ঢাকা সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৪

তবলা বাদক থেকে টিভি চ্যানেলের মালিক তাপস

রুহুল আমিন ভূঁইয়া

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৫, ২০২৪, ০৬:১১ পিএম

তবলা বাদক থেকে টিভি চ্যানেলের মালিক তাপস

কৌশিক হোসেন তাপস। ছবি: সংগৃহীত

গায়ক-সুরকার-সংগীত পরিচালক ও গান বাংলা চ্যানেলের প্রধান নির্বাহী কৌশিক হোসেন তাপস। দেশের সংস্কৃতি অঙ্গনের প্রভাবশালী শিল্পী তিনি। আওয়ামী সংস্কৃতি অঙ্গনের আস্থাভাজন হিসেবে বেশ পরিচিত তাপস। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সাবেক ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি আশরাফুল আলম খোকনের মাধ্যমে শেখ হাসিনার কাছাকাছিও পৌঁছে যান তিনি। ফলে সরকারি প্রায় সকল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড আয়োজনের দায়িত্বও পেতেন তাপস।

একটা সময় সামন্য বেতনে চাকরি করে এবং প্রাইভেট পড়িয়ে জীবন চালিয়েছেন তাপস। তবে এখন কোটি-কোটি টাকার মালিক তিনি। অর্থের জোরে হয়েছেন মিডিয়া মুঘল। দেশের একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের ছিলেন তবলা বাদক। বেতনও ছিল কম। যা দিয়ে জীবিকা নির্ভর করা কঠিন ছিল। গানের সঙ্গে যুক্ত থাকায় গানের জগতে নিজের জায়গা তৈরির চেষ্টা চালিয়ে যান তাপস। কথিত এই মিডিয়া মুঘল উপরে উঠার সিড়ি পেয়ে যান স্ত্রী ফারজানা মুন্নীর মাধ্যমে।

রূপচর্চা ও ফ্যাশন এক্সপোর্ট হিসেবে দেশে বিদেশে পরিচিত ফারজানা মুন্নী। ধনাঢ্য এই নারী জড়িত নানা ব্যবসার সঙ্গে। কথিত রয়েছে, মুন্নী নানা অনৈতিক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তার এই অপকর্মে সহযোগিতা করতেন তাপস। মুন্নীর প্রথম ঘরের মেয়েকে প্রাইভেট পড়াতেন তাপস। সেই সুবাদে নিয়মিত দেখা হতো তাদের। একটা সময় তাপস মুন্নীকে আকৃষ্ট করে। তাদের মধ্যে শুরু হয় অসম প্রেম। অবাধ মেলামেশার এক পর্যায়ে তারা বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন। একাকিত্ব ঘোচাতে তাপসকে জীবন সঙ্গী করেন মুন্নী। বিয়ে পর খুলে যায় এই গায়কের ভাগ্য।

তাপস ও মুন্নী। ছবি: সংগৃহীত

বর্তমান গানবাংলা চ্যানেলটি আবৃত্তিশিল্পী রবিশঙ্কর মৈত্রীর হলেও জোর করে ভাগিয়ে নেন তাপস। ২০১১ সালের ২৪শে অক্টোবর তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে গানবাংলা টেলিভিশনের লাইসেন্স পান রবিশঙ্কর। ২০১২ সালের পহেলা জুলাই কৌশিক হোসেন তাপস আর ফারজানা আরমান মুন্নী আশি লাখ টাকায় শেয়ার হোল্ডার হিসেবে গান বাংলায় যুক্ত হয়েছিলেন। একটা সময় রবিশঙ্করকে মিথ্যা মামলা দিয়ে গান বাংলার সবকিছুই নিজের করে নেন তাপস-মুন্নী। চ্যানেলটি পেতে সহযোগিতা করেছিল তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী হাসান মাহমুদ ও শেখ হাসিনার সাবেক ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি আশরাফুল আলম খোকন।

চ্যানেলটি সামনে রেখে তাপস নানা অপকর্ম করতেন বলে জানা যায়। কথিত রয়েছে, স্ত্রী ছাড়াও একাধিক নারীতে আসক্ত ছিলেন তাপস। ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে ভাইরাল হয় তাপসের সঙ্গে সমালোচিত চিত্রনায়িকা শবনম বুবলীর গোপন প্রেমের খবর। এটি প্রকাশ করেন তাপসের স্ত্রী মুন্নী। সেসময় তিনি দাবি করেছিলেন, বুবলী তার স্বামীর সঙ্গে প্রেম করছেন। শুধু তাই নয়, তাপসের সন্তানের মা হওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে বুবলী। অপু বিশ্বাসের সঙ্গে কথোপকথনের একটি অডিও বার্তায় এই চাঞ্চল্যকার তথ্য দেন মুন্নী।

যে রাতে মুন্নী নিজের ফেসবুকে তাপস-বুবলীর প্রেমের খবর জানিয়ে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন তখনো গান বাংলায় তাপসের সঙ্গে একান্ত সময় কাটাচ্ছিলেন বুবলী। সেসময় ভিডিও কল দিলে দৌড়ে গিয়ে বাথরুমে লুকান বুবলী। যদিও পরবর্তীতে মুন্নী জানান, তার ফেসবুক আইডি হ্যাক হয়েছে এবং অপু বিশ্বাসের ঘাড়ে দায় চাপান। বুবলীকে দামি ফ্ল্যাট দেওয়ার কথাও জানা যায়। সেখানেও তারা একান্তে সময় কাটাতেন বলে চাউর রয়েছে। সমালোচনা থেকে তাপসকে বাঁচালেও বুবলীর সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা বিনোদন জগতের অন্তরমহলে কান পাতলেই শোনা যায়।

মূলত ‘খেলা হবে’ নামের সিনেমার ঘোষণা দেন তাপস। সেই সিনেমায় নায়িকা করা হয় বুবলীকে। সিনেমাটির সূত্র ধরেই তাপস-বুবলীর ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর আত্মগোপনে তাপস। অনিশ্চিয়তায় ‘খেলা হবে’।

সানি লিওন ও তাপস। ছবি: সংগৃহীত

আট বছর বয়সে কৌশিক হোসেন তাপসের প্রথম সঙ্গীত অ্যালবাম ‘পাখিদের পাঠশালা’ প্রকাশিত হয়। তিনি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্রডকাস্টিং আর্টস এ পড়ালেখা করেন। তিনি শিশু একাডেমিতে গান শেখেন এবং ছায়ানট থেকে লোক সংগীত শেখেন। তাপস ২০১৩ সালে ‘পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেম কাহিনী’ চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ সুরকার বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন।

এছাড়াও ২০১৮ সালে তিনি শ্রেষ্ঠ বাংলাদেশী সুরকার এবং গায়ক হিসেবে দাদাসাহেব ফালকে সম্মানসূচক খেতাব অর্জন করেন। তিনি বর্তমানে গান বাংলা টিভির সিইও এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্বরত আছেন। তাপস ‘ওয়ান মোর জিরো কমিউনিকেসশন’, ‘দ্য ফুয়েল স্টেশন লেভেল’ এবং ‘টিএম প্রোডাকশন’ নামে তিনটি কোম্পানি গঠন করেন।

তার হাত ধরে বাংলা গানের জগতে উইন্ড অব চেঞ্জেস (পরিবর্তনের হাওয়া) নামে সংগীতের একটি ফ্লাটফর্ম তৈরি হয়, যা দেশ বিদেশে ব্যাপক আলোচিত হয়। তিনি এখন টিএম রেকর্ডস নামে অডিও কোম্পানি গঠন করেছেন। যেখান থেকে মাইলস ব্যান্ডের হামিম আহমেদ, ঐশী, লুইপা, আরিফিন রুমি, এস আই টুটুল, দোলা, আনিকা সহ অনেকের গান মুক্তি পেয়েছে।

চিত্রনায়িকা বুবলী। ছবি: সংগৃহীত

অভিযোগ রয়েছে, প্রভাব খাটিয়ে সংগীত অঙ্গন রাজত্ব করছিলেন তাপস। দেশের পটপরিবর্তনের পর বেরিয়ে আসছে তাকে ঘিরে একের পর এক চাঞ্চল্যকর খবর। এরপর তোপের মুখে পড়েন এই শিল্পী। জনরোষ থেকে বাঁচতে গা ঢাকা দিয়েছেন তিনি। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাকে ছেড়ে কথা বলছেন না নেটিজেনরা। তার বিরুদ্ধে রয়েছে কর ফাঁকির অভিযোগও।

২০২২ সালের মার্চে নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ঢাকায় সানি লিওনকে আনেন তাপস। জয় বাংলা’সহ আওমাী লীগের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কনসার্ট করে কোটি-কোটি টাকা হাতিয়েছেন তিনি। দেশের জনপ্রিয় সংগীতশিল্পীদের অধিকাংশ শিল্পীই তাপসের পেছনে পেছনে ঘুরতেন বড় আয়োজনে গান করার আসায়। তাপসের অনেক অপকর্মের ফিরিস্তি এখনও অন্তরালে রয়ে গেছে। তাই সংস্কৃতিমনা নাগরিক তার বিরুদ্ধে অধিকরত তদন্তের দাবি জানিয়েছেন।

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!