দেখতে দেখতে কালের স্রোতে হারিয়ে যেতে চলেছে আরও একটি বছর। ৩ দিন বাদে জীবন থেকে মহাকালের গর্ভে তলিয়ে যাবে ২০২৪ নামের বছরটি। ৩৬৫ দিনের বছরটির অসংখ্য স্মৃতি বেঁচে থাকবে অগণিত মানুষের কাছে। দরজায় ২০২৫। নতুন বছর নতুন সমীকরণ। মানুষের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ আনন্দ-বিনোদন। সে ক্ষেত্রে শোবিজ অঙ্গন এবং তারকাদের সারা বছরের সাফল্য ব্যর্থতরা হিসাব মেলাতে গেলে স্বাভাবিকভাবে চলে আসে উল্লেখযোগ্য কাজ বা ঘটনা। শুরুতেই বিনোদনের সব থেকে বড় মাধ্যম চলচ্চিত্র নিয়ে কথা।
বিগত কয়েক বছর ধরে ঢাকাই চলচ্চিত্র নিয়ে অভিযোগের কমতি নেই। এই অভিযোগ মূলত নিষ্ক্রিয়তার। দিনে দিনে নিভে যাচ্ছে দেশীয় সিনেমার প্রদীপ শিখা। আবার অনেকের মতে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে দেশীয় চলচ্চিত্র। নতুন ইতিবাচক প্রত্যাশা নিয়ে শুরু হলেও বছর শেষে ব্যর্থতার পাল্লা ভারি! গত কয়েক বছরের মতো ঢালিউডের জন্য দুই হাজার চব্বিশ সাল ব্যবসায়িকভাবে সুবিধাজনক ছিল না। মন্দা অব্যাহত। চলতি বছর কেমন ছিল সিনেমার জন্য! দৈনিক রূপালী বাংলাদেশ পাঠকদের এমন আগ্রহের কথা ভেবে চলতি বছরের সিনেমার হাল-হকিকত নিয়ে আজকের আয়োজন।
অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় ঢালিউডে কয়েক বছর ধরে সিনেমা মুক্তির সংখ্যা ব্যাপকভাবে কমেছে। সিনেমা হলের সংকট তো রয়েছেই। চলতি বছর এখন পর্যন্ত যেসব সিনেমা মুক্তি পেয়েছে তার বেশিরভাগই বিনিয়োগের পয়সা তুলে আনতে পারেনি। হাতেগোনা কয়েকটি সিনেমা ছাড়া বাকি সব ব্যবসায়িকভাবে ব্যর্থ। তথ্যমতে, চলতি বছর মোট ৫২টি সিনেমা মুক্তি পেয়েছে। তার মধ্যে তিনটি আমদানি সিনেমা।
ঝিমিয়ে পড়া ইন্ডাস্ট্রি গেল বছর পুনরায় জেগে উঠেছিল। পালে লেগেছিল নতুন হাওয়া। ব্যবসাসফল ‘প্রিয়তমা’ ও ‘সুড়ঙ্গ’ সিনেমা নতুন করে আশা জাগিয়েছিল। সেই ধারাবাহিকতায় চলতি বছর এক বুক আশা নিয়ে শুরু হলেও পুরো বছরটি করেছে হতাশ। ফ্লপে ফ্লপে বছর পার! চলতি বছরের সূচনাটা সুখকর ছিল না। শুরুটাই হয় বিতর্ক দিয়ে। প্রদর্শক সমিতির নিয়ম অমান্য করে একইদিনে তিনটি সিনেমা মুক্তি পেয়েছিল।
সিনেমা তিনটি হচ্ছে, ‘কাগজের বউ’, ‘শেষ বাজি’ ও আমদানি করা কলকাতার ‘হুব্বা’। গত ১৯ জানুয়ারি সিনেমা তিনটি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়। মূলত আমদানি করা সিনেমাটি নিয়ম না মেনে মুক্তি পেয়েছিল। কিন্তু একটি সিনেমাও দর্শক টানতে পারেনি। তার আগের প্রথম দুই সপ্তাহে প্রেক্ষাগৃহে কোনো সিনেমাই মুক্তি পায়নি। পরের সপ্তাহে মুক্তি পায় মানহীন সিনেমা ‘রুখে দাঁড়াও’। এরপর ফেব্রুয়ারি মাসের মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ট্র্যাপ’, ‘পেয়ারার সুবাস’, ‘শ্রাবণ জোৎস্নায়’, ‘ছায়াবৃক্ষ’ ও ‘টাল মাতাল’ সিনেমাগুলো দর্শক টানতে পারেনি। উল্টো গলার কাটা হয়েছিল হল মালিকদের। কোনোটা বিদ্যুৎ বিলও তুলতে হয় ব্যর্থ। কোনোটা হাতেগোনা দর্শক পেলেও পূর্ণ সময় ধরে রাখার সক্ষমতা দেখাতে পারেনি। রোজার জন্য মার্চে বন্ধ থাকে সিনেমা হল। এক মাস বন্ধ থাকার পর এপ্রিলে রোজার ঈদে একসঙ্গে মুক্তি পায় ১১টি সিনেমা।
ঈদ ব্যতীত হলে দর্শক টানা আর ছেড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখা আজকাল যেন একই। তাই লোকসান এড়াতে বিভিন্ন সময় নির্মিত একগুচ্ছ সিনেমা মুক্তির জন্য সংশ্লিষ্টরা বেছে নিয়েছিলেন চলতি বছরের রোজার ঈদ। কিন্তু লাভের গুড় আসেনি। উল্টো লোকসানের পিপড়ার কামড়ে লাল হতে হয়েছে। মুক্তিপ্রাপ্ত এক ডজন সিনেমার মধ্যে ব্যবসার দিকে তুলনামূলক রাজকীয় অবস্থানে ছিল শাকিব খান-হিমেল আশরাফ জুটির ‘রাজকুমার’। হিমেলের প্রত্যাশা ছিল ‘প্রিয়তমা’কে ছাড়ানোর। ছুঁতেও পারেনি। তবে প্রযোজনা সংস্থার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী সিনেমাটি ব্যবসাসফল হয়েছে। রইল বাকি ১০। এর মধ্যে ‘লিপস্টিক’, ‘দেয়ালের দেশ’, ‘ওমর’, ‘কাজল রেখা’ ব্যবসায়িকভাবে সফল না হলেও প্রশংসিত হয়।
তবে বাকি সাত সিনেমা ‘সোনার চর’, ‘মেঘনা কন্যা’, ‘আহারে জীবন’, ‘গ্রীন কার্ড’, ‘মোনা: জ্বীন ২’, ‘মায়া: দ্যা লাভ’, ‘পটু’ ব্যবসায়িক দিক থেকে কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারেনি। ঈদ শেষ না হতেই দেশের প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় আমদানি করা বলিউডের সিনেমা ‘মিস্টার অ্যান্ড মিসেস মাহি’। কিন্তু সিনেমাটি সুপারফ্লপ হয়। বরাবরের মতো ভিনদেশি সিনেমাটি দর্শক ফিরিয়ে দেন। যার ফলে লগ্নি করা অর্থই তুলতে পারেনি সংশ্লিষ্টরা।
অগ্নিঝরা মার্চে মুক্তি পায় ‘ডেডবডি’, ‘শ্যামা কাব্য’, ‘পটু’, ‘সুস্বাগতম’, ‘ফাতিমা’ ও ‘ময়নার শেষ কথা’ নামের সিনেমাগুলো। কিন্তু সিনেমাগুলো চালিয়ে প্রেক্ষাগৃহ মালিকেরা বিদ্যুৎ খরচ তুলতেই হিমশিম খেতে হয়। এমনও হয়েছে দর্শকখরায় শো বন্ধ থাকে। আবার দু-চারদিন চালিয়ে সিনেমা নামিয়ে দিয়েছে অনেক প্রেক্ষাগৃহ মালিক।
কোরবানির ঈদকে আঞ্চলিক ভাষায় বলা হয় ‘বড় ঈদ’। এ ঈদে মুক্তি পায় শাকিব খান অভিনীত এবং রায়হান রাফি পরিচালিত ‘তুফান’। সিনেমাটি হলে বসন্ত ফিরিয়েছে। ইন্ডাস্ট্রি হিট তকমা পেয়েছে। ওই জায়গা থেকে বলা যায়, বড় ঈদে এসেছে বছরের সবচেয়ে বড় সিনেমা ‘তুফান’। তবে ‘তুফান’ তাণ্ডব চালালেও মুক্তিপ্রাপ্ত বাকি চার সিনেমা ‘ময়ূরাক্ষী’, ‘ডার্ক ওয়ার্ল্ড’, ‘রিভেঞ্জ’, ‘আগন্তুক’ কোনোটাই কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারেনি।
যদিও ট্রেলার, পোস্টার ও বিষয়বস্তু দিয়ে কৌতুহল জাগিয়েছিল ‘ময়ূরাক্ষী’। ইয়ামিন হক ববিও নজর কেড়েছিলেন। তবে আলোচনার টেবিলে জ্বলে উঠলেও হলে ছিল নিভু নিভু। মুক্তির মিছিলে হঠাৎ যোগ দেওয়া ‘আগন্তুক’ও পায়নি দর্শকের আপ্যায়ন। তবে হাসির খোরাক জুগিয়ে আলোচনায় ছিল ‘ডার্ক ওয়ার্ল্ড’ ও ‘রিভেঞ্জ’। রোজার ঈদে ‘দেয়ালের দেশে’র মাধ্যমে প্রশংসিত হলেও ‘রিভেঞ্জে’র কারণে বুবলী হন নিন্দিত। অন্যদিকে কলকাতা থেকে উড়ে আসা কৌশানী সেনগুপ্তও ‘ডার্ক ওয়ার্ল্ড’ দেখাতে পারেননি আলোর দিশা। প্রতিযোগিতার দৌড়ে ছিটকে পড়ে সিনেমাগুলো।
বছরের প্রথম ছয় মাসে কয়েকটি সিনেমা মন্দের ভালো চললেও শেষ ছয় মাসে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘আজব কারখানা’, ‘অমানুষ হলো মানুষ’, ‘জিম্মি’, ‘শরতের জবা’, ‘বাদশা দ্য কিং’, ‘চরিত্র’, ‘হৈমন্তীর ইতিকথা’, আমদানি করা ‘স্ত্রী টু’, ‘রংঢং’, ‘৩৬ ২৪ ৩৬’, ‘দরদ’, ‘ভয়াল’, ‘নয়া মানুষ’, ‘দুনিয়া’, ‘হুরমতি’, ‘ডেঞ্জার জোন’, ‘৮৪০’, ‘মাকড়সার জাল’, ‘প্রিয় মালতি’ ও ‘নকশিকাঁথার জমিন’ নামের সিনেমাগুলো সুপারফ্লপ হয়েছে। তার মধ্যে ‘৩৬ ২৪ ৩৬’ ও ‘৮৪০’ ওয়েব ফিল্ম হিসেবে নির্মিত হলেও ওটিটির আগে মুক্তি পায় সিনেমা হলে। কিন্তু সিনেমা দুটি মুখ থুবড়ে পড়ে।
এসব সিনেমাতে মনোয়ার হোসেন ডিপজল, শাকিব খান, অপু বিশ্বাস, শবনম ইয়াসমিন বুবলী, মোশাররফ করিম, সজল, কুসুম শিকদার, মেহজাবীন চৌধুরী, মৌসুমী হামিদ, ফেরদৌস আহমেদ, ইয়ামিন হক ববি, আদর আজাদ, জিয়াউল রোশান, পূজা চেরির মতো তারকা অভিনয়শিল্পীরা থাকলেও দর্শক টানতে ব্যর্থ হয়। আবার অনেক সিনেমা প্রচারণা ছাড়া নীরবে মুক্তি পেয়েছে। কয়েকটি সিনেমার গল্প ভালো হলেও পর্যাপ্ত প্রচারণার অভাব এবং প্রেক্ষাগৃহ না পাওয়ায় কয়েকটি সিনেমা দর্শকদের কাছে পৌঁছাতে পারেনি।
বছরের অর্ধেক সময় মুক্তি পাওয়া অধিকাংশ সিনেমাই প্রেক্ষাগৃহে মুখ থুবড়ে পড়েছে। হিট কিংবা ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণে সফলতার দেখা পায় এমন সিনেমা নেই। তবে দর্শক আগ্রহে ছিল এমন সিনেমা ছিল হাতেগোনা দু-একটি। ছয় মাস কেটে যাওয়ার পর সিনেমাসংশ্লিষ্ট অনেকেই মনে করেছিলেন, পরের ছয় মাসে সিনেমায় ভালো একটা কিছু হতে যাচ্ছে। কিন্তু বিধিবাম। জুলাই মাসে মাত্র একটি সিনেমা মুক্তি পায়। পাঁচটি মাল্টিপ্লেক্সে ১২ জুলাই মুক্তি দেওয়া হয় সিনেমা ‘আজব কারখানা’। সেটিও দর্শকদের কাছে পৌঁছানোর সুযোগ হয়ে ওঠেনি। ওই মাসেই দেশে কোটা সংস্কার আন্দোলনের কারণে এক অস্থির পরিবেশ সৃষ্টি হয়। আর তাতেই সিনেমায় নেমে আসে খক্ষ। মুক্তি থেকে পিছিয়ে যায় জুলাই মাসের সব সিনেমা। এরপর যতগুলো সিনেমা মুক্তি পেয়েছে একটিও দর্শক গ্রহণ করেনি।
তবে শাকিব খানের সিনেমার চিত্র ছিল ভিন্ন। আর ঈদ ছাড়া সিনেমা মুক্তি পেলে এখন আর কোনো নায়ক-নায়িকার সিনেমাই চলে না। অনেক বছর পর উৎসব ছাড়া প্রেক্ষাগৃহে এসে মুখ থুবড়ে পড়েছে শাকিব খানের ‘দরদ’ সিনেমাটি। রয়েছে গল্প নকলের অভিযোগও। ঢালিউড সিনেমা এখন ঈদকেন্দ্রিক! ঢাকাই চলচ্চিত্র নিয়ে অভিযোগের শেষ নেই। কখনো গল্পের অভাব কখনো বা বাণিজ্যিকভাবে মুখ থুবড়ে পড়ার অভিযোগ। চলতি বছরও ব্যবসার দিক থেকে খুব একটা লাভবান হয়নি বলে আক্ষেপ রয়েছে চলচ্চিত্র-সংশ্লিষ্টদের। চলতি বছরটি ছিল ঢাকাই চলচ্চিত্রের চরম খরার বছর। এ বছর ৫২টি সিনেমা মুক্তি পেলেও ব্যবসাসফল সিনেমা মাত্র একটি। মানে ৯৯ ভাগ সিনেমাই লোকসান গুনেছে। এতে সিনেমা হলগুলোও পড়েছে বিপাকে। বড় বাজেটের সিনেমার মুক্তিও ছিল একেবারেই কম। সব মিলিয়ে বছরটি ছিল চলচ্চিত্রের জন্য চরম মন্দার বছর।
আপনার মতামত লিখুন :