ঈদ মানেই তো উৎসব, আর এ উৎসবের সবচেয়ে বড় রঙ হলো সিনেমা। ২০২৫ সালের ঈদুল ফিতরে মুক্তিপ্রাপ্ত বেশ কিছু বাংলা সিনেমা নিয়ে দর্শকদের আগ্রহ ছিল তুঙ্গে। নতুনত্ব, বড় বাজেট, তারকাবহুল কাস্ট আর আধুনিক নির্মাণশৈলীতে সিনেমাগুলো যেন একেকটা রুপালি ঝলক। বাংলা সিনেমা জগতে যেন লেগেছিল বহুল প্রতীক্ষিত ‘বক্স অফিস যুদ্ধ’। বড় তারকাদের অংশগ্রহণ, নতুন মুখের চমক, আর ভিন্নধর্মী গল্প নিয়ে মুক্তি পেয়েছিল বেশ কিছু আলোচিত সিনেমা। চলুন দেখে নিই, কোন কোন সিনেমা বক্স অফিস কাঁপিয়েছে, কারা অভিনয় করেছেন, কে নির্মাণ করেছেন, গল্পে কী ছিল আর দর্শকদের প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল।
১. বরবাদ
ঈদ মানেই শাকিব খানের দাপট, আর এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ‘বরবাদ’ সিনেমায় তাঁকে দেখা গেছে এক রগচটা, রাফ অ্যান্ড টাফ যুবকের চরিত্রে। যিনি দুর্নীতির শিকড় উপড়ে ফেলার শপথ নেন। পরিচালনা করেছেন মেহেদী হাসান হৃদয়। ‘আমি কারো বরাদ্দ না, আমি বরবাদ’—এ সংলাপ অলরেডি ভাইরাল।
ইধিকা পালের সঙ্গে শাকিবের অনস্ক্রিন রসায়ন বেশ সাড়া ফেলেছে। প্রযোজক এসকে ফিল্মস বলছে, প্রথম সপ্তাহেই সিনেমাটি দেশের প্রায় ১০ কোটি টাকার টিকিট বিক্রি করেছে। এ সিনেমা ১২০টি হলে মুক্তি পেয়ে এখন পর্যন্ত ঈদের ইতিহাসে সর্বোচ্চ স্কেলে রিলিজ পাওয়া সিনেমার রেকর্ড গড়েছে। পুরোনো ফর্মে কিং খানকে দেখে দর্শকরা বেশ উচ্ছ্বসিত।
২. অন্তরাত্মা
ঈদে শাকিবের আরেকটি সিনেমা ‘অন্তরাত্মা’ মুক্তি পেয়েছে। প্রেম, ত্যাগ আর পারিবারিক ড্রামার মিশেলে তৈরি এ ছবি খানিকটা ক্লাসিক ঢঙে নির্মিত। এখানে তাঁর বিপরীতে অভিনয় করেছেন দর্শনা বণিক। পরিচালনায় ওয়াজেদ আলী সুমন, আর প্রযোজনা করেছে শাপলা মিডিয়া।
সিনেমাটির গল্প এক নিঃসঙ্গ ব্যবসায়ীকে ঘিরে, যিনি জীবনের কষ্ট ভুলে নতুন করে শুরু করতে চান। যদিও গল্পে তেমন নতুন কিছু নেই, তবে গান আর সিনেমাটোগ্রাফিতে দর্শকদের চোখে লাগার মতো ব্যাপার ছিল। দর্শক প্রতিক্রিয়া খুব বেশি ভালো না হলেও বাংলার বাদশাহ খানের বদৌলতে ঠিকই ৪.৮ কোটি টাকা কামিয়ে নিয়েছে ছবিটি।
৩. দাগি
আফরান নিশো এরই মধ্যে ওয়েব সিরিজে নিজেকে প্রমাণ করেছেন। এবার ঈদে এসে বড় পর্দায় বাজিমাত করলেন ‘দাগি’ দিয়ে। শিহাব শাহীনের পরিচালনায় এ সিনেমা দুর্দান্ত সাসপেন্স থ্রিলার। চরিত্রটি সাবেক এক পুলিশ অফিসার, যিনি নিজেরই এক অন্ধকার অতীতে জড়িয়ে পড়েন।
তমা মির্জা ও সুনেরাহ বিনতে কামাল ছিলেন শক্তিশালী পার্শ্বচরিত্রে।
প্রযোজক সিএমভি জানিয়েছে, প্রথম সাতদিনেই প্রায় ৩.৫ কোটি টাকার টিকিট বিক্রি হয়েছে। ‘নিশোর অভিনয় টপ নচ ছিল’—এ মন্তব্য এখন সোশাল মিডিয়ায় ট্রেন্ডিং।
৪. জংলি
‘জংলি’ সিনেমায় সিয়াম আহমেদকে দেখা গেছে এক জঙ্গলের পরিবেশে বেড়ে ওঠা, বন্য স্বভাবের ছেলের চরিত্রে, যে শহরে এসে খুঁজে পায় নিজের পরিচয় আর ভালোবাসা। পরিচালক এম রহিম গল্পটিকে বানিয়েছেন আন্তর্জাতিক মানের ভিজ্যুয়াল ও সেটে।
শবনম বুবলী আর দীঘির সঙ্গে সিয়ামের কেমিস্ট্রি চোখে পড়ার মতো। কানিজ মাল্টিমিডিয়ার প্রযোজনায় নির্মিত এ সিনেমা মুক্তি পেয়েছে ১৬টি দেশে। এখন পর্যন্ত দেশে ২.৭ কোটি টাকার টিকিট বিক্রি হলেও, বিদেশে আয় আরও বেশি হতে পারে। বাংলাদেশি সিনেমা এত বড় স্কেলে কখনো দেখেননি- এমন দাবি করছেন অনেক দর্শক।
৫. জ্বীন ৩
ঈদে যারা একটু গা ছমছমে কিছু দেখতে চেয়েছেন, তাদের জন্য ছিল ‘জ্বীন ৩’। পরিচালক কামরুজ্জামান রোমান এবারের কিস্তিতে এনেছেন আধুনিক ভিএফএক্স আর নতুন গল্পের মোচড়। নতুন বাড়িতে পা রাখা এক দম্পতির অভিশপ্ত অতীত ঘিরে দানা বাঁধে মূল রহস্য।
নুসরাত ফারিয়া ও সজলের অভিনয় ছিল জমাট। ‘হলিউডের মতো না হলেও, ঢাকার ভৌতিক সিনেমার মানে একটা শিফট হয়েছে’—এ মন্তব্য এসেছে ইউটিউব চ্যানেল ‘সিনেমাপ্রেমী’র এক রিভিউয়ারের কাছ থেকে। এখন পর্যন্ত বক্স অফিস আয় প্রায় ২.১ কোটি টাকা।
৬. চক্কর ৩০২
যারা ঈদে একটু থ্রিল আর ইনভেস্টিগেটিভ মুড খুঁজেছেন, তাদের জন্য জমজমাট চমক নিয়ে হাজির হয়েছে ‘চক্কর ৩০২’। পরিচালক সোহেল আরমান থ্রিলারটিতে এনেছেন একটি খুনের তদন্তকে কেন্দ্র করে একের পর এক নাটকীয় মোচড়। রাজধানীর অভিজাত এলাকায় ঘটে যাওয়া এক ডাবল মার্ডার কেসের তদন্ত করতে গিয়ে উঠে আসে পুরোনো একটি গ্যাং–চক্রের ভয়ংকর ইতিহাস।
নিরব ও পূজা চেরির অভিনয় ছিল সংযত আর বাস্তবধর্মী। বিশেষ করে নিরবের পুলিশ অফিসার চরিত্রটি দর্শকদের মনে ধরেছে আলাদা দাগ।
দর্শকের মন্তব্য, ‘বাংলা থ্রিলারে এখন একটা সিরিয়াস ভাইব আসতেছে, এটা তার প্রমাণ”—উক্তিটি এসেছে জনপ্রিয় ফেসবুক পেজ ‘বাংলা মুভি বাজ’ থেকে। এখন পর্যন্ত সিনেমাটি আয় করেছে প্রায় ১.৯ কোটি টাকা।
২০২৫ সালের ঈদুল ফিতরে বাংলা সিনেমার দুনিয়ায় দেখা গেছে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। প্রায় ২০০টি প্রেক্ষাগৃহে সিনেমা মুক্তি পাওয়ার পাশাপাশি ‘বরবাদ’, ‘দাগি’, ‘জংলি’, ‘জ্বীন ৩’ এবং ‘চক্কর ৩০২’—এ পাঁচ সিনেমা ভিন্ন ঘরানার গল্প ও উপস্থাপনায় দর্শকদের জন্য এনেছে নতুন অভিজ্ঞতা। শাকিব খানের ‘বরবাদ’ রেকর্ডসংখ্যক ১২০টি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়ে আলোচনার শীর্ষে ছিল। আর তার অ্যাকশন লুক দর্শকদের মনে বলিউড ও দক্ষিণের সিনেমার উত্তাপ জাগিয়েছে।
অন্যদিকে, আফরান নিশোর ‘দাগি’ সিনেমার মাধ্যমে বড় পর্দায় প্রত্যাবর্তন ও সিয়াম আহমেদের ‘জংলি’-তে ব্যতিক্রমী উপস্থিতি দর্শকদের আগ্রহ বাড়িয়েছে। ভৌতিক থিমের ‘জ্বীন ৩’ ও গানগুলোও দর্শকদের মধ্যে আলাদা জায়গা করে নেয়। যদিও দর্শক সমাগম আগের ‘পরাণ’ কিংবা ‘দিন: দ্য ডে’-এর মতো সাড়া ফেলেনি, তবু সিনেমার বৈচিত্র্য, প্রেক্ষাগৃহের সম্প্রসারণ ও তারকাদের উপস্থিতি বাংলা সিনেমার প্রতি আগ্রহ ধরে রাখার আশার আলো দেখায়।
আপনার মতামত লিখুন :