ডিম দারুণ পুষ্টিকর খাবার। হাজার বছর ধরে মানুষের খাদ্য তালিকার অবিচ্ছেদ্য অংশ। সব ডিমের ভেতরের গঠন বা বর্ণ এক। রঙের ভিন্নতা দেখা যায় শুধু খোসার বেলায়।
মুরগির ডিমের মধ্যেই কোনোটা লাল, আবার কোনোটা সাদা। অন্যান্য পাখির ডিম তো আরেক কাঠি সরেস। নীল, বাদামি ছোপ ছোপ দাগওয়ালাসহ নানা রঙের ডিম আছে। এর পেছনে কারণটা কী? কেন ডিমের রং ভিন্ন হয়? ডিমের রং মূলত নির্ধারিত হয় মুরগির জিনগত বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে। তবে মজার ব্যাপার হলো, মুরগির কানের লতির দিকে তাকালেই অনুমান করা যায়, সে কেমন রঙের ডিম দেবে।
আর্চার বলেন, ‘সাধারণভাবে যেসব মুরগির কানের লতি সাদা, তারা সাদা ডিম পাড়ে। তবে সব ডিম শুরুতে সাদাই হয়। কারণ ডিমের খোলস তৈরি হয় ক্যালসিয়াম কার্বোনেট দিয়ে। ডিম গঠনের সময় মুরগির জিন থেকে নির্গত রঙিন রঞ্জক খোলসে জমা হয় এবং এর রং নির্ধারিত হয়।
আর্চার বলেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যেসব মুরগির কানের লতি হালকা রঙের হয়, তাদের পালকও সাদা হয় এবং তারা সাদা ডিম পাড়ে। অন্যদিকে, যেসব মুরগির পালক ও কানের লতি গাঢ় রঙের, তারা সাধারণত রঙিন ডিম পাড়ে।
ডিমের বাইরের আবরণ অর্থাৎ খোসা মূলত ক্যালসিয়াম কার্বনেট দিয়ে তৈরি। ক্যালসিয়াম কার্বনেটের প্রাকৃতিক রং সাদা। এর সঙ্গে রঞ্জক কণা মিশ্রিত হলে খোসার রং বদলে যায়। খোসার সঙ্গে কোন রঞ্জক কণা মিশবে বা কীভাবে মিশবে, সে বিষয়টি জেনেটিক। মুরগি বা পাখির জাতের ওপর ভিত্তি করে ভিন্ন হয় ডিমের রং।
ডিমের খোসা তৈরির কাজটি হয় ওভিডাক্টের ভেতরে। ওভিডাক্ট হলো ডিম্বাশয় এবং লেজের মধ্যবর্তী স্থানে নলের মতো একটি অঙ্গ। পূর্ণবয়স্ক মুরগির ওভিডাক্ট প্রায় ২৫ থেকে ২৭ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয়। ডিমের মূল অংশ, অর্থাৎ কুসুম তৈরি হয় ডিম্বাশয়ে। কুসুম পরিণত হলে চারপাশের পর্দা বা ফলিকল ফেটে যায়। ফলে ডিম্বাশয় থেকে মুক্ত হয় কুসুম। এরপর ওভিডাক্টের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করে।
এখানেই পর্যায়ক্রমে ডিমের সাদা অংশ, পাতলা পর্দা এবং সবশেষে খোসা তৈরি হয়। পুরো ব্যপারটি সম্পন্ন হতে সময় লাগে প্রায় ২৬ ঘণ্টা। এর প্রায় ২০ ঘণ্টাই যায় ডিমের খোসা তৈরির কাজে। খোসা তৈরির সময় জাত ভেদে ভিন্ন ভিন্ন রঞ্জক পদার্থ যুক্ত হয়।
আমেরোকানা নামের এক জাতের মুরগি নীল রঙের ডিম দেয়। নীল রঙের কারণ ওসায়ানিন নামের এক ধরনের রঞ্জক কণা। আমেরোকানার ওভিডাক্টে তৈরি হওয়া ওসায়ানিন ক্যালসিয়াম কার্বোনেটের সঙ্গে মিশ্রিত হয়। ফলে ডিমের খোসা ভেতরে এবং বাইরে—দুদিকেই রঙিন হয়।
আবার বাজারে আমরা যে বাদামি রঙের ডিম দেখি, সেটার খোলসের ওপরের অংশে থাকে প্রোটোপরফাইরিন। রক্তের হিমোগ্লোবিন থেকে এই রঞ্জক কণা উৎপন্ন হয়। এটা ক্যালসিয়াম কার্বোনেটের সঙ্গে পুরোপুরি মেশে না। তাই এ ডিমের খোসার ওপরের অংশ রঙিন হলেও ভেতরের অংশ হয় সাদা। ডিমের রং কতটা গাঢ়, তা নির্ভর করে রঞ্জক কণার পরিমাণের ওপর।
অনেকেই মনে করেন বাদামি রঙের ডিম বেশি পুষ্টিকর ও স্বাস্থ্যসম্মত। ধারণাটি ঠিক নয় মোটেও। ডিমের রঙের সঙ্গে পুষ্টিগুণের কোনো সম্পর্ক নেই। কীভাবে কী হয়, তা তো বোঝা গেল। কিন্তু কেন হয়? অনেকের ধারণা, ডিমশিকারি প্রাণীদের থেকে লুকাতে বা বাঁচাতে এই রং-ভিন্নতা তৈরি হয়েছে। প্রাকৃতিক নিরাপত্তাব্যবস্থা। তা ছাড়া ভিন্ন রং নিজেদের ডিম আলাদাভাবে চিনতে সাহায্য করে। মুরগিসহ বিভিন্ন পাখি, সরীসৃপ, মাছ ও বিভিন্ন পতঙ্গ ডিমের মাধ্যমে সন্তান জন্ম দেয়। এর মধ্যে বিষাক্ত প্রাণী ছাড়া প্রায় সব ধরনের প্রাণীর ডিম-ই মানুষের খাওয়ার উপযোগী।