ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

ঋত্বিক ঘটক

স্রোতের বিপরীতে ছোটা এক সিনেমাওয়ালা

রূপালী প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ৬, ২০২৫, ১১:০৯ এএম
ঋত্বিক ঘটক

‘ভাবো, ভাবো, ভাবা প্র্যাক্টিস করো’-কথাটি তিনি প্রায়ই বলতেন। শুধু কি বলতেন? না। কাজের মাধ্যমে দেখাতেনও। নাটক আর চলচ্চিত্রের গল্পে, চিত্রপটে তিনি মানুষকে ভাবাতেন। ভাবতে শেখাতেন। তার গভীর জীবন দর্শন ছড়িয়ে দিতেন দর্শকদের মধ্যে। দর্শক সেই দর্শনে ডুবে যেতেন, সমালোচকরা বিশ্লেষণে মগ্ন হতেন। 

সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেনদের সঙ্গে একই কাতারে তার নাম উচ্চারিত হয়। বাংলা ভাষার চলচ্চিত্রে তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায় হয়ে আছেন। মাত্র ৭টি চলচ্চিত্র নির্মাণ করে তিনি যে অসামান্য খ্যাতি কুড়িয়েছেন, তা অবিশ্বাস্যও বটে! তিনি ঋত্বিক ঘটক। উপমহাদেশের অন্যতম সেরা নির্মাতা হিসেবে তাকে বিবেচনা করা হয়। স্রোতে গা না ভাসিয়ে তিনি ছুটে ছিলেন বিপরীতে। বিকল্প ধারার চলচ্চিত্রকে দাঁড় করানোর ক্ষেত্রে তার অসামান্য অবদান এখনো শ্রদ্ধাভরে স্মরণীয়।

সৃষ্টিতে উল্লাস খুঁজে পাওয়া এই ক্ষ্যাপা নির্মাতার চলে যাওয়ার দিন আজ। ১৯৭৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ঋত্বিক ঘটক না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন। ঋত্বিক ঘটকের জন্ম ১৯২৫ সালের ৪ নভেম্বর বাংলাদেশের ঢাকায়। তখন অবশ্য বাংলাদেশ ছিল না। ছিল ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি। রাজশাহীর মিয়াপাড়ায় তিনি বেড়ে উঠেছিলেন। পড়াশোনা করেছেন রাজশাহী কলেজ ও বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজে। এরপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শেষ করেন এমএ। 

.অত্যন্ত শিক্ষিত এবং সংস্কৃতি সমৃদ্ধ পরিবারে ঋত্বিক ঘটকের জন্ম। তার বাবা ছিলেন, একজন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। তবে তিনি কবিতা ও নাটক লিখতেন। শিল্প-সাহিত্যের ছোঁয়া তাই ছোট বেলাতেই পেয়েছেন ঋত্বিক ঘটক। তিনি যত বড় হয়েছেন, তত উপলব্ধি করেছেন শিল্প-সংস্কৃতির গুরুত্ব। নিজেকেও যুক্ত করেছেন এ সৃষ্টিময় ভুবনে।

এমএ কোর্স শেষ না করেই ঋত্বিক বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করেন। কারণ তার কাছে ডিগ্রির চেয়ে লেখক হওয়া বেশি জরুরি ছিল। দেশভাগ, ভাষা আন্দোলন ইত্যাদি নিয়ে তখন পুরো ভারতবর্ষে বিরাজ করছিল অস্থির পরিবেশ। দেশ ও মানুষের সেই প্রেক্ষাপট কলমের আঁচড়ে তুলে ধরতেন ঋত্বিক ঘটক। তৎকালীন বিভিন্ন পত্রিকায় লিখেছেন তিনি। 

ঋত্বিক ঘটক ছিলেন বামপন্থি রাজনীতির অনুরাগী। তার চিন্তা-ধারাও ছিল স্রোতের প্রতিকূলে। পত্র-পত্রিকায় লেখার পাশাপাশি নাটকে যুক্ত হন ঋত্বিক ঘটক। পঞ্চাশের দশকে তিনি নাটক লিখেছেন, পরিচালনা করেছেন এবং তাতে অভিনয়ও করেছেন। তার রচিত ও নির্দেশিত নাটকগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘চন্দ্রগুপ্ত’, ‘অচলায়তন’, ‘কলঙ্ক’, ‘দলিল’, ‘কত ধানে কত চাল’, ‘অফিসার’, ‘ইস্পাত’, ‘জাগরণ’, ‘জ্বলন্ত’, ‘জ্বালা’, ‘ডাকঘর নবান্ন’, ‘ঢেউ’, ‘সাঁকো’, ‘হযবরল’, ‘বিসর্জন’ ইত্যাদি। 

চলচ্চিত্রে তার অভিষেক ঘটে ১৯৫১ সালে। নিমাই ঘোষ পরিচালিত ‘ছিন্নমূল’ চলচ্চিত্র দিয়ে তিনি অভিনেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। একই চলচ্চিত্রে সহকারী পরিচালক হিসেবেও কাজ করেছেন। এক বছর পর অর্থাৎ ১৯৫২ সালে ঋত্বিক ঘটক পূর্ণাঙ্গ পরিচালক হিসেবে কাজ শুরু করেন। তার নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘নাগরিক’। তবে চলচ্চিত্রটি মুক্তি পেতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। এটি ১৯৭৭ সালে মুক্তির আলো দেখেছিল। 

ছয় বছর সময় নিয়ে ঋত্বিক ঘটক উপহার দেন তার দ্বিতীয় ও তৃতীয় চলচ্চিত্র ‘অযান্ত্রিক’ ও ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’। সমালোচক মহলে চলচ্চিত্র দুটি ব্যাপক প্রশংসিত হয়। যদিও ব্যবসায়িকভাবে তেমন সুবিধা করতে পারেনি এগুলো। তবে চলচ্চিত্র দুইটির গল্প, নির্মাণশৈলি ঋত্বিক ঘটককে আলাদা পরিচয় এনে দেয়। 

ষাটের দশকে ঋত্বিক ঘটক তিনটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। এগুলো হচ্ছে ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘কোমল গান্ধার’ ও ‘সুবর্ণরেখা’। এ তিনটি চলচ্চিত্রকে ঋত্বিক ঘটকের সেরা নির্মাণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এগুলোকে একসঙ্গে ঋত্বিক ঘটক ট্রিলজি হিসেবেও অভিহিত করা হয়। তিনটি চলচ্চিত্রে তিনি কলকাতার তৎকালীন রুঢ় বাস্তবতার চিত্র তুলে ধরেছিলেন। ফলে ব্যবসায়িক সাফল্য না পেলেও ব্যাপকভাবে আলোচিত ও প্রশংসিত হয়েছিলেন ঋত্বিক ঘটক। 

সত্তরের দশকে তার ক্যারিয়ারে আসে নতুন মোড়। একজন প্রযোজক তার কাছে আসেন ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র বানাতে। অদ্বৈত মল্লবর্মণ রচিত এই উপন্যাস ঘিরে একই নামে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন ঋত্বিক। ১৯৭৩ সালে মুক্তি পায় এটি। আর মুক্তির পর বাংলা চলচ্চিত্রের ধারায় নতুন একটি পথের সূচনা হয়। যে পথ ধরে পরবর্তী সময়ে অনেকেই হেঁটেছেন। এক জরিপে ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ চলচ্চিত্রটি বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা চলচ্চিত্রের স্বীকৃতি পায়। 

ঋত্বিক ঘটক পরিচালিত শেষ চলচ্চিত্র ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’। এটি মুক্তি পায় ১৯৭৭ সালে। এ চলচ্চিত্রে ঋত্বিক ঘটকের ব্যক্তি জীবনের অনেক কিছুই উঠে এসেছে। কারণ, এটা তার আত্মজীবনীমূলক চলচ্চিত্র। দেশভাগ, রাজনৈতিক পরিস্থিতি, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, নকশাল বাড়ি আন্দোলন এসব কিছু তিনি তুলে ধরেন এখানে। 

চলচ্চিত্র ঋত্বিক ঘটকের নেশা, ধ্যান-জ্ঞান সবই ছিল। তবে এ মাধ্যমকে তিনি প্রতিবাদের ভাষা হিসেবেও ব্যবহার করেছেন। তিনি চলচ্চিত্রের মাধ্যমে সমাজের অন্যায়-অবিচার ও বৈষম্য নিয়ে জোরালো প্রতিবাদ করেছেন। উঁচু, সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম নেওয়া ঋত্বিক সারাজীবন সমাজের নিচু শ্রেণির মানুষের অধিকার নিয়ে লড়েছেন। 

বাংলা ভাষার চলচ্চিত্রকে নতুন পথ দেখানো ঋত্বিক ঘটককে স্বীকৃতি দিতে ভুল করেনি ভারত সরকার। ১৯৭০ সালেই তাকে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত করা হয়। একই বছর তিনি ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ স্বর্ণপদক লাভ করেন। ১৯৭৪ সালে ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’ চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ গল্পকার হিসেবে ঋত্বিক ঘটক জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে রজত কমল পুরস্কার অর্জন করেন। 

১৯৭৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি মাত্র ৫০ বছর বয়সে চলে যান ঋত্বিক ঘটক। রেখে যান, অসামান্য এক শিল্প অধ্যায়। রেখে যান কিছু অসম্পূর্ণ কাজও। স্রোতের বিপরীতে ছুটে ঋত্বিক চলে গেলেও তার সৃষ্টিকর্ম এখনো উজ্জ্বলভাবে স্মরণীয়। উপমহাদেশের চলচ্চিত্র জগতে তার নির্মাণ গবেষণার এক সমৃদ্ধ ক্ষেত্র।