ঢাকা বুধবার, ২৭ নভেম্বর, ২০২৪

পালিয়েছেন নিপুণ, মেয়ের খরচ চালান শেখ সেলিম

রুহুল আমিন ভূঁইয়া

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৪, ২০২৪, ১১:২৮ এএম

পালিয়েছেন নিপুণ, মেয়ের খরচ চালান শেখ সেলিম

ছবি: সংগৃহীত

ঢাকাই সিনেমার বহুল বিতর্কিত নায়িকা নিপুণ আক্তার। হাসিনা সরকার পতনের পর একের পর এক বেরিয়ে আসছে তার বিতর্কিত সব কর্মকাণ্ড। সরকার পতনের পর থেকে আত্মগোপনে রয়েছেন তিনি। বন্ধ রয়েছে তার বনানীর প্রসাধনী ও লাইফ-স্টাইলকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠান ‘টিউলিপ নেইলস অ্যান্ড স্পা’ পার্লারটি। কোথাও নেই নিপুণের খোঁজ। পার্লারে গিয়েও তার হদিস পাওয়া যায়নি। বর্তমানে পার্লারটি বন্ধ রয়েছে।

এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ১০ আগস্ট সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন নিপুণ আক্তার। এদিন সকাল ৯টা ৫০ মিনিটে বিমান বাংলাদেশের একটি ফ্লাইটে লন্ডনের উদ্দেশ্যে দেশ ছেড়েছেন তিনি। বৈধ ভিসা নিয়ে সেখানে অবস্থান করছেন নিপুণ।

দেশ ছাড়ার আগে সুলতানা নামক একজন মহিলার সঙ্গে ৪৬ মিনিট ফোনে কথা বলেন নিপুণ। সুলতানা নিপুণের পার্লারে চাকরি করে। তার অবৈধ কাজে সহযোগিতা করত বলে জানা গেছে। নিপুণের পার্লারে যাতায়াত ছিল বেশ কয়েকজন নায়িকার। তাদের মধ্যে কেউ কেউ তার প্যানেল থেকে শিল্পী সমিতির নির্বাচনেও অংশ নিয়েছিল। এফডিসিতে প্রভাব বিস্তারে নিপুণকে সহযোগিতা করতেন প্রযোজক খোরশেদ আলম খসরু, চিত্রনায়ক ফেরদৌস, রিয়াজ আহমেদ, জেসমিন, মোহাম্মদ হোসেন প্রমুখ। প্রথমদিকে চিত্রনায়ক সাইমন সাদিক সহযোগিতা করলেও পরবর্তীতে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব হলে সরে আসেন তিনি। এরপর থেকে নিপুণের সঙ্গে সাইমনের দূরত্ব বাড়তে থাকে।

বাবার বন্ধু শেখ সেলিমের সঙ্গে নিপুণের দেড় যুগেরও বেশি সময় ধরে অবৈধ সম্পর্ক। বনানীর এফ ব্লকের চার নম্বর রোডের আট নম্বর বাসায় নিয়মিত শেখ সেলিমের সঙ্গে দেখা করতেন নিপুণ। মাঝে মধ্যেই সেই বাড়িতে নিপুণ রাত যাপন করতেন বলেও খবর রয়েছে। আর যেদিন থাকতেন না সেদিন চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা কাটিয়ে বেরিয়ে আসতেন তিনি। সরকার পতনের দিনও রাত ৮টা ২৬ মিনিট ১৬ সেকেন্ডে শেখ সেলিমের সঙ্গে কথা বলেন নিপুণ। সম্পর্কের খাতিরে এই শেখ সেলিমকে দিয়ে বিভিন্ন টেন্ডার পাস করাতেন নিপুণ। এফডিসির কমপ্লেক্স নির্মাণেও রাজউক থেকে মোটা অংকের কমিশন নেওয়ার কথা জানা গেছে। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ রাজউকের কোনো টেন্ডার বা চুক্তি নিপুণের ইশারা ছাড়া পাস হতো না। প্রতিদিনই এই নায়িকার রাজউক ভবনে যাতায়াত ছিল।

নিপুণের ক্যারিয়ারে সেভাবে ব্যবসা সফল সিনেমা না থাকলেও করছেন রাজকীয় জীবন-যাপন। মূলত শেখ ফজলুল করিম সেলিমের ছত্রছায়ায় নিপুণ হয়ে উঠেন অপ্রতিরোধ্য। বাবার বন্ধু পরিচয় দিলেও শেখ সেলিমের সঙ্গে রয়েছে অনৈতিক সম্পর্ক। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে করেছেন গাড়ি, বাড়িসহ অনেক সম্পদ। শেখ সেলিমের টাকা দিয়েই মেয়ে তানিশাকে বিদেশে পড়াশোনা করাচ্ছেন নিপুণ।

এমপি হতে চেয়েছিলেন নিপুণ : নিপুণ আক্তার দীর্ঘদিন ধরেই স্বপ্ন দেখছিলেন সংসদ সদস্য হওয়ার। শেখ সেলিমও চেয়েছিলেন ‘প্রিয়তমা’ নিপুণকে এমপি করতে। তবে রাজনৈতিক অঙ্গনে পরিচয় না থাকার কারণে নিজেকে জানান দিতে শেখ সেলিমের পরামর্শে নিপুণ অংশ নেন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচনে। ২০২২ সালের নির্বাচনে বিগত দুইবারের সাধারণ সম্পাদক জায়েদ খানের কাছে হেরে যান নিপুণ। তার বেশকিছু ভোট বাতিল হলে পুনরায় গণনার জন্য আপিল করেন। সেখানেও হেরে যান তিনি। হেরেও হারেন না নিপুণ।

এরপর মামলা করে অবৈধভাবে সাধারণ সম্পাদকের চেয়ার দখল করেন তিনি। এই অনিয়ম মুখ বুঝে সহ্য করেছিলেন সমিতির সাবেক সভাপতি ইলিয়াস কাঞ্চন। কারণ, প্রতিটি মিটিংয়ে অংশ নেওয়ার জন্য নিপুণের থেকে তার ৫ হাজার টাকা কনভেন্স নেওয়ার খবর পাওয়া গেছে। শিল্পী সমিতি থেকেই নিজের ব্যক্তিগত মিটিং সারতেন নিপুণ। এ সময় অনিয়মকে নিয়ম আর নিয়মকে অনিয়মের খেলায় মাতেন তিনি। দ্বিতীয়বারের মতো সাধারণ সম্পাদকের পদে নির্বাচনে অংশ নিয়ে মনোয়ার হোসেন ডিপজলের কাছে নিপুণের ভরাডুবি হয়। কিন্তু দমে যাননি নিপুণ। ফের আদালতে মামলা করে ডিপজলের দায়িত্ব পালনে বাধা প্রয়োগ করেন। যদিও পুনরায় ডিপজল চেয়ার ফিরে পান। তার কিছুদিন না যেতেই হাসিনা সরকারের পতন হয়। এরপর থেকেই লাপাত্তা নিপুণ। বিপাকে তার পার্লারের কর্মচারীরা। জানা গেছে, কর্মচারীদের বেশ কয়েক মাসের বেতন বকেয়া রয়েছে।

শিল্পী সমিতির বাঁকা নজরে নিপুণ : শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক পদে পুনরায় নির্বাচন চেয়ে নিপুণ আক্তার ডিপজল প্রসঙ্গে বিস্ফোরক মন্তব্য করেছিলেন এক গণমাধ্যমে। এ জন্য তার বিরুদ্ধে চলচ্চিত্রের সিনিয়র ও জুনিয়র শিল্পীরা নিপুণের ছবিতে গলায় জুতার মালা পরিয়ে ব্যানার নিয়ে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে এফডিসিতে মিছিল করেন সাধারণ শিল্পীরা। বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ডিপজলের বিরুদ্ধে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করায় নিপুণকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় শিল্পী সমিতি। তিনটি চিঠির মধ্যে দুটির উত্তর সন্তোষজনক নয় বলে জানিয়েছে শিল্পী সমিতি। সম্প্রতি শেখ সেলিমের ইস্যুতে বেরিয়ে আসে নিপুণের হাঁড়ির খবর। নিপুণকে জয়ী করতে শেখ সেলিম ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ২০২২ সালের প্রধান নির্বাচন কমিশনকে বল প্রয়োগ করেছেন এবং বিভিন্ন হুমকি দিয়েছিলেন বলে পীরজাদা শহীদুল হারুন সম্প্রতি জানিয়েছেন। নিপুণের কর্মকাণ্ডে প্রশ্নবিত্ত গোটা শিল্পী সমাজ। নিপুণকে নিয়ে এখন নতুন করে ভাবছে শিল্পী সমিতি। সূত্রের খবর, শিল্পী সমিতির সদস্যপদ হারাচ্ছেন নিপুণ।

কে এই নিপুণ? নাসরিন আক্তার নিপুণ উচ্চমাধ্যমিকের পর ১৯৯৯ সালে রাশিয়া চলে যান। সেখানে মস্কো স্টেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০০৬ সাল পর্যন্ত নিপুণ তার স্বামী এবং এক মেয়ে তানিশার সাথে লস অ্যাঞ্জেলেসে থাকতেন। অনেকে আগেই স্বামীকে ডির্ভোসে দিয়েছিলেন তিনি। নায়িকার প্রাক্তন স্বামী মুহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন অপু গত আগস্টে অভিযোগ করেন নিপুণ ছিল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতা শেখ ফজলুল করিম সেলিমের রক্ষিতা। শেখ সেলিমের ভয় দেখিয়ে তাকে মেয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেন না নিপুণ।

নিপুণ অভিনীত প্রথম সিনেমা ‘রত্নগর্ভা মা’। কিন্তু সিনেমাটি আজও আলোর মুখ দেখেনি। ২০০৬ সালে এফ আই মানিক পরিচালিত ‘পিতার আসন’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে রুপালি পর্দায় পা রাখেন নিপুণ। এরপর বেশকিছু সিনেমায় অভিনয় করেছেন তিনি। তবে অধিকাংশ সিনেমায় দ্বিতীয় সারির নায়িকার চরিত্রে অভিনয় করেছেন। দ্বিতীয় সারির নায়িকা হলেও নিপুণ বিলাসী জীবনযাপন করছেন দীর্ঘদিন থেকে। সেলিমের সঙ্গে সম্পর্কে করে গড়েছেন ক্ষমতা এবং সম্পদ। তবে হাসিনা সরকার পতনের মধ্যে দিয়ে হয়েছে নিপুণের স্বপ্ন ভঙ্গ।

আরবি/জেআই

Link copied!