ঢাকা রবিবার, ১৬ মার্চ, ২০২৫

গানের জাদুকর কবীর সুমনের আজ জন্মদিন

বিনোদন ডেস্ক
প্রকাশিত: মার্চ ১৬, ২০২৫, ০৮:৫৮ পিএম
ছবি: সংগৃহীত

আজ কবীর সুমনের জন্মদিন। এই দিনটা সবারই সবসময় মনে থাকার কথা। ৯০-এর দশকে বাংলা গানকে নতুন পথ দেখিয়েছিলেন তিনি। বাংলা গানে নতুন জীবন নতুনভাবে আবিষ্কার করেছিলেন এ জাদুকর। তাকে সে সময়ের বাংলা গানের পথপ্রদর্শক বললেও ভুল বলা হবে না।

কবীর সুমন (জন্ম ১৬ই মার্চ, ১৯৪৯) একজন ভারতীয় বাঙালি গায়ক, গীতিকার, অভিনেতা, বেতার সাংবাদিক, গদ্যকার ও সাবেক সংসদ সদস্য। তার পূর্বনাম সুমন চট্টোপাধ্যায়। ২০০০ সালে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়ে তিনি তার পুরনো নাম পরিত্যাগ করেন। সুমন একজন বিশিষ্ট আধুনিক ও রবীন্দ্রসংগীত গায়ক। ১৯৯২ সালে তার তোমাকে চাই অ্যালবামের মাধ্যমে তিনি বাংলা গানে এক নতুন ধারার প্রবর্তন করেন। তার স্বরচিত গানের অ্যালবামের সংখ্যা বিশ এর উপরে। সংগীত রচনা, সুরারোপ, সংগীতায়োজন ও কণ্ঠদানের পাশাপাশি গদ্যরচনা ও অভিনয় ক্ষেত্রেও তিনি স্বকীয় প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। তিনি একাধিক প্রবন্ধ, উপন্যাস ও ছোট গল্পের রচয়িতা এবং হারবার্ট ও চতুরঙ্গ প্রভৃতি মননশীল ছবিতে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের রূপদানকারী। বিশিষ্ট বাংলাদেশি গায়িকা সাবিনা ইয়াসমিন তার বর্তমান সহধর্মিণী। নন্দীগ্রাম গণহত্যার পরিপ্রেক্ষিতে কৃষিজমি রক্ষার ইস্যুতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালিত আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে যোগদান করেন এবং সেই সূত্রে সক্রিয় রাজনীতিতে তাঁর আবির্ভাব ঘটে। ২০০৯ সালে তৃণমূল কংগ্রেসের টিকিটে যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্র থেকে দেশের পঞ্চদশ লোকসভা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন ও জয়লাভ করে ওই কেন্দ্র থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন।

প্রারম্ভিক জীবন
সুমন ১৬ ই মার্চ, ১৯৪৯ সালে সুরিন্দ্রনাথ এবং উমা চট্টোপাধ্যায় এর ঘরে উড়িষ্যার কটক এ জন্মগ্রহণ করেন। তিনি শৈশবে তার পিতার অধীনে ধ্রুপদী সঙ্গীতের প্রশিক্ষণ পান। তিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ালেখা করেছেন, ইংরেজী সাহিত্যে একটি স্নাতক ডিগ্রী এবং ফরাসী ভাষাতে একটি ডিপ্লোমা ডিগ্রী নিয়েছেন। তারপর তিনি অল ইন্ডিয়া রেডিওতে এবং ভারতের ইউনাইটেড ব্যাংকে সংক্ষিপ্তভাবে কাজ করেছিলেন। সুমন সত্তর দশকের মাঝামাঝিতে ইউরোপের জন্য দেশ ছেড়ে গিয়েছিলেন, এবং ভয়েস অফ জার্মানিতে(বাংলা বিভাগে) একজন রেডিও সাংবাদিক হিসেবে ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত কাজ করেছিলেন। এই পর্যায়কালটির সময় তিনি ফ্রান্সে বব ডিলান এর গান শুনেছিলেন, যেটি তার জন্য সর্বাপেক্ষা সুরেলা অভিজ্ঞতার একটি হয়েছিল।

সুমন তারপর ১৯৮০ সাল থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন, সেখানে ওয়াশিংটন ডিসিতে ভয়েস অফ আমেরিকার বাংলা ভাষা বিভাগের জন্য কর্মরত ছিলেন। এখানে, সুমন পিটার সীগার এবং মায়া আঙ্গেলউ সহ বেশ কিছু সংগীতধর্মী এবং সাহিত্যানুগ ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে এসেছিলেন। সুমন এছাড়াও আটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে নিকারাগুয়াতে সান্দিনিস্তা বিপ্লবে অত্যন্ত কৌতূহলী হয়ে উঠেছিলেন। সুমনকে পিটার সীগার তার বাবা এরনেস্ত চারদেনাল, একাধারে একজন পুরোহিত, কবি, মুক্তিযোদ্ধা এবং নিকারাগুয়ার সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী, এর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। চারদেনালের আমন্ত্রণে, সুমন ১৯৮৫ তে নিকারাগুয়া পরিদর্শন করেছিলেন। তিনি লিখেন যে, নিকারাগুয়াতে তিনি যা দেখেছিলেন তা তাকে অনেক প্রভাবিত করেছিল। এটাই সেই জায়গা যেখানে তিনি ল্যাটিন আমেরিকার নতুন গানের আন্দোলনের সংস্পর্শে আসেন।

রাজনৈতিক কার্যক্রম
সঙ্গীতে তার অবদানসমূহের পাশাপাশি, সুমন সবসময় বলিষ্ঠ রাজনৈতিক মতামত প্রকাশ করেন। তিনি সান্দিনিস্তা বিপ্লবের সময় নিকারাগুয়াতে একজন সাংবাদিক ছিলেন এবং তার অভিজ্ঞতা থেকে মুক্ত নিকারাগুয়া লিখেছিলেন। ২০০২ সালে গুজরাট দাঙ্গার সময়, প্রতিবাদে তিনি মৌলবাদের বিরুদ্ধে গান রচনা করেছিলেন। তাকে জনগণের রাজনৈতিক এবং মৌলিক অধিকারের পক্ষে অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভূমিকায় লক্ষ্য করা হয়।

২০০৬ থেকে, সুমন নন্দীগ্রামের জমির লড়াইতে সংশ্লিষ্ট হয়েছিলেন। তিনি তৃণমূল কংগ্রেসের সাথে এই লড়াই এর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন যার নেতৃত্বে ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নন্দীগ্রামের জমি বিষয়ে তার গানের দুটি অ্যালবাম, নন্দীগ্রাম এবং প্রতিরোধ। সুমন সিঙ্গুর আন্দোলনেও অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং নিয়মিত অন্যান্য টিএমসি অনুষ্ঠান এবং কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতেন। তিনি কলকাতা বই মেলা ২০০৯ এ টিএমসি এর স্টল উদ্বোধনের সময় উপস্থিত ছিলেন।

তৃণমূল কংগ্রেস কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গের যাদবপুর থেকে ২০০৯ এর সাধারণ নির্বাচনের জন্য তাঁকে মনোনীত করেছিল এবং নির্বাচনে তিনি জয়ী হয়েছিলেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দী ভারতের কম্যুনিষ্ট(মার্ক্সবাদী) দলের সুজন চক্রবর্তী ৫৪, ০০০ ভোটের পরাজিত হন।

নভেম্বর ২০০৯ এ, সুমনের তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে একটি বিরোধ হয়েছিল। তার অভিযোগ ছিল যে দলের স্থানীয় নেতারা তাকে তার কাজ করতে বাধা দিচ্ছিল। পার্টিতে তার অভিযোগ গুরুতরভাবে গ্রহণ করা হয়নি, উপরন্তু পর পর কয়েকটি রুদ্ধদ্বার বৈঠক করে ব্যাপারটি আপোষ করার চেষ্টা চলে।

সুমন তার কণ্ঠে লালগড়ের উপজাতিদের আন্দোলনে সমর্থন দিয়েছেন এবং আন্দোলনের সমর্থনে একটি অ্যালবাম রচনা করেছেন, যার নাম “ছাত্রধরের গান”। পার্টির ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে, “অপারেশন গ্রিন হান্ট” এর বিরুদ্ধে তিনি তার ক্ষোভ ব্যক্ত করেছেন।

সুমন, মার্চ ২০১০ এর শেষে, দাবী করেছিলেন যে তিনি তৃণমূল কংগ্রেস ছেড়ে দিতে যাচ্ছেন এবং পার্লামেন্টের তার সদস্যপদও। যদিও মহাশ্বেতা দেবীর অনুরোধে তিনি সাত দিনের জন্য তার ইস্তফা মুলতবি রেখেছিলেন কিন্তু এর অল্প দিনের মধ্যেই, ৭ এ এপ্রিলে তিনি ঘোষণা করেন যে তিনি পার্টিকে আরও বিব্রত করে পদত্যাগ করতে চান না। বর্তমানে তিনি তার বাক্তিগত ওয়েবসাইটের মাধ্যমে তার রাজনৈতিক মতামত প্রকাশ করেন।

সংগীত জীবন
তার সমকালীন শহুরে, সামাজিক সচেতনতামূলক গান উভয়েই বাংলা আধুনিক গানের এবং পশ্চিমী লোক গানের প্রভাব রয়েছে। তার কাজ বাংলা গানের উন্নতিসাধনে একটি প্রধান প্রভাব ফেলে, যেটি চন্দ্রবিন্দুর মত ব্যান্ডকে প্রভাবিত করেছে এবং সমকালীন বাংলা গানের আন্দোলনকে বৃদ্ধি করেছে। তার গানের বেশীরভাগ একটি সিন্থেসাইযার অথবা একটিমাত্র গিটার সঙ্গে নিয়ে একক ভাবে করা হয়। অন্যান্য বাংলা সঙ্গীতশিল্পীর মত সুমন ১৯৯০ সালে রবীন্দ্র সংগীতের অ্যালবামও রেকর্ড করেছেন।

সুমনের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত এবং রবীন্দ্র সংগীতের উপর ছিল এবং তিনি জার্মানে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অর্থাৎ বিদেশে বসবাস করার সময় পশ্চিমী লোক রূপ চয়ন করেছিলেন। ১৯৮৯ সালে জার্মান আন্তর্জাতিক রেডিওের সঙ্গে তার দ্বিতীয় চুক্তি শেষ করেছিলেন এবং কলকাতাতে ফিরে এসেছিলন। কলকাতাতে তিনি প্রথমে একটি ব্যান্ড ‘নাগরিক’ এর সঙ্গে যোগ দেন, এবং দুইটি অ্যালবাম “অন্য কথা অন্য গান (১)” এবং “অন্য কথা অন্য গান (২)” মুক্তি দিয়েছিলেন। এপ্রিলের ২৩ তারিখে, ১৯৯২ সালে তার প্রথম একক অ্যালবাম “তোমাকে চাই” মুক্তি পায়, যেটি প্রচণ্ডভাবে সফল ছিল। তারপর থেকে তিনি কুড়িটি অ্যালবামের ওপর মুক্তি দিয়েছেন।

প্রভাবসমুহ এবং উত্তরাধিকার
সুমনকে বাংলা গানের একটি নতুন গোত্র তৈরি করার জন্য কৃতিত্ব দেয়া হয়, যার কথাগুলো হল সাধারণ জীবনের অভিজ্ঞতার প্রতিফলন। তাকে নাগরিক কবিয়াল হিসেবে কখনও কখনও উল্লেখ করা হয়। কিছু জনগণ তার গান জীবনমুখী হিসেবে বিবেচনা করেন, যদিও তিনি এই শিরোনামটির মত করে ভাবেন না এবং সহজ আধুনিক বাংলা গান হিসেবেই তার কাজগুলোকে বিবেচনা করতে বলেন।

তার গান সামাজিক প্রথাগুলোকে প্রতিফলিত করে এবং প্রায়শই সরাসরিভাবে রাজনৈতিক আচার-আচরণকেও। সুমনকে বাংলা সংগীতের অনেক দীর্ঘ এবং গভীর ঐতিহ্য আকর্ষণ করে। তিনি নিবিষ্ট ছিলেন হালকা শাস্ত্রীয়, চলচ্চিত্র সঙ্গীত এবং লোক সহ একাধিক ঘরানার বিশেষণে। তিনি বব ডিলান, পিট সিগার, পল সাইমন, জন লেনন এবং অন্যান্য পশ্চিমী সঙ্গীতশিল্পীদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। তিনি বব ডিলানের “Blowin in the wind” গানটির বাংলা প্রতিলিপি “উত্তরও তো জানা” হিসেবে ১৯৯৩ সালে তার অ্যালবাম “ইচ্ছে হল” তে অন্তর্ভুক্ত করেন এবং ১৯৯৭ সালে “Farewell, Angelina” (প্রাথমিকভাবে ১৯৬৫ সালে জোয়ান বেইয দ্বারা রেকর্ডকৃত) গানটির প্রতিলিপি “বিদায় পরিচিতা” হিসেবে “জাতিস্মর” অ্যালবামে অন্তর্ভুক্ত করেন। তিনি আরও পল সাইমনের “Sounds of Silence” এর প্রতিলিপি হিসেবে “স্তব্ধতার গান” রচনা করেন। তিনি অনায়াসে বাঙ্গালী মেটালকে পাশ্চাত্য পপ/কান্ট্রি যন্ত্রানুষঙ্গের সঙ্গে সংযুক্ত করতে পারেন।

তার প্রথম দিকের অ্যালবামগুলিতে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার অনেক কম ছিল, প্রধানত ইলেকট্রনিক কীবোর্ড, গিটার এবং অনিয়মিত মাউথ অরগান ব্যবহার করতেন এবং মালটিট্রাক রেকর্ডিং এ তিনি নিজেই সব বাজাতেন। তিনি বাঙ্গালী শ্রোতাদের উপর যে প্রভাব ফেলেছিলেন তা প্রায় আমেরিকান শ্রোতাদের উপর বব ডিলান বীট জেনারেশন সময় যে প্রভাব ফেলেছিলেন তার সদৃশ। পরের অ্যালবামগুলো আরও বেশি বিস্তারিতভাবে সুবিন্যস্ত করা হয়েছিল, সম্পূর্ণ স্টুডিও অর্কেস্ট্রা এবং প্রায়ই ভারতীয় শাস্ত্রীয় বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার ছিল। তার বার্তা সবসময় ছিল খাঁটি ভারতীয়/বাঙ্গালী এবং সম্পূর্ণরূপে সমসাময়িক। বাংলা ভাষার উপর তাঁর অসাধারন দখল আর ভাষার ব্যবহার এবং তাঁর অনবদ্য রচনাশৈলী ভবিষ্যত প্রজন্মের সঙ্গীতশিল্পীদের প্রভাবিত করতে থাকবে। উচ্চারণের জন্য অনেকেই তাঁকে ‘উচ্চারণপ্রেমী’ বলেও সম্বোধন করেন।

সুমন, ৯০ এর পরের বাংলার গায়ক-সংগীতকারদের একটি প্রজন্মকে প্রভাবিত করেছেন, যার মধ্যে আছেন নচিকেতা চক্রবর্তী, অঞ্জন দত্ত, লোপামুদ্রা মিত্র, শ্রীকান্ত আচার্য ও চন্দ্রবিন্দু এর মত ব্যান্ড এবং আরও অনেকে।