ঢাকা শনিবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০২৪
ফিরে দেখা-২০২৪

চলতি বছর হারিয়েছি যাদের

রেজা শাহীন

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২১, ২০২৪, ০৫:৩২ পিএম

চলতি বছর হারিয়েছি যাদের

ছবি: সংগৃহীত

‘নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়’ কবি জীবনানন্দ দাসের লেখা এই লাইনটা আমাদেরকে মনে করিয়ে দেয় সবারই একদিন মরে যেতে হবে। এমনকি নক্ষত্রেরও! ২০২৪ সালে শোবিজের আকাশ থেকে অনেক তারকা বিদায় নিয়েছেন, পাড়ি জমিয়েছেন অন্য জগতে। হারিয়ে যাওয়া সেসব তারকাকে নিয়ে দৈনিক রূপালী বাংলাদেশের এই আয়োজন।

আহমেদ রুবেল (১৯৬৮-২০২৪)
বছরের শুরুতেই নন্দিত অভিনেতা আহমেদ রুবলকে হারায় শোবিজ অঙ্গন। গত ৭ ফেব্রুয়ারি না ফেরার দেশে পাড়ি জমান তিনি। ওইদিন সন্ধ্যায় বসুন্ধরা সিটির বেজমেন্টে গাড়ি রেখে নিজের শেষ সিনেমা ‘পেয়ারার সুবাস’-এর প্রিমিয়ার অনুষ্ঠানে এসেছিলেন তিনি। গাড়ি থেকে নামার পর ফ্লোরে পড়ে যান এই অভিনেতা। এরপর তাকে স্কয়ার হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। নিজের শেষ সিনেমা মুক্তির একদিন আগে মারা যান এই অভিনেতা।

মঞ্চ, টেলিভিশন এবং চলচ্চিত্র তিন মাধ্যমেই সমান জনপ্রিয় ছিলেন এই গুণী অভিনেতা। আহমেদ রুবেল ১৯৬৮ সালের ৩ মে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের রাজারামপুর গ্রামে জন্ম নেন। তবে তিনি বেড়ে উঠেছেন ঢাকায়। সেলিম আল দীনের ‘ঢাকা থিয়েটার’ থেকে আহমেদ রুবেলের অভিনয় যাত্রা শুরু হয়। তার অভিনীত প্রথম নাটক ‘স্বপ্নযাত্রা’। উল্লেখযোগ্য নাটক হচ্ছে ‘বারোটা বাজার আগে’, ‘প্রতিদান’, ‘নবাব গুন্ডা’, ‘এফএনএফ’, ‘একান্নবর্তী’, ‘রঙের মানুষ’, ‘পাথর’, ‘অতল’, ‘চেয়ার’, ‘স্বর্ণকলস’, ‘আয়েশার ইতিকথা’, ‘দূরের বাড়ি কাছের মানুষ’, ‘সৈয়দ বাড়ির বউ’ ইত্যাদি।

হুমায়ূন আহমেদের নাটক ‘পোকা’য় অভিনয় করে দর্শকদের নজর কেড়েছেন এই অভিনেতা। এছাড়া হুমায়ূন আহমেদের ‘অতিথি’, ‘নীল তোয়ালে’, ‘বিশেষ ঘোষণা’, ‘সবাই গেছে বনে’, ‘বৃক্ষমানব’, ‘যমুনার জল দেখতে কালো’ এই নাটকগুলোতে রুবেলের অভিনয় প্রশংসিত হয়। ১৯৯৩ সালে ‘আখেরী হামলা’ সিনেমার মাধ্যমে রুপালি পর্দায় অভিষেক হয় আহমেদ রুবেলের। এরপর অভিনয় করেছেন ‘চন্দ্রকথা’, ‘শ্যামল ছায়া’, ‘ব্যাচেলর’, ‘গেরিলা’, ‘দ্য লাস্ট ঠাকুর’, ‘অলাতচক্র’, ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’সহ বেশ কয়েকটি সিনেমায়।

সাদি মহম্মদ (১৯৫৭- ২০২৪)
২০২৪ সালের ১৩ মার্চ মারা যান প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী সাদি মহম্মদ। অজানা এক অভিমানে আত্মহত্যা করেন এই গুণী সংগীতশিল্পী। সাদি মহম্মদের জন্ম ১৯৫৭ সালের ৪ অক্টোবর। তিনি ঢাকার মোহাম্মদপুরে বেড়ে উঠেন। বাবা-মায়ের ইচ্ছায় ১৯৭৩ সালে বুয়েটে ভর্তি হয়েছিলেন সাদি। গানের প্রতি প্রবল টান থাকায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ছেড়ে ১৯৭৬ সালে পাড়ি জমান শান্তিনিকেতন। এরপর বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রবীন্দ্র সংগীতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ২০০৭ সালে ‘আমাকে খুঁজে পাবে ভোরের শিশিরে’ অ্যালবামের মাধ্যমে সুরকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন সাদি মহম্মদ। তার প্রথম অ্যালবাম ‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই’। ২০০৯ সালে ‘শ্রাবণ আকাশে’ ও ২০১২ সালে ‘সার্থক জনম আমার’ অ্যালবাম প্রকাশিত হয়। তার প্রকাশিত অ্যালবামের সংখ্যা ষাটের অধিক। সাদি মহম্মদকে ২০১৫ সালে বাংলা একাডেমি রবীন্দ্র পুরস্কার প্রদান করে।

অলিউল হক রুমি (১৯৬৪-২০২৪)
চলতি বছরের ২২ এপ্রিল আরেক জনপ্রিয় অভিনেতা অলিউল হল রুমি মারা যান। মৃত্যুর আগে শারীরিক অসুস্থতার কথা জানিয়ে সবার কাছে দোয়া চেয়েছিলেন এই অভিনেতা। ক্যানসার জয় করে আগের মতো অভিনয়ে ফিরতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ফেরা হয়নি তার। ১৯৬৪ সালের ২৪ অক্টোবর বরগুনায় জন্মগ্রহণ করেন রুমি। অভিনয়ে তিন দশকের বেশি সময় পার করেছেন এই অভিনেতা। এই দীর্ঘ সময়ে অভিনয় করেছেন অসংখ্য নাটক ও সিনেমায়। ১৯৮৮ সালে অভিনয়ের শুরু থিয়েটার বেইলি রোডের ‘এখনো ক্রীতদাস’ নাটকের মধ্য দিয়ে। একই বছর ‘কোন কাননের ফুল’ নাটকের মাধ্যমে টিভি নাটকে অভিষেক হয় তার।

এই অভিনেতা টেলিভিশনের পাশাপাশি অভিনয় করেছেন সিনেমাতেও। ২০০৯ সালে ‘দরিয়াপাড়ের দৌলতি’ চলচ্চিত্রে প্রথম অভিনয় করেন অলিউল হক রুমি। বরিশালের আঞ্চলিক ভাষাতে বেশি অভিনয় করতেন তিনি। তার আঞ্চলিক ভাষার অভিনয়ে মুগ্ধ হয়েছেন দর্শকরা। অভিনেতার উল্লেখযোগ্য নাটকগুলো হলো–‘বোকাসোকা তিনজন’, ‘মেকাপ ম্যান’, ‘ঢাকা টু বরিশাল’, চৈতা পাগল’, ‘জমজ সিরিজ’, ‘ঢাকা মেট্রো লাভ’, ‘জার্নি বাই বাস’, ‘রতনে রতন চিনে’, ‘আমেরিকান সাহেব’, ‘বাকির নাম ফাঁকি’, ‘কমেডি ৪২০’, ‘জীবনের অলিগলি’  ইত্যাদি।

মাসুদ আলী খান (১৯২৯-২০২৪)
বরণ্য অভিনেতা মাসুদ আলী খান মারা যান চলতি বছরের ৩১ অক্টোবর। মৃত্যুর আগে দীর্ঘদিন অসুস্থ ছিলেন তিনি। এই অভিনেতা ১৯২৯ সালের ৬ অক্টোবর মানিকগঞ্জের পারিল নওধা গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি ১৯৫২ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। দুই বছর পর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জগন্নাথ কলেজ) থেকে বিএ পাস করেন। 

মাসুদ আলী খানের অভিনয়ের শুরুটা হয় মঞ্চ নাটকের মধ্যামে। ১৯৫৬ সালে দেশের প্রথম নাটকের দল ‘ড্রামা সার্কেল’-এর সঙ্গে যুক্ত হন মাসুদ আলী খান। ১৯৬৪ নূরুল মোমেনের নাটক ‘ভাই ভাই সবাই’ নাটকে অভিনয়ে মধ্য দিয়ে ছোট পর্দায় তার অভিষেক হয়। পাঁচশোরও বেশি নাটকে অভিনয় করেছেন তিনি।

তার অভিনীত আলোচিত কয়েকটি নাটক হচ্ছে ‘কূল নাই কিনার নাই’, ‘এইসব দিনরাত্রি’, ‘কোথাও কেউ নেই’। বড় পর্দায় তার অভিষেক হয় ‘নদী ও নারী’ সিনেমায় মাধ্যমে। তার অভিনীত কয়েকটি সিনেমা ‘দুই দুয়ারি’, ‘দীপু নাম্বার টু’, ‘মাটির ময়না’, ‘জোনাকীর আলো’, ‘মোল্লাবাড়ির বউ’, ‘শঙ্খনীল কারাগার’। ২০২৩ সালে শিল্পকলায় অবদানের জন্য মাসুদ আলী খান পেয়েছেন একুশে পদক। অভিনয়ের স্বীকৃতি হিসেবে একুশে পদক ছাড়াও পান আরও অনেক পুরস্কার।

আবু জাফর (১৯৬৩-২০২৪)
বছরের শেষের দিকে আমরা হারাই বিখ্যাত গীতিকার, সুরকার ও শিক্ষক আবু জাফরকে। তিনি মারা যান গত ৫ ডিসেম্বর। আবু জাফর কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। আবু জাফর রাজশাহী ও ঢাকা বেতার এবং টেলিভিশনের নিয়মিত সংগীতশিল্পী ও গীতিকার ছিলেন। আবু জাফর ছিলেন একাধারে একজন গীতিকার, সুরকার ও সংগীতশিল্পী। পেশাগত জীবনে তিনি ছিলেন একজন শিক্ষক। চুয়াডাঙ্গা কলেজ ও কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন তিনি।

একাধিক কালজয়ী গানের স্রষ্টা তিনি। এর মধ্যে ‘এই পদ্মা এই মেঘনা’, ‘তোমরা ভুলেই গেছো মল্লিকাদির নাম’, ‘নিন্দার কাঁটা যদি না বিঁধিল গায়ে’, ‘আমি হেলেন কিংবা মমতাজকে দেখিনি’, ‘তুমি রাত আমি রাতজাগা পাখি’ উল্লেখযোগ্য গান। ‘এই পদ্মা এই মেঘনা’ এই গানটি বিবিসির জরিপে সর্বকালের সেরা ২০টি গানের মধ্যে স্থান জায়গা করে নিয়েছিল। তার রচিত দেশাত্মবোধক ও আধুনিক গান বাংলা সংগীতে ভিন্ন মাত্রা যুক্ত করেছে।

গীতিকার, সুরকার, শিক্ষক এই পরিচয়ের বাইরে তার আরেকটা পরিচয় ছিল। তিনি ছিলেন কবি। বেশ কিছু কবিতার বই লিখেছেন আবু জাফর। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘নতুন রাত্রি পুরোনো দিন’, ‘বাজারে দুর্নাম তবু তুমিই সর্বস্ব’, ‘বিপ্লবোত্তর সোভিয়েত কবিতা’ (অনুবাদ কাব্য)। 

গত ২৫ সেপ্টেম্বর মারা যান অভিনেতা আলাউদ্দিন লাল। ২০০৮ সাল থেকে টিভি নাটকে অভিনয় করেন আলাউদ্দীন লাল। প্রায় ৩০০ নাটকে অভিনয় করেছেন এই প্রবীণ অভিনেতা। ১১ ডিসেম্বর মারা যান সংগীতশিল্পী সনজিত আচার্য। সনজিত আচার্য চট্টগ্রামের পটিয়ায় ছাপোরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লোকগান, আঞ্চলিক গান, হালদাফাডা গানসহ বিভিন্ন ঘরানার গান নিয়ে কাজ করেছেন। গান গাওয়ার পাশাপাশি লিখেছেন এক হাজারের বেশি গান।

এ ছাড়াও চলতি বছর আরও অনেক গুণী মানুষ না ফেরার দেশে চলে যান। তাদের মধ্যে একজন অভিনেত্রী আফরোজা হোসেন। তিনি মারা যান ১০ নভেম্বর। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে জরায়ুর ক্যানসার ধরা পড়ে আফরোজা হোসেনের। তা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে মেরুদণ্ডের হাড়ে। ১৯৮০-৯০ এর দশকে শোবিজ অঙ্গনে বেশ পরিচিত মুখ ছিলেন আফরোজা। শুরুতে টেলিভিশন নাটক দিয়ে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন এবং পরে চলচ্চিত্রে কাজ শুরু করেন এই অভিনেত্রী।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম সংগীতযোদ্ধা, সুরকার ও সংগীত পরিচালক সুজেয় শ্যাম মৃত্যুবরণ করেন ১৭ অক্টোবর। ১৯৪৬ সালের ১৪ মার্চ সিলেটে সুজেয় শ্যামের জন্ম। এই গুণী সংগীতশিল্পীর সুর করা গানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি’, ‘রক্ত চাই রক্ত চাই’, ‘আহা ধন্য আমার জন্মভূমি’, ‘আয় রে চাষি মজুর কুলি’, ‘মুক্তির একই পথ সংগ্রাম’ এবং ‘শোন রে তোরা শোন’। সংগীতে অবদানের জন্য তিনি ২০১৮ সালে একুশে পদক এবং এর আগে ২০১৫ সালে পান শিল্পকলা পদক।

বছরের একেবারে শেষপ্রান্তে এসে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান একুশে পদকজয়ী রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী পাপিয়া সারোয়ার। দীর্ঘদিন ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলেন তিনি। গত ১২ ডিসেম্বর সকালে চিকিৎসাধীন অবস্থান মারা যান গুণী এই শিল্পী।

রূপালী বাংলাদেশ/রুআ

Link copied!