ঢাকা বুধবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

পুরনো শিক্ষাক্রমে ফিরছে শিক্ষার্থীরা

উৎপল দাশগুপ্ত

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১, ২০২৪, ০২:২২ এএম

পুরনো শিক্ষাক্রমে ফিরছে শিক্ষার্থীরা

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

#আজকালের মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র
#নবম শ্রেণিতে থাকছে বিভাগ বিভাজন
#পরীক্ষা পদ্ধতিতেই শিক্ষার্থীর মেধা যাচাই
#১ জানুয়ারিতেই নতুন বই পাবে শিক্ষার্থীরা
#এনসিটিবির নতুন চেয়ারম্যান অধ্যাপক রিয়াজুল হাসান

২০২৫ শিক্ষাবর্ষে মাধ্যমিক স্তরের নবম-দশম শ্রেণিতে আগের পাঠ্যবইয়ে পড়াশোনার মাধ্যমে মূল্যায়ন পদ্ধতির পরিবর্তে পরীক্ষাপদ্ধতির পুরনো শিক্ষাক্রমে ফিরছে শিক্ষার্থীরা। ২০২৫ সালে অষ্টম থেকে নবম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা আগের মতই বিজ্ঞান, বাণিজ্য ও কলা বিভাগ নিয়ে পড়াশোনা করবে।

আজ রোববার অথবা কাল সোমবারের মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে পরিপত্র জারি করে পুরনো শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের জন্য এসব নির্দেশনা আসতে পারে। সময় স্বল্পতার কারণে প্রাথমিকসহ মাধ্যমিক স্তরের ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বিশেষ কিছু পরিমার্জন সাপেক্ষে নতুন শিক্ষাক্রমের বই পড়ানো হলেও পুরনো পরীক্ষা পদ্ধতিতেই চলবে শিক্ষার্থীর মেধা যাচাই। চলতি বছর নবম শ্রেনির যেসব শিক্ষার্থী নতুন শিক্ষাক্রমের বই পড়ছে তাদের বার্ষিক পরীক্ষাও হবে পুরনো পরীক্ষাপদ্ধতি অনুযায়ি। 

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। ২০২৩ সাল থেকে নতুন শিক্ষাক্রমের বই পড়ছে শিক্ষার্থীরা।গত বছর প্রাথমিকের প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম এবং চলতি বছর দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং মাধ্যমিক স্তরের অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রমের পাঠ্যবই পড়ানো হয়েছে। আগামী বছরের জন্য নতুন শিক্ষাক্রমে প্রাথমিকে চতুর্থ, পঞ্চম এবং মাধ্যমিকে দশম শ্রেণির বই লেখার কাজ চলছে। এরই মধ্যে প্রাথমিক স্তরের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণি এবং মাধ্যমিক স্তরের ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেনির বইয়ের টেন্ডারপ্রক্রিয়া শেষে হয়ে গেছে। বাকি শ্রেণির বইও টেন্ডার প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে।

চলতি বছরের জুলাই মাস থেকে শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে উদ্ভুত পরিস্থিতিতে আটকে যায় বই মুদ্রণের কাজ।

ইতিমধ্যে বছরের বেশিরভাগ সময় পার হয়ে যাওয়ার পর নতুন শিক্ষাক্রম থেকে পুরনো শিক্ষাক্রমে ফেরার সিদ্ধান্ত ও বইয়ে বিশেষ পরিমার্জন প্রয়োজন হওয়ায় ২০২৫ সালের ১ জানুয়ারি শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দেয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল। তবে ইতিমধ্যে উল্লেখিত শ্রেণিগুলোতে টেন্ডার অনুযায়ি কাজ হওয়ার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হওয়ায় পাঠ্যবই মুদ্রণ নিয়ে অনিশ্চয়তা দূর করেছে। বরাবরের মতই আগামী বছরের প্রথম দিনই শিক্ষার্থীরা নতুন বই পাবে বলে নিশ্চিত করেছে এনসিটিবি।

এদিকে গতকাল শনিবার বি.সি.এস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক এ কে এম রিয়াজুল হাসানকে প্রেষণে এনসিটিবির নতুন চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দিয়েছে সরকার। রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কলেজ-২ শাখার উপসচিব চৌধুরি সামিয়া ইয়াসমীন সাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে এ আদেশ জারি করা হয়। অধ্যাপক রিয়াজুল হাসান ইতিপূর্বে এনসিটিবির সদস্য (প্রাথমিক) পদে দায়িত্ব পালন করেছেন।

চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ পাওয়ার পর প্রথম প্রতিক্রিয়ায় অধ্যাপক রিয়াজুল হাসান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা শিক্ষায় সংস্কারের নানা বিষয়ে ইতিমধ্যে কথা বলেছেন। নীতিগত এসব সংস্কারের বিষয়টি সামনে রেখেই আমরা কাজ করব।

এদিকে নতুন বছরের পাঠ্যবই মুদ্রণ ও অন্যান্য বিষয়ে এনসিটিবির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অধ্যাপক রবিউল কবীর চৌধুরী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, বরাবরের মত এবারও নতুন বছরের প্রথম দিনই শিক্ষার্থীরা নতুন বই পাবে। এই লক্ষ্যেই কাজ করছি আমরা। শীট মেশিনে কাজ করা প্রিন্টার্সদের দরপত্র বাতিলের দাবি নির্ধারিত সময়ে বইয়ের কাজ শেষ করায় বাঁধা হবে কিনা প্রশ্নের উত্তরে অধ্যাপক রবিউল কবীর বলেন, আমরা সবাইকে নিয়েই কাজ করব। কেউ যাতে ডিপ্রাইভ (বঞ্চিত) না হয় সেদিকটিও বিবেচনায় রয়েছে।  

এনসিটিবি সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে প্রাথমিক স্তরের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীর বই মুদ্রণের জন্য দরপত্র ও মূল্যায়ন কাজ শেষ করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এসব বইয়ে কী ধরণের পরিমার্জন হতে পারে সে বিষয়ে শিক্ষা উপদেষ্টার সঙ্গে আজ এনসিটিবির চেয়ারম্যান ও কর্মকর্তাদের বৈঠকের কথা রয়েছে। রিভিউ শেষ হওয়ার পর এটি পারচেজ কমিটিতে যাবে। মুদ্রণ প্রক্রিয়ার সকল কাজ শেষ করে মধ্য সেপ্টেম্বরের মধ্যে প্রিন্টার্সদের বই মুদ্রণের নির্দেশ দেয়া সম্ভব হতে পারে। এসব বই মুদ্রণের জন্য প্রিন্টার্সদের ৭০ দিন সময় বেঁধে দেওয়া হবে। সব মিলিয়ে নভেম্বরের মধ্যে এসব বই ছাপানো শেষ হবে বলে আশা করছে এনসিটিবি।

অন্যদিকে আজকালের মধ্যে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির বই মুদ্রণের জন্য ই-জিপি করে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেয়া হবে। মুদ্রণের সকল প্রক্রিয়া শেষ করে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে ৫০ দিন সময় বেঁধে দিয়ে প্রিন্টার্সদের বই মুদ্রণের অর্ডার দেওয়া হবে। এছাড়া প্রাক-প্রাইমারি ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বইয়ের  সংখ্যা ও লট অল্প হওয়ায় বই মুদণে বেশি সময় লাগবে না বলেই ধারণা করছে এনসিটিবি। সবঠিক থাকলে আগামী ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রাথমিক স্তরের শতভাগ বই প্রস্তুত হয়ে যাবে বলে আত্মবিশ্বাসী এনসিটিবি।

অন্যদিকে মাধ্যমিক স্তরের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বই মুদ্রণের দরপত্র ও মূল্যায়ণ শেষ করে পহেলা আগষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত কমিটি এসব মূল্যায়ন যাচাইবাছাই ও অন্যান্য প্রক্রিয়া শেষ করে পারচেজ কমিটিতে পাঠাবে। আর অষ্টম শ্রেণির বইয়ের দরপত্র মূল্যায়ন চলছে। ১০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর আশা সংশ্লিষ্টদের। নবম-দশম শেণিতে যেহেতু পুরনো বই মুদ্রণ হবে তাই কিছু পরিমার্জন ছাড়া বড় কোন সমস্যা নেই। সূত্র জানায়, আজকালের মধ্যে পুরনো শিক্ষাক্রমে ফিরে যাওয়ার শিক্ষামন্ত্রণালয়ের পরিপত্র জারি হওয়ার পর মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তর থেকে সারাদেশের নবম-দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের চাহিদা আনা হবে। এরপর মুদ্রণ প্রক্রিয়ায় যাবে নবম-দশম শ্রেণির পাঠ্যবই।

পাঠ্যবই মুদ্রণের বিষয়ে এনসিটিবি সদস্য (টেক্সট) অধ্যাপক সাইদুর রহমান বলেন, জানুয়ারির প্রথম দিন শিক্ষার্থীদের হাতে যাতে নতুন বই তুলে দেওয়া যায় সেই লক্ষ্যেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আশা করি বরাবরের মতই নির্দিষ্ট সময়েই নতুন পাঠ্যবই পাবে শিক্ষার্থীরা। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আগামী শিক্ষাবর্ষের প্রথম দিন শিক্ষার্থীদের বই পাওয়া কতটুকু সম্ভব সে বিষয়ে বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির সভাপতি ও আনন্দ প্রিন্টার্সের সত্ত্বাধিকারী রব্বানী জব্বার রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, অনেকটা সময় চলে গিয়েছে ঠিকই, তবে আমাদের প্রিন্টার্সদের যে সক্ষমতা তাতে বইগুলির সফট কপি দ্রুত হাতে পেলে নির্দিষ্ট সময়েই কাজ শেষ করা সম্ভব। তবে সিদ্ধান্তগুলো দ্রুত নিতে হবে। শীট মেশিনে কাজ করা প্রিন্টার্সদের দরপত্র বাতিলের দাবি নির্দিষ্ট সময়ে বই পাওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা হবে কীনা এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমি তো কোন সমস্যা দেখি না। এখনো নবম-দশম শ্রেণির বইয়ের দরপত্র দেওয়া বাকি রয়েছে। সরকার যেভাবে নির্দেশনা দিবে আমরা সেভাবেই কাজ করার জন্য প্রস্তুত রয়েছি।

২০২৫ শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের জন্য প্রায় ৩৫ কোটি বই মুদ্রণের পরিকল্পনা রয়েছে এনসিটিবির। এর মধ্যে প্রাথমিক স্তরে ১০ কোটি ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের জন্য ২৫ কোটি বই মুদ্রণ করা হবে। এর আগে ২০২৪ শিক্ষাবর্ষে বই ছাপা হয়েছিল ৩০ কোটি ৭০ লাখ ৮৩ হাজার ৫১৭ কপি। আর ২০২৩ সালে ছাপা হয়েছিল ৩৩ কোটি ৪৮ লাখ ৭৬ হাজার ৯২৩ কপি পাঠ্যবই।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কোটা সংস্কার ঘিরে আওয়ামী সরকারের পতনের পর রাষ্ট্রকাঠামোর নানা অংশে সংস্কারের জোরালো দাবি চলছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও সংস্কারের এসব দাবির সঙ্গে ঐক্যমত পোষন করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছে। শিক্ষায় সংস্কারের ক্ষেত্রে প্রধান দাবি ছিল, আওয়ামী সরকারের সময় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে মূল্যায়নভিত্তিক নতুন শিক্ষাক্রম বাতিল করে পরীক্ষাভিত্তিক পুরনো শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে অন্তর্বর্তী সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদও পুরোনো শিক্ষাক্রমে ফিরে যাওয়ার বিষয়ে একমত পোষন করেছেন। তবে বছরের বেশিরভাগ সময় পার হয়ে যাওয়ায় এই মূহূর্তে শিক্ষাক্রমে ব্যাপক পরিবর্তন বাস্তবসম্মত হবে না মন্তব্য করে উপদেষ্টা বলেন, পরিবর্তন হবে তবে কোন শিক্ষার্থী যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে বিষয়ে সর্ব্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হবে। অবশেষে পুরনো শিক্ষাক্রমের পড়াশোতেই ফিরে যাচ্ছে শিক্ষার্থীরা।

আরবি/জেডআর

Link copied!