বিশ্বের বেশির ভাগ দেশের চলচ্চিত্রে সেন্সর-প্রথা নেই; সার্টিফিকেশন বোর্ড রয়েছে। তবে এখনো ঢাকার সিনেমায় সেন্সর-প্রথা রয়ে গেছে। সেন্সর বোর্ডের নিয়ম বাতিল করে সার্টিফিকেশন বোর্ডে রূপান্তরের কথা দীর্ঘদিন ধরেই বলছেন চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা। শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর নতুন করে সেন্সর-প্রথা বাতিলে সরব হয়েছেন এ অঙ্গনের মানুষেরা।
সম্প্রতি ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মতোই বিদ্যমান আইনকে পাশ কাটিয়ে নতুন সেন্সর বোর্ড গঠন করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। যা নিয়ে শিল্পী, কলা-কুশলী, নির্মাতাসহ চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা সমালোচনায় সরব হয়েছেন।
চলচ্চিত্র নির্মাণ না করেও সেন্সর বোর্ডের সদস্য পদে জায়গা পেয়েছেন নাট্যনির্মাতা আশফাক নিপুণ। যদিও তিনি সদস্য পদে থাকবেন না বলে এরই মধ্যে জানিয়েছেন। তিনিও সেন্সর-প্রথা বাতিলের পক্ষে।
১৫ সেপ্টেম্বর তিনটি প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করে সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়। যেখানে নির্মাতা আশফাক নিপুণ ও অভিনেত্রী কাজী নওশাবা আহমেদকে পাওয়া গেছে দুটি বোর্ডের সদস্য হিসেবে; শিল্পী কল্যাণ ট্রাস্ট ও চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডে। বেশিরভাগের প্রশ্ন, দেশে যোগ্য লোকের এতই সংকট যে, নিপুণ-নওশাবাকে একই দিনে প্রকাশিত একাধিক কমিটিতে রাখতে বাধ্য হলো সরকার! এ ছাড়া বোর্ডের অন্য সদস্যদের নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
সেন্সর-প্রথা বাতিল চেয়ে মঙ্গলবার (১৭ সেপ্টেম্বর) দুপুরে বিএফডিসিতে সংবাদ সম্মেলন করেছে চিত্রকর্মীরা। এসময় পরিচালক সমিতির মহাসচিব শাহীন সুমন বলেন, ‘চলচ্চিত্রের মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি সেন্সর বোর্ড বাতিল করে সেন্সর সার্টিফিকেশন করার। আমরা সেন্সরের গ্যাঁড়াকলে থাকতে চাই না। মুক্ত স্বাধীন চলচ্চিত্র চাই। নতুন সূর্যের আলোকে প্রত্যাশা করেছিলাম অন্তর্বর্তী সরকার আলোকিত সার্টিফিকেশন বোর্ড গঠন করবে। তবে অতীতের মতো সেন্সর বোর্ডের প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছে। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে এই প্রজ্ঞাপনে চলচ্চিত্রের গুণীজনদের অবজ্ঞা করা হয়েছে। চলচ্চিত্রের গুণী ও অভিজ্ঞদের সম্পর্কিত করলে আরও বেশি সুন্দর হতো। সামনে সার্টিফিকেশন বোর্ডে গুণীদের মূল্যায়ন করবে বলে বিশ্বাস করছি। যদি সেন্সর বোর্ডই রাখা হয় সেক্ষেত্রে চলচ্চিত্রের গুণীজনদের সম্পর্কিত করে পুনর্গঠন করলে আরও ভালো হবে।’
প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে চিত্রনায়ক ওমর সানী বলেন, ‘সেই পাকিস্তান আমল থেকে সেন্সর বোর্ড গঠন হয়ে আসছে। আমার প্রাণের দাবি-বাংলাদেশ চলচ্চিত্রে অনৈতিক কিছু হোক সেটা আমরা কেউ চাই না। যে চলচ্চিত্রগুলো দেশের জন্য ক্ষতিকর, মানুষের জন্য ক্ষতিকর, সেটা আমরা চাইব না। আমাদের চলচ্চিত্র একই জায়গায় বন্দি হয়ে আছে। পাঁচটা ফাইট, পাঁচটা ড্যান্স একই ধারায় আছে। বিগতদিনে এটার পরিবর্তন করার চেষ্টা করেছি। এটা দেখানো যাবে না, ওটা দেখানো যাবে না। একই জিনিস দর্শক আর কত দেখবে? ভালোকে ভালো আর মন্দকে মন্দ যদি দেখাতে না পারি, তা হলে দর্শক কেন দেখবেন?’
নবগঠিত সেন্সর বোর্ডের অনেক সদস্যকে চিনেন না ওমর সানী। তা উল্লেখ করে এই অভিনেতা বলেন, ‘দেখুন, সেন্সর বোর্ডের মেম্বার হওয়ার জন্য অনেক অভিজ্ঞতা দরকার। কিন্তু সেন্সর বোর্ডের বর্তমান কমিটির অনেককে আমি চিনিই না। এটা আমার ব্যর্থতাও হতে পারে। কেন চিনব সেটাও আমার এক ধরণের প্রশ্ন। আমরা সিনেমার মানুষেরাই যদি না চিনি। সেই আগের মতোই যদি হয়ে যায়, তাহলে পরিবর্তন বা পরিবর্ধন হয়ে লাভটা কি? আমি স্বপ্ন দেখি, আগামীর চলচ্চিত্র অনেক ভালো হবে। শুধু যে সেন্সর সার্টিফিকেশনটাই হবে সেগুলোর পাশাপাশি সিনেমাহলগুলোও বাড়ানো দরকার।’
চলচ্চিত্রের স্বাধীনতা চান চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক সামসুল আলম। তিনি বলেন, ‘গত ১৫ তারিখে সেন্সর বোর্ড পুনর্গঠন করা হয়েছে। আমাদের দীর্ঘদিনের দাবি, আমরা সেন্সর বোর্ড চাই না আমরা সেন্সর সার্টিফিকেশন চাই। আমাদের গ্রেডেশন করে দেয়া হোক। আমার জানা মতে, ২০২৩ সালে এটা নিয়ে সিদ্ধান্ত হয় এবং প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। আমরা চাই, একজন নির্মাতা তার মেধা দিয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করবে। আমরা চাই, রাষ্ট্রদ্রোহ কোনো বক্তব্য ছাড়া ও শালীনতার মধ্য থেকে বাস্তব চিত্র চলচ্চিত্রের পর্দায় তুলে ধরা হয়। আমরা চাই, চলচ্চিত্রের স্বাধীনতা চাচ্ছি।’
নবগঠিত সেন্সর বোর্ডের কমিটি দেখে হতাশ প্রযোজক সামসুল আলম। তার ভাষায়, ‘সেন্সর বোর্ড দেখে আমি হতাশ। দুই-চারজন ছাড়া যাদের নাম দেখলাম, তাদের একজন চলচ্চিত্র প্রযোজক। আমি উনাকে চিনি না। একজন মালেক আফসারির সিনেমা, একজন কাজী হায়াতের সিনেমা চলবে কি চলবে না এটা কে সিদ্ধান্ত দিবে এটা ভেবে দেখতে হবে। মাননীয় তথ্য উপদেষ্টার কাছে আমার বিনীত অনুরোধ, আমাদের দীর্ঘদিনের দাবি সেন্সর বোর্ড আমরা চাই না, সেন্সর সার্টিফিকেশন বোর্ড করা হোক। গ্রেটেশন করে দিন আমাদের চলচ্চিত্রকে। আর ওই গ্রেডেশন বোর্ডেও যারা থাকবেন তারা যেন চলচ্চিত্রের মানুষদের গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি হয়। তাদের নিয়ে যেন কেউ প্রশ্ন তুলতে না পারে। উনি কি সিনেমা বানিয়েছেন চলচ্চিত্রে উনার অবদান কি?’
এসময় আরো উপস্থিত ছিলেন প্রযোজক এ জে রানা, চলচ্চিত্র পরিচালক সায়মন তারিক, পরিচালক-প্রযোজক শিমুল প্রমুখ। বলে রাখা ভালো, গত ১৫ সেপ্টেম্বর সেন্সর বোর্ড পুনর্গঠন করে প্রজ্ঞাপন জারি করে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়। যেখানে নিপুণ ও নওশাবার সঙ্গে সদস্য হিসেবে রাখা হয় নির্মাতা জাকির হোসেন রাজু, খিজির হায়াত খান, তাসমিয়া আফরিন মৌ, লেখক মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন এবং চলচ্চিত্র প্রযোজক রফিকুল আনোয়ার রাসেলকে। পুনর্গঠিত সেন্সর বোর্ডে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সচিবকে চেয়ারম্যান এবং সেন্সর বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যানকে সদস্য সচিব করা হয়।
প্রজ্ঞাপন প্রকাশের পর তুমুল প্রশ্ন ওঠে গঠিত সেন্সর বোর্ড ও এর সদস্যদের নিয়ে। সোজা ভাষায় এই বোর্ডে স্থান পাওয়া বিগত বিপ্লবী তিন নির্মাতা আশফাক নিপুণ ও খিজির হায়াত খান এবং অভিনেত্রী কাজী নওশাবা আহমেদ তুমুল বিতর্কের মুখে পড়েন। বৃষ্টির মতো বিরোধিতা আসতে থাকে সোশ্যাল হ্যান্ডেলে। এছাড়া সিনেমা সেন্সরের জন্য এই তিন তরুণ মুখের যোগ্যতা/অভিজ্ঞতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। এর মধ্যে আশফাক নিপুণ এখনও আনুষ্ঠানিক কোনও সিনেমাও বানাননি। অন্য দুজনের সিনেমা জার্নিও সূচনা মাত্র। তীরের মতো এসব প্রশ্নে নিপুণ-নওশাবাদের বিঁধছিলেন মিডিয়ার মানুষরাই।
আপনার মতামত লিখুন :