ষাটের দশকে বাংলা চলচ্চিত্র দিয়েই তার অভিনয়ে যাত্রা শুরু। তবে প্রথমেই অভিনেত্রী নয় বরং একজন নৃত্যশিল্পী হিসেবে তার অভিষেক হয়। বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি অভিনেত্রী আনোয়ারা মুহিত। তবে সবাই তাকে চেনেন আনোয়ারা বেগম নামে।
নানামাত্রিক চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করে জীবন্ত কিংবদন্তি এই অভিনেত্রী পেয়েছেন তুমুল জনপ্রিয়তা। দর্শকের মধ্যে এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না, যিনি বলতে পারবেন আনোয়ারার হৃদয়স্পর্শী অভিনয় তাকেও আকর্ষণ করেনি। তার অভিনয়ে মুগ্ধ হয়েছেন এ দেশের সব শ্রেণির দর্শক।
নায়িকা চরিত্রে অভিনয় করলেও ভাবী, চাচি, শাশুড়ি ও মায়ের চরিত্রেই পর্দায় বেশি উপস্থিত হয়েছেন। তার সাবলীল অভিনয় মন ছুঁয়েছে আট থেকে আশির বৃদ্ধকেও। যিনি একসময় লাইট, ক্যামেরা আর অ্যাকশনের শব্দের মুখরতায় কেটে গেছে তার জীবনের বেশির ভাগ দিন! তবে এখন আর তার দাঁড়ানো হয় না লাইট-ক্যামেরার সামনে!
তবে অভিমান থেকে নয়, বার্ধক্যজনিত কারণে এখন অভিনয় থেকে দূরে তিনি। এখন চার দেয়ালের মধ্যে কাটছে তার দিন-রাত। এসময়টা বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে নিজের অভিনীত সিনেমাগুলো দেখছেন। এভাবেই কেটে যাচ্ছে তার বাসাবন্দি জীবন। আনোয়ারা এখনো এ দেশের মানুষের স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করেন। যদি মা হিসেবেও স্বার্থক এক অভিনেত্রীর কথা বলা হয়, তা তিনি।
আজ গুণী এই অভিনেত্রীর জন্মদিন। ১৯৫৪ সালের আজকের দিনে তিনি কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন। স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে জন্মদিন পালন করেন না অভিনেত্রী। তবে এর আগেও সেভাবে জন্মদিন পালন করতেন বলে জানা গেছে। আনোয়ারার একমাত্র মেয়ে রুমানা ইসলাম মুক্তি ও নাতি কারিমা দরদির সঙ্গে বসবাস করছেন তিনি। ঘরোয়াভাবেই জন্মদিন কাটছে বলে দৈনিক রূপালী বাংলাদেশকে জানিয়েছেন তার মেয়ে চিত্রনায়িকা মুক্তি। তিনি বলেন, ‘মা কখনো সেভাবে জন্মদিন পালন করে না। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে কেকই কাটে না। সাদামাটা ভাবেই দিনটি কাটছে। তবে বরাবরের মতো এবারও কোরআন খতম ও এতিমখানায় খাবার দেই। এবারও দিয়েছি। সবাই মায়ের জন্য দোয়া করবেন।’
সর্বশেষ বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি (বাচসাস)-এর পরিবার দিবসে অংশ নিয়েছিলেন আনোয়ারা। সেখানে খ্যাতিমান এই অভিনেত্রীকে সম্মাননা দেয় ঐতিহ্যবাহী এই সংগঠনটি।
ছয় শতাধিক চলচ্চিত্রের আনোয়ারা এত চরিত্রে অভিনয় করেছেন যে, দিন শেষে অধিকাংশ সিনেমাতেই নায়িকার চরিত্র নয়, আনোয়ারার হৃদয়স্পর্শী অভিনয়ই বেশি স্মরণে রেখেছেন দর্শক। ‘নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা’র ‘আলেয়া’ চরিত্রটিতে যে অনবদ্য অভিনয় করেছেন—সে তো কিংবদন্তিই হয়ে আছে। আনোয়ারা অসংখ্য মঞ্চ নাটকসহ টেলিভিশন নাটকেও অভিনয় করেছেন। মঞ্চে ‘নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা’ ছাড়াও ‘মায়ের কান্না’, ‘আমির আকরাম’ নাটকে অভিনয় করেছেন।
ষাটের দশকে বাংলা চলচ্চিত্রে আনোয়ারার আগমন ঘটে। তার চলচ্চিত্রে অভিষেক ঘটে একজন নৃত্যশিল্পী হিসেবে। ১৯৬১ সালে ৬ বছর বয়সে অভিনেতা আজিমের মাধ্যমে তিনি চলচ্চিত্রে আসেন। এ সময় তিনি পরিচালক ফজলুল হকের ‘আজান’ চলচ্চিত্রে প্রথম নৃত্যশিল্পী হিসেবে কাজ করেন।
নাচ শিখেছেন ওস্তাদ দেব কুমার-এর কাছে। চলচ্চিত্রটি মুক্তি দেওয়ার সময় এর নাম পরিবর্তন করে ‘উত্তরণ’ রাখা হয়। তবে ‘উত্তরণ’ চলচ্চিত্রটি পরে মুক্তি পায়নি। তার অভিনীত প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ‘নাচঘর’। এ চলচ্চিত্রেও তিনি নৃত্যশিল্পী হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা আবদুল জব্বার খান ছিলেন এ চলচ্চিত্রের পরিচালক। উর্দু ভাষার এ চলচ্চিত্রটি ১৯৬৩ সালে মুক্তি পায়।
একই বছরে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘প্রীত না জানে রীত’ চলচ্চিত্রেও নৃত্যশিল্পী হিসেবে ছিলেন। এর পরে তিনি বেশ কিছু উর্দু ও বাংলা চলচ্চিত্রে কাজ করেন। ১৯৬৪ সালে তিনি জহির রায়হানের ‘সংগম’ চলচ্চিত্রে প্রথম সহ-অভিনেত্রী হিসেবে অভিনয় করেন। ১৯৬৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘জানাজানি’ চলচ্চিত্রটি তার জীবনে একটি উল্লেখযোগ্য সিনেমা। ওই সিনেমাতে তার নায়ক ছিলেন শওকত আকবর। ১৯৬২-১৯৬৬ সালে তিনি মোট ১৯টি চলচ্চিত্রে বিভিন্ন পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয় করেন।
১৯৬৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘বালা’ নামের একটি চলচ্চিত্রে নায়িকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ‘নবাব সিরাজউদ্দৌল্লা’ চলচ্চিত্রটি ছিল আনোয়ারার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। এ চলচ্চিত্রে তিনি আলেয়া চরিত্রে অভিনয় করেন। তার বিপরীতে খ্যাতিমান অভিনেতা আনোয়ার হোসেন নবাব সিরাজউদ্দৌল্লা চরিত্রে অভিনয় করেন।
তৎকালীন সমগ্র পাকিস্তান জুড়ে চলচ্চিত্রটি অভাবনীয় ব্যবসা সফলতা লাভ করে। ব্যাপক জনপ্রিয়তার কারণে এ চলচ্চিত্রটি উর্দুতেও চিত্রায়িত হয়। এভাবে চলচ্চিত্রটি লাহোর, করাচি, কোয়েটা, মুলতান, পেশোয়ারে মুক্তির পরে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানেও আনোয়ারার নামধাম ছড়িয়ে পড়ে। এর পরে বহুবার নবাব সিরাজউদ্দৌর মঞ্চায়ন হয়েছে। আলেয়া চরিত্রে তিনি ছিলেন নির্ধারিত।
আনোয়ারার চলচ্চিত্র জীবনের আরও তিনটি উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র হচ্ছে ১৯৭৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ১৯৮২ মুক্তিপ্রাপ্ত ‘দেবদাস’ ও ১৯৮৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘শুভদা’। ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ চলচ্চিত্রটি ১৯৭৮ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অনুষ্ঠানে সেরা চলচ্চিত্র সহ ১০টি বিভাগে পুরস্কার লাভ করে। এর মধ্যে তিনি সেরা পার্শ্বচরিত্রে অভিনেত্রী হিসেবে পুরস্কার লাভ করেন।
এ চলচ্চিত্রে তিনি ‘ময়না বু’ চরিত্রে অভিনয় করেন। চাষী নজরুল ইসলামের ‘দেবদাস’ চলচ্চিত্রে তিনি চন্দ্রাবতী চরিত্রে অভিনয় করেন। একই পরিচালকের ‘শুভদা’ চলচ্চিত্রে তিনি কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেন। এ চলচ্চিত্রটি ১৯৮৭ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অনুষ্ঠানে সেরা চলচ্চিত্রসহ ১১টি বিভাগে পুরস্কার লাভ করেন। আনোয়ারা এ চলচ্চিত্রে ‘সেরা অভিনেত্রী’ হিসেবে পুরস্কার লাভ করেন।
১৯৭২ এর পরে তিনি ভাবী, চাচী, শাশুড়ি ও মায়ের চরিত্রেই বেশি উপস্থিত হয়েছেন। এই চরিত্রগুলোতেই তিনি বেশি সফল হয়েছেন বলে মনে করেন। ১৯৭৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘নয়নমনি’ চলচ্চিত্রে আনোয়ারা চাচিমা চরিত্রে প্রথম অভিনয় করেন। অধিকাংশ চলচ্চিত্রেই তিনি অভিনয় করেছেন মায়ের ভূমিকায়। ১৯৮৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘অন্তরে অন্তরে’ চলচ্চিত্রে আনোয়ারা সর্বপ্রথম দাদীমা চরিত্রে অভিনয় করেন।
আনোয়ারা তার প্রায় পঞ্চাশ বছরের অভিনয় জীবনে সাড়ে ছয়শ’র ও অধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে আনোয়ারা পেয়েছেন বহু পুরস্কার ও স্বীকৃতি। আটবার পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। ২০২২ সালে তাকে আজীবন সম্মাননা বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রদান করা হয়।
তার সবচেয়ে জনপ্রিয় চলচ্চিত্রগুলো হলো—‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ (১৯৭৮), ‘সুন্দরী’ (১৯৭৯), ‘সখিনার যুদ্ধ’ (১৯৮৪), ‘মরণের পরে’ (১৯৯০), ‘রাধাকৃষ্ণ’ (১৯৯২), ‘বাংলার বধূ’ (১৯৯৩) ‘অন্তরে অন্তরে’ (১৯৯৪) এবং ‘শুভদা’ (১৯৮৬) প্রভূতি।
১৯৭৮ সালে মুহিতুল ইসলাম মুহিতের সঙ্গে আনোয়ারার বিয়ে হয়। তাদের একমাত্র সন্তানের নাম রুমানা ইসলাম মুক্তি। তিনিও একজন অভিনেত্রী। বেশ কয়েকটি সিনেমায় অভিনয় করে তিনিও বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। ২০২২ সালে আনোয়ারা বেগম ব্রেইন স্ট্রোক করেন। এর আগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে তার স্বামী মহিতুল ইসলাম মারা যান। তিনিও দীর্ঘদিন ব্রেইনের সমস্যায় ভোগেন। আনোয়ারার মতো অবিকল্প অভিনেত্রী হালে না থাকার বাস্তবতা ইন্ডাস্ট্রি নিশ্চয় প্রতিনিয়ত টের পাচ্ছে।
আপনার মতামত লিখুন :