প্রিয় পাঠক, আজ আমরা আলোচনা করবো এমন একটি বিষয়, যা আপনার ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার সাথে সরাসরি জড়িত। আমরা কথা বলবো সর্বজনীন পেনশন সুবিধা ও অসুবিধা সম্পর্কে। এই স্কিমটি বাংলাদেশ সরকারের একটি উদ্যোগ, যার মাধ্যমে দেশের ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী সকল নাগরিককে পেনশনের সুবিধা দেওয়া হবে। কিন্তু এটি কীভাবে কাজ করে? এর সুবিধা কী, এবং কী কী চ্যালেঞ্জ রয়েছে? চলুন, আমরা একসাথে এই বিষয়টি বিস্তারিতভাবে জানি।
সর্বজনীন পেনশন স্কিম: এটি কী এবং কেন গুরুত্বপূর্ণ?
সর্বজনীন পেনশন স্কিম (UPS) বাংলাদেশ সরকারের একটি উদ্যোগ, যা ২০২৩ সালের ১৭ আগস্ট মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্বোধনের মাধ্যমে চালু হয়েছে। এর মূল লক্ষ্য হলো দেশের বিভিন্ন স্তরের মানুষ, বিশেষ করে বয়স্ক জনগোষ্ঠীকে আর্থিক নিরাপত্তা প্রদান করা। বাংলাদেশে গড় আয়ু বর্তমানে ৭২.৩ বছর, এবং এটি ক্রমশ বাড়ছে। ২০৫০ সাল নাগাদ ৬৫ বছরের বেশি বয়সী মানুষ দেশের জনসংখ্যার ২৫% হবে। এমন পরিস্থিতিতে, বয়স্কদের আর্থিক নিরাপত্তাহীনতা একটি বড় সমস্যা হতে পারে। এই স্কিমের মাধ্যমে সরকার সেই সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করছে।
এই স্কিমে ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী সকল বাংলাদেশি নাগরিক যোগ দিতে পারেন। এমনকি ৫০ বছরের বেশি বয়সী ব্যক্তি, যারা ১০ বছর নিরবিচ্ছিন্ন চাঁদা দেন, তারাও আজীবন পেনশন পাবেন। স্কিমটি সরকারি চাকরিজীবীদের বাদে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের জন্য উন্মুক্ত। বর্তমানে এটি চারটি স্কিমের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে:
স্কিম |
লক্ষ্য গ্রুপ |
মাসিক চাঁদা (টাকা) |
প্রবাস |
প্রবাসী বাংলাদেশি |
২,০০০, ৫,০০০, ৭,৫০০, ১০,০০০ |
প্রগতি |
বেসরকারি কর্মচারী |
২,০০০, ৩,০০০, ৫,০০০, ১০,০০০ |
সুরক্ষা |
স্বনিয়োগে কর্মরত (ফ্রিল্যান্সার, কৃষক, শ্রমিক) |
১,০০০, ২,০০০, ৩,০০০, ৫,০০০ |
সমতা |
দারিদ্র্যরেখার নিচে থাকা মানুষ |
১,০০০ (৫০০ গ্রাহক + ৫০০ সরকার) |
নিবন্ধনের জন্য আপনার একটি জাতীয় পরিচয়পত্র, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, এবং মোবাইল নম্বর প্রয়োজন। পুরো প্রক্রিয়াটি অনলাইনভিত্তিক, এবং আপনি সর্বজনীন পেনশন ওয়েবসাইট এ গিয়ে সহজেই নিবন্ধন করতে পারবেন।
সর্বজনীন পেনশন সুবিধা
এই স্কিমে যোগ দিলে আপনি বেশ কিছু সুবিধা পাবেন। আসুন, এগুলো বিস্তারিতভাবে দেখি।
১. সকলের জন্য পেনশন
এই স্কিমের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এটি সরকারি চাকরিজীবী ছাড়া সকল নাগরিকের জন্য উন্মুক্ত। আপনি যদি ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী হন, তাহলে এই স্কিমে যোগ দিতে পারবেন। এমনকি ৫০ বছরের বেশি বয়সী ব্যক্তিরাও ১০ বছর চাঁদা দিয়ে পেনশন পেতে পারেন। এটি নিশ্চিত করে যে, দেশের প্রতিটি নাগরিকের জন্য আর্থিক নিরাপত্তার একটি পথ খোলা আছে।
২. বিভিন্ন স্কিম
চারটি স্কিমের মাধ্যমে এই প্রকল্পটি বিভিন্ন পেশা এবং আয়ের মানুষের জন্য উপযুক্ত করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, সমতা স্কিমে দারিদ্র্যরেখার নিচে থাকা মানুষদের জন্য সরকার অর্ধেক চাঁদা দেয়, যা তাদের জন্য বড় সুবিধা। অন্যদিকে, প্রবাস স্কিম প্রবাসীদের জন্য তৈরি, যারা বৈদেশিক মুদ্রায় চাঁদা দিতে পারেন।
৩. পেনশনের পরিমাণ
আপনি যে স্কিমে যোগ দেবেন এবং কত টাকা চাঁদা দেবেন, তার উপর নির্ভর করে আপনার পেনশনের পরিমাণ নির্ধারিত হবে। উদাহরণস্বরূপ, বিবিসি বাংলা অনুযায়ী, প্রগতি স্কিমে ২,০০০ টাকা মাসিক চাঁদা দিলে ১০ বছর পর আপনি মাসিক ৩,০৬০ টাকা পেনশন পেতে পারেন। এছাড়া, আপনি যদি ৬০ বছর বয়সের আগে মারা যান, তাহলে আপনার মনোনীত ব্যক্তি ৭৫ বছর বয়স পর্যন্ত পেনশন পাবেন।
৪. ট্যাক্সের সুবিধা
এই স্কিমে দেওয়া চাঁদা এবং প্রাপ্ত পেনশন উভয়ই ট্যাক্স-মুক্ত। এটি আপনার আর্থিক সঞ্চয়ের জন্য একটি বড় সুবিধা।
৫. স্বচ্ছতা এবং নিরাপত্তা
আপনার চাঁদা সরকারি ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ করা হয়, যা একটি নিরাপদ এবং স্বচ্ছ বিনিয়োগ। এছাড়া, পেনশন স্বয়ংক্রিয়ভাবে আপনার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার (EFT) এর মাধ্যমে জমা হবে, তাই আপনাকে কোনো সরকারি অফিসে যাওয়ার প্রয়োজন হবে না।
৬. প্রবাসীদের জন্য প্রণোদনা
প্রবাসী বাংলাদেশিরা বৈদেশিক মুদ্রায় চাঁদা দিতে পারবেন, এবং তাদের চাঁদার উপর ২.৫% প্রণোদনা দেওয়া হবে। এই প্রণোদনা তাদের চাঁদা হিসেবে জমা হবে, যা তাদের জন্য একটি বাড়তি সুবিধা।
৭. সহজ নিবন্ধন এবং লেনদেন
নিবন্ধন প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ অনলাইনভিত্তিক। আপনি ব্যাংক, মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস, বা ক্রেডিট/ডেবিট কার্ডের মাধ্যমে চাঁদা দিতে পারবেন। এছাড়া, সোনালী ব্যাংকের শাখাগুলো জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের ফ্রন্ট অফিস হিসেবে কাজ করে।
সর্বজনীন পেনশন অসুবিধা
যদিও এই স্কিমে অনেক সুবিধা রয়েছে, তবুও কিছু অসুবিধা বা চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যা আপনার জানা দরকার।
১. বিশ্বাসের অভাব
অনেক মানুষ এই স্কিমের উপর ভরসা করতে পারছেন না। বিবিসি বাংলা রিপোর্ট অনুযায়ী, গ্রাহকরা উদ্বিগ্ন যে, ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত চাঁদা দিয়েও তারা ঝামেলা ছাড়া পেনশন পাবেন কি না। সরকারি প্রতিষ্ঠানে সেবা পাওয়ার পূর্ব অভিজ্ঞতা, বিশেষ করে পেনশন সংক্রান্ত হয়রানির ঘটনা, এই অবিশ্বাস বাড়িয়েছে।
২. চাঁদা দেওয়ার আর্থিক চাপ
অনেকের জন্য মাসিক চাঁদা দেওয়া কঠিন। উদাহরণস্বরূপ, বিবিসি বাংলা অনুযায়ী, শিক্ষকদের মতো কম আয়ের মানুষদের জন্য ২,০০০ টাকা মাসিক চাঁদা দেওয়া কঠিন, বিশেষ করে জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান খরচের মধ্যে।
৩. তহবিল উত্তোলনের সীমাবদ্ধতা
এই স্কিমে জরুরি প্রয়োজনে তহবিল উত্তোলনের কোনো সুবিধা নেই। আপনাকে ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে, যা অনেকের জন্য অসুবিধাজনক। যদিও ৫০% পর্যন্ত ঋণ হিসেবে তুলতে পারার সুবিধা আছে, তবুও এটি সবার জন্য যথেষ্ট নয়।
৪. নতুন নিবন্ধন হ্রাস
বিবিসি বাংলা রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রায় ২০% গ্রাহক তাদের চাঁদা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন, এবং নতুন নিবন্ধনের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে কমেছে। এটি স্কিমের জনপ্রিয়তা এবং কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
৫. তহবিল পরিচালনার উদ্বেগ
কিছু অর্থনীতিবিদ, যেমন সাবেক বিশ্বব্যাংকের অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন, মনে করেন যে তহবিল পরিচালনায় স্বচ্ছতার অভাব থাকতে পারে। সরকারি প্রতিষ্ঠানে অর্থের অপব্যবহারের ইতিহাস এই উদ্বেগ বাড়িয়েছে। এছাড়া, ভবিষ্যতে সরকার এই পেনশন পরিশোধ করতে সক্ষম হবে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
৬. একক ব্যাংকের উপর নির্ভরতা
বর্তমানে শুধুমাত্র সোনালী ব্যাংক এই স্কিমের লেনদেন পরিচালনা করছে। এটি অনেক গ্রাহকের জন্য অসুবিধাজনক, কারণ সবাই একটি নির্দিষ্ট ব্যাংকের সাথে কাজ করতে চান না। অর্থনীতিবিদ খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম পরামর্শ দিয়েছেন যে, সকল ব্যাংককে এই স্কিমে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।
৭. মুদ্রাস্ফীতির সমন্বয়
পেনশনের হার নির্দিষ্ট, এবং মুদ্রাস্ফীতির সাথে এটি সবসময় সমন্বয় করা হয় না। এটি দীর্ঘমেয়াদে পেনশনের প্রকৃত মূল্য কমিয়ে দিতে পারে।
সরকারের পদক্ষেপ এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
সরকার এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলার জন্য কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, জনসচেতনতা বাড়াতে তারা বিজ্ঞাপন, কর্মশালা, এবং মেলার আয়োজন করছে। এছাড়া, স্কিমে বীমার মতো নতুন সুবিধা যোগ করার পরিকল্পনা রয়েছে। জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য মোহাম্মদ গোলাম মোস্তফা জানিয়েছেন, এটি একটি রাষ্ট্রীয় গ্যারান্টিযুক্ত প্রকল্প, এবং গ্রাহকদের টাকা নিরাপদে তাদের অ্যাকাউন্টে থাকবে। তিনি আরও বলেছেন, জনগণের মধ্যে বিশ্বাস তৈরি হতে সময় লাগবে, যেমন জার্মানিতে ৩৩ বছর এবং দক্ষিণ কোরিয়ায় ১১ বছর লেগেছিল।
আপনার জন্য এটি কী বোঝায়?
এই স্কিমে যোগ দেওয়ার আগে আপনার কিছু বিষয় বিবেচনা করা উচিত:
-
আর্থিক সামর্থ্য: আপনি কি মাসিক চাঁদা দিতে পারবেন? আপনার আয় এবং খরচের সাথে এটি কীভাবে মানানসই হবে?
-
দীর্ঘমেয়াদী প্রতিশ্রুতি: এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ। আপনি কি ১০ বছর বা তার বেশি সময় ধরে চাঁদা দিতে প্রস্তুত?
-
বিশ্বাস: আপনি কি সরকারের উপর ভরসা করতে পারবেন যে তারা আপনার টাকা নিরাপদে রাখবে এবং সময়মতো পেনশন দেবে?
সর্বজনীন পেনশন স্কিম বাংলাদেশের জনগণের জন্য একটি সম্ভাবনাময় উদ্যোগ, যা দীর্ঘমেয়াদে আর্থিক নিরাপত্তা প্রদান করতে পারে। এটি ট্যাক্স-মুক্ত পেনশন, নিরাপদ বিনিয়োগ, এবং সরকারি সহায়তার মতো সুবিধা প্রদান করে। তবে, জনগণের মধ্যে বিশ্বাসের অভাব, আর্থিক চাপ, এবং তহবিল পরিচালনার উদ্বেগ এর জনপ্রিয়তার পথে বাধা সৃষ্টি করছে। আপনি এই স্কিমে যোগ দেওয়ার আগে আপনার আর্থিক সামর্থ্য এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা বিবেচনা করুন।