বর্তমান সময়ে জনগণের কাছে আস্থাশীল অন্যতম একটি দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি। ক্রমেই দলটির গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে। স্বৈরাচার শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের অত্যাচার-নির্যাতনের কারণে গত ১৬ বছর বিএনপির নেতা-কর্মীরা নানাভাবে হয়রানি ও জেল-জুলুমের শিকার হয়েছেন। নানা পেশার মানুষ বিএনপির রাজনীতিতে জড়িত। পিছিয়ে নেই শোবিজ তারকারাও। বিএনপির রাজনীতি করতে গিয়ে নিজের সোনালি ক্যারিয়ার নষ্ট করেছেন অনেক তারকাশিল্পী। করতে হয়েছে কারাভোগ। ছাড়তে হয়েছে জন্মভূমি। দীর্ঘ ১৬ বছর জুলুমের শিকার হওয়া বিএনপির তারকাশিল্পীদের ভাগ্য খুলবে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে। আগামী নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন পেতে পারেন শোবিজের হাফ ডজন তারকা শিল্পী। সেই তালিকায় এগিয়ে আছেন বেবী নাজনীন, কনকচাঁপা, আশরাফ উদ্দিন আহমেদ উজ্জ্বল, আসিফ আকবর, মনির খান, শিবা শানু ও হেলাল খান।
বেবী নাজনীন: দেশের জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা বেবী নাজনীন। রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার কারণে বিগত সরকারের আমলে তার পেশাগত কর্মকাণ্ড অনেকটা থেমে যায়। পরবর্তী সময়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করতে শুরু করেন। শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর গত ১০ নভেম্বর দেশে ফিরেছেন নন্দিত এই শিল্পী। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি থেকে এমপি হওয়ার দৌড়ে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে আছেন বেবী নাজনীন। কারণ, তিনি বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন।
শেখ হাসিনা সরকার পতনের আগে প্রবাসে থাকলেও দলের জন্য কাজ করেছেন। বিগত ১৬ বছর আওয়ামী লীগের শাসনামলে একাধিকবার বিভিন্নভাবে বেবী নাজনীনের সংগীত জীবন বাধাগ্রস্ত হয়। বাংলাদেশ বেতার, টিভি বা মঞ্চÑ কোনো মাধ্যমেই এই গায়িকা কাজ করতে পারেনি। একপর্যায়ে দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। হাসিনা সরকার পালানোর পর দীর্ঘ সময় পর নিজ জন্মভূমিতে ফিরেন বেবী নাজনীন। দেশে ফিরে নিজ এলাকা নীলফামারীর বিএনপির হয়ে কাজ শুরু করেছেন। জানা গেছে, নীলফামারী থেকে বিএনপির হয়ে জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেবেন তিনি। ‘ব্লাক ডায়মন্ড’খ্যাত জনপ্রিয় এই সংগীতশিল্পী বলেন, ‘আমি এখনো রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত আছি। ভবিষ্যতে দলীয় নির্দেশনা মেনেই কাজ করব।’
কনকচাঁপা: অসংখ্য জনপ্রিয় গানের নন্দিত কণ্ঠশিল্পী রুমানা মোর্শেদ কনকচাঁপা। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিরাজগঞ্জ-১ (কাজিপুর ও সদরের একাংশ) আসন থেকে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানান তিনি। বিএনপি থেকে তিনি নির্বাচন করবেন। স্থানীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠকও করছেন। কনকচাঁপা বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক সংগঠন কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করছেন। পাশাপাশি সিরাজগঞ্জ জেলা বিএনপির সদস্য পদেও রয়েছেন। গত ১৫ সেপ্টেম্বর অন্তর্বর্তী সরকার তাকে ৩ বছরের জন্য সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ের ট্রাস্ট্রি বোর্ডের মেম্বার নিযুক্ত করেছে। দৈনিক রূপালী বাংলাদেশকে কনকচাঁপা বলেন, ‘আমি অবশ্যই নির্বাচন করব, নমিনেশন কিনব, দল মনোনয়ন দেবে কি না সেটা দলের ব্যাপার। ৫ তারিখের আগে কেউ কোনো কাজ করতে পারিনি। আওয়ামী লীগ সরকার আমলে আমি কোনো ফোন ব্যবহার করতে পারতাম না। সিমকার্ড ঢোকানোর সঙ্গে সঙ্গে সেটা ব্লক করা হতো। সব জায়গা থেকে আমাকে নিগৃহীত করা হয়েছে। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে এরই মধ্যে আমি কাজ শুরু করেছি। এলাকার মানুষের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ হচ্ছে। আমার বাসাতেও দলীয় নেতাদের নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক করছি। এসব বৈঠকে নেতাকর্মীরা আমাকে স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন জানিয়েছে। কাজিপুর ও সিরাজগঞ্জবাসীর সমর্থন এবং দল যদি আমাকে মনোনয়ন দেয় আমি নির্বাচনে নিশ্চয়ই অংশগ্রহণ করব।’
তিনি আরও বলেন, ‘মিথ্যাচার মুক্ত বাংলাদেশ চাই’Ñএ স্লোগানকে সামনে রেখে আমাদের দেশ গড়ার কাজে অংশ নিতে হবে। এলাকার মানুষের উন্নয়নে কাজ করতে চাই।’
২০১৩ সালের ১৫ আগস্ট খালেদা জিয়ার ৬৯তম জন্মদিনে আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপির রাজনীতিতে যোগ দেন কনকচাঁপা। ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে কাজীপুর আসনে বিএনপি থেকে মনোনয়ন পান। কিন্তু রাতের ভোটে নাসিমের কাছে হেরে যান তিনি। এরপর দীর্ঘ ১৬ বছর শেখ হাসিনা সরকারের দ্বারা নানাভাবে কোণঠাসা ছিলেন। ফ্যাসিস্ট সরকার পতনের পর ফের রাজনীতির মাঠে সক্রিয় হয়েছেন এই সংগীত তারকা।
আশরাফ উদ্দিন আহমেদ উজ্জ্বল: সত্তর দশকের জনপ্রিয় নায়ক আশরাফ উদ্দিন আহমেদ উজ্জ্বল। দীর্ঘদিন ধরে বিএনপির রাজনীতি করছেন তিনি। হাসিনা সরকার পতনের পর থেকে ফের রাজনীতির মাঠে সক্রিয় তিনি। অংশ নিচ্ছেন দলীয় বিভিন্ন কার্যক্রমে। বর্তমানে বিএনপির সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বিএনপির হয়ে যেকোনো আসন থেকে নির্বাচনে অংশ নিতে চান এই নায়ক। দৈনিক রূপালী বাংলাদেশকে তিনি বলেন, ‘বিএনপির রাজনীতিতে আমি অতিথি নই, একজন একনিষ্ঠ কর্মী। সব সময় দলের সঙ্গে আছি। স্বৈরাচার সরকারের আমলে নানা কৌশলে দলের জন্য কাজ করেছি। সামনেও করব। দল চাইলে আগামী সংসদ নির্বাচনে অংশ নেব।’
আসিফ আকবর: বাংলা গানের যুবরাজ আসিফ আকবর। একসময় সক্রিয়ভাবে বিএনপির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এই গায়ক। পরে নিজেকে রাজনীতির মাঠ থেকে সরিয়ে নেন। ২০০৬ সালে কুমিল্লার সদর থেকে নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু খালেদা জিয়ার নির্দেশে গানে মনোযোগ দেন আসিফ। এখন খালেদা জিয়ার ডাকের অপেক্ষায় আসিফ আকবর। তিনি বলেন, ‘আমি বিএনপিতে ছিলাম। একটি কারণে দল থেকে পদত্যাগপত্র বেগম জিয়াকে দিয়েছিলাম। কিন্তু তিনি পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেননি। ফ্যাসিস্টের সময় বেগম জিয়া আমাকে বিভিন্ন দায়িত্ব দিতেন সেগুলো পালন করেছি। দল থেকে পদত্যাগ করেছি ঠিকই কিন্তু দলের সঙ্গে ছিলাম, আছি এবং সামনেও থাকব। আমি নিজে খেয়ে ধানের শীষ, ধানের শীষ খেয়ে বিএনপি না। বেগম জিয়ার নির্দেশে চলছি। দল থেকে দূরে আছি তারই নির্দেশে। বেগম জিয়া চাইলে যেকোনো সময় সাড়া দেব। বিএনপির কর্মী হিসেবে কখনো কোনো আপস করিনি। আগামীতেও করব না। এরই মধ্যে এক মাধ্যমে তার একটা বার্তা এসেছে আমার কাছে। তিনি দেশে ফিরলে দেখা হবে। তারপর সিদ্ধান্ত নেব কি করব।’ আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ‘ও প্রিয়া’খ্যাত গায়কের সংসদ সদস্য হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হবে, তা অনেকটাই স্পষ্ট। কারণ, বেগম খালেদা জিয়াও আসিফকে পছন্দ করেন সে কথা কারো অজানা নয়।
মনির খান: বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সাংস্কৃতিক সম্পাদক ছিলেন জনপ্রিয় গায়ক মনির খান। ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে মনোনয়ন না পাওয়ার কারণে অভিমানে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনীতি ছেড়ে দেন। সে সময় তিনি বলেছিলেন, ‘মন ভেঙে গেছে।’ তবে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর রাজনীতিতে ফেরার খবর দেন। রাজনীতিতে ফেরা প্রসঙ্গে মনির খান বলেন, ‘একটা অভিমান নিয়ে আমি রাজনীতি ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। অভিমানটা ছিল নির্বাচনকেন্দ্রিক। অভিমান কার সঙ্গে করা যায়? যার প্রতি বেশি ভালোবাসা থাকে, তার সঙ্গেই মান-অভিমান করা যায়। মায়ের সঙ্গে সন্তানের মান-অভিমান হয়। যেখানে ঘনিষ্ঠতা গভীর, সেখানেই মান-অভিমান হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই অভিমান ভেঙেও যায়। মোটকথা, আমি রাজনীতিতে ছিলাম, আছি এবং থাকব। আমি আমার দলের সঙ্গে আছি। দল চাইলে আগামী নির্বাচনে অংশ নেব।
দেশজুড়ে বিএনপির নেতা হিসেবে বেশ পরিচিত মনির খান। বিএনপির রাজনীতি করায় সংগীত জীবনে নানাভাবে বঞ্চিত হয়েছেন তিনি। আগামী জাতীয় নির্বাচনে নিজ জন্মভূমি ঝিনাইদহ-৩ আসন থেকে নির্বাচন করার জন্য বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন।
শিবা শানু: বিএনপির তারকা নেতাদের মধ্যে অন্যতম ত্যাগী নেতা চৌধুরী মাজহার আলী ওরফে শিবা শানু। অনেকে দুধের মাছি হলেও শিবা শানু বিএনপির রাজনীতিতে সব সময় বেশ সক্রিয় ছিলেন। খালেদা জিয়ার কঠিন সময়ে বডিগার্ডের দায়িত্ব পালনে দ্বিতীয়বার ভাবেননি তিনি। হাসিনা সরকারের আমলে বিএনপির হয়ে বিভিন্ন সময় মাঠের রাজনীতিতে বেশ সরব দেখা যায়। যে কারণে হাসিনা বাহিনী একাধিকবার তাকে গ্রেপ্তার করে। নানা নির্যাতনের মধ্যেও রাজপথ ছাড়েনি শিবা শানু। জানা গেছে, দল চাইলে আগামী নির্বাচনে ঢাকার জন্মস্থান থেকে বিএনপির হয়ে লড়বেন এই জনপ্রিয় খল-অভিনেতা।
হেলাল খান: এক সময়ের জনপ্রিয় চিত্রনায়ক হেলাল খান ৫ আগস্টের পর রাজনীতিতে বেশ সক্রিয়। জাসাসের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। সিলেটের বিয়ানীবাজারে সন্তান হেলাল খান আগামী নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নিতে প্রস্তুত আছেন।বিএনপির রাজনীতি করায় তাকে বেশ কয়েকবার কারাভোগ করতে হয়েছে। তবে হাসিনা সরকার পতনের পর তার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা শেখ সেলিমের আশীর্বাদপুষ্ট চিত্রনায়িকা নিপুণ আক্তারকে আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। তার নির্দেশে সিলেট বিমানবন্দরে আটক হওয়ার পরও ছাড়া পেয়ে হেলাল খানের নিরাপদ আশ্রয়ে আছেন আওয়ামী লীগ নেত্রী নিপুণ! তবে এ অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে হেলাল খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে সাড়া পাওয়া যায়নি।
রিনা খান: সাত শতাধিক সিনেমার জনিপ্রয় অভিনেত্রী রিনা খান বহুবছর ধরে বিএনপির রাজনীতিতে সরব। ‘আমার গায়ে বিএনপির সিল’-সম্প্রতি এমন সংলাপে আলোচনায় আসেন তিনি। আগামী নির্বাচনে বিএনপির হয়ে অংশ নিতে চান এই তারকা অভিনেত্রী।
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শোবিজ অঙ্গন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন অন্তত এক ডজন তারকা। তবে দলের শীর্ষ এক নেতা জানান, আগামী নির্বাচনে বিএনপি বুঝেশুনে প্রার্থী দিবে। সেইসঙ্গে ত্যাগীদের মূল্যায়ন করা হবে।
আপনার মতামত লিখুন :