রেসলমেনিয়া ৪১-এর প্রথম রাতটি ছিল ইতিহাস সৃষ্টির মুহূর্ত। যখন সেথ রোলিন্স পল হেইম্যানের সঙ্গে হাত মিলিয়ে রোমান রেইন্স এবং সিএম পাঙ্ককে পরাস্ত করলেন, তখন রেসলিং দুনিয়া একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেল।
বিশেষ করে, পল হেইম্যানের বিশ্বাসঘাতকতা ছিল এই রাতের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা। দীর্ঘদিন রেইন্সের পারফরম্যান্সের আর্কিটেক্ট হিসেবে পরিচিত হেইম্যানের এমন আচরণ কি চরম অজানা পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে? তার বিশ্বাসঘাতকতার পেছনে কি কোনো গভীর কারণ রয়েছে, না কি এটি শুধুই রোলিন্সের একটি সুপরিকল্পিত ফাঁদ?
পল হেইম্যানের রোমান রেইন্সের সঙ্গে সম্পর্ক অত্যন্ত শক্তিশালী ছিল। তিনি শুধু রেইন্সের ম্যানেজার ছিলেন না, তাকে গড়ে তুলেছিলেন একটি আধিপত্যবাদী চরিত্র হিসেবে। রেইন্সের ‘দ্য ট্রাইবাল চিফ’ চরিত্র বা গিমিক তৈরি করতে হেইম্যানের অবদান ছিল অমূল্য। একদিকে ছিল রেইন্সের আধিপত্য, অন্যদিকে ছিল পল হেইম্যানের নিরলস সমর্থন—এতদিন তারা একসঙ্গে রিংয়ের শীর্ষে অবস্থান করছিলেন।
তবে সেথ রোলিন্সের সামনে আসার পর কিছুটা বদলাচ্ছিল এই সম্পর্কের ডাইনামিক্স। ‘এটি সম্ভবত একটি স্বাভাবিক পরিবর্তন,’ বলেন রেসলিং বিশ্লেষক ব্রেন্ডন ক্রুজ।
‘হেইম্যান শেষ পর্যন্ত তার পুরোনো মিত্র রোমান রেইন্সের প্রতি স্নেহের কিছুটা অভাব অনুভব করেছেন। রোলিন্সের কৌশল এবং শক্তি তাকে আরও আকর্ষণ করেছে।’
এতদিন রেইন্সের পাশে থাকলেও, হেইম্যান মনে করতেন যে, রোলিন্সের সঙ্গে তার জোট তাকে আরও বড় সুযোগ এনে দিতে পারে। এ সম্পর্কের মধ্যে সবার চেয়ে বেশি মজবুত ছিল পল হেইম্যানের স্বার্থপরতা—তিনি চেয়েছিলেন রিংয়ের সামনের দৃশ্যপটটি নিজের নিয়ন্ত্রণে আনতে, যেখানে রোলিন্স তার যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারে।
‘এটি ছিল পুরোপুরি পেশাদারি চিন্তা,’ মন্তব্য করেন রেসলিং বিশ্লেষক এবং প্রাক্তন রেসলার মাইকেল ডগলাস। ‘হেইম্যান, যিনি মনে করতেন রেইন্সের শাসন দীর্ঘস্থায়ী নয়, সেই সুযোগে রোলিন্সের পক্ষে চলে আসেন।’
এটিই ছিল হেইম্যানের বিশ্বাসঘাতকতার মূল কারণ—রোমান রেইন্সের প্রতি তার আনুগত্য আসলে এক পর্যায়ে তার নিজের স্বার্থের কাছে তুচ্ছ হয়ে দাঁড়ায়। একে বলা হচ্ছে ‘পল হেইম্যান গাই’ রোলিন্স—যার ফলস্বরূপ ‘দ্য ট্রাইবাল চিফ’ রোমান রেইন্সের প্রাধান্য শেষ হয়ে যায়। পল হেইম্যানের সঙ্গে সেথ রোলিন্সের নতুন জোট শক্তিশালী করেছে রোলিন্সের অবস্থানকে।
রেসলমেনিয়া ৪১–এর প্রথম রাতে রোমান রেইন্স কার্যত ভেঙে পড়েছিলেন। পল হেইম্যানের বিশ্বাসঘাতকতায় তিনি এতটাই স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন যে, ম্যাচ শেষে তাকে রিংয়ের এক কোণায় বসে চোখ মুছতে দেখা যায়।
একাধিক লাইভ স্ট্রিম ও বিশ্লেষণধর্মী ভিডিওতে দেখা যায়, রেইন্সের চোখে জল জমে গিয়েছিল। প্লানা ইউটিউব চ্যানেলের লাইভ কমেন্ট্রি এবং রেসলিংইংক–এর রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, ‘রেইন্স ছিলেন হতবাক, স্তব্ধ, এবং আবেগপ্রবণ—যেন এই বিশ্বাসঘাতকতার মানে খুঁজে পাচ্ছিলেন না।’
স্পোর্টসটাইগার–এ প্রকাশিত ভিডিওতে দেখা যায়, ম্যাচ শেষে রেইন্স একটানা বসে আছেন, পল হেইম্যান সেথ রোলিন্সের পাশে দাঁড়িয়ে বিজয় উদযাপন করছেন—এই দৃশ্য দেখে রেইন্সের চোখের জল আর আটকাতে পারেননি বলে দাবি করা হয়।
এমনকি ESPN–এর বিশ্লেষণেও বলা হয়, ‘রেইন্স যে কাঁদছিলেন তা অস্বীকার করার উপায় নেই, কারণ তার মুখের অভিব্যক্তি ও দৃষ্টিতে ছিল ভাঙনের ছাপ।’ এটি শুধু পরাজয় নয়, তার বিশ্বস্ত পরামর্শদাতা পল হেইম্যানের পক্ষ পরিবর্তনের ধাক্কা, যা তাকে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত করে দেয়।
রেসলিং অ্যানালিস্ট সোলোমন্স্টার তার ইউটিউব এনালাইসিসে বলেন, ‘রেইন্সের এই কান্না পরাজয়ের নয়, ছিল বিশ্বাসভঙ্গের প্রতিক্রিয়া। মানুষটা এক যুগ ধরে যাকে পাশে রেখেছে, সে যখন বিপক্ষে দাঁড়ায়, কান্না অস্বাভাবিক কিছু নয়।’
এ দৃশ্য রেসলিং ইউনিভার্সের জন্য এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত—একজন হার্ড হিটিং ডমিনেন্ট চ্যাম্পিয়নের আবেগপ্রবণ পতন, যা রেসলমেনিয়ার গল্পকে এক মহাকাব্যিক রূপ দিয়েছে।
এদিকে, সোশ্যাল মিডিয়া, বিশেষ করে রেসলিং-সংক্রান্ত বিভিন্ন ইউটিউব চ্যানেল এবং রেসলিং এনালিস্টরা ঘটনাটির ওপর প্রচুর প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন।
ডেভিড হার্টস নামে এক বিখ্যাত রেসলিং বিশ্লেষক তার চ্যানেলে বলেন, ‘এটি কোনো সাংঘাতিক ঘটনা নয়—এটি ছিল ইতিহাসের অংশ, যেখানে পল হেইম্যান তার পুরোনো বন্ধুর থেকে নতুন ক্ষমতাধর প্রার্থীকে বেছে নিয়েছেন।’ এই চমকপ্রদ বিশ্লেষণ বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
রোমান রেইন্সের ম্যাচটির পর, রাতের অন্য ম্যাচগুলোও আকর্ষণীয় ছিল, তবে বিশেষ করে গুনথার এবং জে ইউসোর যুদ্ধ খুবই মনোযোগ আকর্ষণ করে। গুনথারের একটি দুর্দান্ত পারফরম্যান্স তাকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে, যা সম্ভবত রেসলমেনিয়ার ভবিষ্যৎ ম্যাচগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
এদিনের অন্যতম বড় ঘটনা ছিল জে ইউসোর দাপুটে জয়, যেখানে তিনি গুনথারকে পরাস্ত করে বিশ্ব হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়নশিপ অধিকার করেন। এটি ছিল জে ইউসোর ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় সিঙ্গলস টাইটেল জয়, যা তাকে ‘ব্লাডলাইন’-এর ছায়া থেকে বের করে নিয়ে আসে।
ইউসো এই জয়ে পুরো বিশ্বকে দেখিয়ে দিলেন যে, তিনি ব্যক্তিগতভাবে শীর্ষে উঠতে পারেন। ‘ইট ঝড়ের’ পর এই ম্যাচের মাধ্যমেই তিনি যেন তার ‘মেইন ইভেন্ট’ তকমার স্বার্থকতা দেন।
এদিকে, জে ইউসোর পরবর্তী পরিকল্পনাও একটু রহস্যময় হয়ে উঠেছে। ‘কী হতে যাচ্ছে রেইন্সের পর? জে ইউসো কি আবার রোমান রেইন্সের পাশে ফিরবেন, না কি তিনি নিজের পথ নিজেই তৈরি করবেন?’—প্রশ্নগুলো বর্তমানে সব রেসলিং ভক্তদের মনোযোগ আকর্ষণ করছে।
এ ছাড়া, জ্যাকব ফাতু তার রেসলমেনিয়া অভিষেকে স্মরণীয় একটি জয় তুলে নেন। এলএ নাইটকে হারিয়ে তিনি নতুন ইউনাইটেড স্টেটস চ্যাম্পিয়ন হন। স্যামোয়ান পাওয়ার হাউস হিসেবে ফাতুর এ জয় ছিল সত্যিই অত্যন্ত প্রভাবশালী, যেখানে তার আক্রমণাত্মক খেলা পুরোপুরি প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি ছিল।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ ছিল টিফানি স্ট্র্যাটন এবং শার্লট ফ্লেয়ারের মধ্যে। স্ট্র্যাটন ডাব্লিউডাব্লিউই উইমেন্স চ্যাম্পিয়নশিপ সফলভাবে প্রতিরোধ করেন, যেখানে ফ্লেয়ারের অভিজ্ঞতা ছিল, কিন্তু স্ট্র্যাটন তার কঠিন পারফরম্যান্সের মাধ্যমে নিজেকে শীর্ষস্থানীয় প্রতিযোগী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন।
প্রতিটি ম্যাচ ছিল অত্যন্ত সুচিন্তিত, যেখানে আবেগ, গল্প ও টেকনিক্যাল পারফরম্যান্স একসঙ্গে মিশে দর্শকদের একটি দর্শনীয় অভিজ্ঞতা উপহার দিয়েছে—যা প্রমাণ করে রেসলমেনিয়ার আসল মানে কী।
এখন নজর দেওয়া যাক নাইট ২–এর ম্যাচগুলোর দিকে। এটি আরও স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে যে, নাইট ২–এর ম্যাচগুলোও খুবই উত্তেজনাপূর্ণ হতে যাচ্ছে। এর মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ হতে যাচ্ছে সদ্যই নিজেকে হিল অর্থাৎ ভিলেন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা জন সিনা এবং দি আমেরিকান নাইট্মেয়ার কোডি রোডস–এর মধ্যে অনুষ্ঠিতব্য অন্ডিসপিউটেড ডাব্লিউডাব্লিউই চ্যাম্পিয়নশিপ।
রেসলিং-এর সবচেয়ে বিখ্যাত ও গুরুত্বপূর্ণ এ পুরস্কারের জন্য দুই প্রজন্মের শীর্ষ তারকার এই কঠিন টক্কর নিঃসন্দেহে এ বছরের সবচেয়ে বড় হাইপ তৈরি করেছে।
তবে র্যান্ডি অরটন ও কেভিন ওউয়েন্সের ফ্যানরা এদিন কিছুটা হলেও আশাহত হবেন। র্যান্ডির প্রাক্তন বন্ধু ও প্রতিপক্ষ কেভিন সম্প্রতি ঘাড়ের চোটে পড়ায় চিকিৎসকদের পরামর্শে তাকে বিরতি দেওয়া হয়েছে বলে বিভিন্ন ক্রীড়া প্রতিবেদনে জানানো হয়। ফলে নির্ধারিত প্রতিপক্ষ অংশ নিতে পারেননি এবং এই সুযোগে নতুন কারো চমকপ্রদ আগমন ঘটতে পারে বলে ধারণা।
নাইট ২–এর ম্যাচ কার্ড
১. আন্ডিসপিউটেড ডাব্লিউডাব্লিউই চ্যাম্পিয়নশিপ: কোডি রোডস বনাম জন সিনা
২. ডাব্লিউডাব্লিউই উইমেন্স ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ (ট্রিপল থ্রেট): ইও স্কাই বনাম রিয়া রিপলি বনাম বিআঙ্কা বেলেয়ার
৩. উইমেন্স ট্যাগ টিম চ্যাম্পিয়নশিপ: লিভ মর্গান ও রাকেল রদ্রিগেজ বনাম লাইরা ভ্যালকিরিয়াম ও টিবিডি
৪. ইন্টারকন্টিনেন্টাল চ্যাম্পিয়নশিপ (ফেটাল ফোর ওয়ে): ব্রন ব্রেকার বনাম ডমিনিক মিস্টেরিও বনাম পেন্টা বনাম ফিন বালোর
৫. সিন সিটি স্ট্রিট ফাইট: ড্যামিয়ান প্রিস্ট বনাম ড্রিউ ম্যাকইনটায়ার
৬. এজে স্টাইলস বনাম লোগান পল
৭. র্যান্ডি অরটন বনাম টিবিডি
নাইট ১–এর উত্তেজনা নিয়ে গুঞ্জন এখনো থামেনি। নাইট ২–এর জন্য ভক্তরা অপেক্ষা করছেন একাধিক বড় ম্যাচের দিকে, যেখানে সেরা রেসলাররা একে অপরকে চ্যালেঞ্জ করবে।
আপনার মতামত লিখুন :