছাত্রদের অপরাজনীতি, অপরাধে জড়িয়ে পড়া আমাদের দেশে নতুন কিছু নয়। কেউ অপরাধে জড়ালে তার দুদিক থেকে শাস্তি হতে পারে। প্রথমত বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সাময়িক বহিষ্কার, ছাত্রত্ব বাতিল অথবা স্বল্প মেয়াদে বহিষ্কার করতে পারে। দ্বিতীয়ত ফৌজদারি আইনে তার নামে মামলা হতে পারে সেটা আদালতে বিচার হবে।-অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

কিন্তু সে ক্যাম্পাসে গেলে তাকে নিরাপত্তা দিতে গড়িমসি করাটা হবে প্রশাসনের ভুল। অবশ্যই সে নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকার রাখে। এমনকি জেলে বসেও পরীক্ষা দেওয়ার অধিকার আছে।’

আরবি/জেআই

Link copied!