ঢাকা মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল, ২০২৫

বিলুপ্তির পথে শীতল পাটি

রূপালী ডেস্ক
প্রকাশিত: এপ্রিল ২৮, ২০২৫, ১০:৩০ পিএম
ছবি: সংগৃহীত

গ্রাম বাংলার শিল্প ও ঐতিহ্যের অন্যতম নিদর্শন শীতল পাটি। আধুনিক সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অনেক ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে। তেমনই একটি শিল্প শীতল পাটি, সময়ের ব্যবধানে এ শিল্পটি এখন হারানোর পথে।

বাংলার ইতিহাসের সঙ্গে শীতল পাটির সম্পর্ক যুগ-যুগান্তরের। আগেকার দিনে বিয়ে-শাদিতে শীতল পাটি না দিলে মনোমালিন্য দেখা দিতো। এ ছাড়া গরমে প্রশান্তির পরশ পেতে শীতল পাটির জুড়ি নেই। কিন্তু আধুনিকতার ছোঁয়ায় সেই ঐতিহ্য আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে।

পিরোজপুরের কাউখালীর পাটি কারিগর সজল দে পেশাগতভাবে শীতল পাটি তৈরি করে আসছেন। পেশাটি শিখেছেন বাবার কাছ থেকে। একসময় একটি পাটি বিক্রি করতেন ৩ থেকে ৫ হাজার টাকায়। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাটির ব্যবহার কমে যাওয়ায় তিনি খুঁজে পান নতুন পথ। ঐতিহ্য ধরে রাখতে এবং পূর্বপুরুষের পেশার আধুনিক রূপ দিতে শীতল পাটি দিয়ে বিভিন্ন গৃহস্থালি পণ্য তৈরি শুরু করেন।

বর্তমানে তিনি পাটি দিয়ে তৈরি করছেন পাখির বাসা, টিস্যু বক্স, পেন্সিল বক্স, বাতির শেড, ডাইনিং ম্যাট, কার্পেটের বদলে নকশি মাদুর, স্যুটকেস, ব্যাগ, কলমদানি, ট্রে, ওয়ালম্যাটসহ নানা ধরনের শোপিস। এসব পণ্য দেশে এবং বিদেশেও আগ্রহী ক্রেতার নজর কাড়ছে।

সজল দে বলেন, ‘শীতল পাটির কদর না থাকলেও পূর্বপুরুষের পেশা ধরে রাখতে আমি এর আধুনিক রূপ দিচ্ছি। অনেকেই পেশা ছেড়ে দিয়েছেন, তবে আমি শীতল পাটি দিয়ে তৈরি বিভিন্ন পণ্যের মাধ্যমে নিজের কর্মসংস্থান তৈরি করেছি এবং অন্যদেরও উৎসাহ দিচ্ছি।’

এদিকে, ঐতিহাসিক জব্বারের বলী খেলা উপলক্ষে চট্টগ্রামের লালদিঘি ময়দানে বসা তিন দিনের মেলায় শীতল পাটি বিক্রিতে হতাশ হয়েছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা কারিগর ও বিক্রেতারা। এবারের মেলায় মাত্র ৩০ জন বিক্রেতা শীতল পাটি নিয়ে মেলায় অংশ নিলেও অধিকাংশই লোকসানের বোঝা নিয়ে ফিরেছেন। 

বরিশাল, ভোলা, সিলেট ও সিরাজগঞ্জ থেকে শতাধিক পাটি নিয়ে এসেছিলেন শিল্পীরা। কিন্তু বিক্রি এতটাই কম হয়েছে যে, গাড়িভাড়া, হোটেল খরচ তো দূরের কথা, অনেকের খাওয়া-দাওয়ার খরচও উঠে আসেনি। ফলে মন খারাপ করে চট্টগ্রাম ছেড়েছেন তারা। অনেকে এ শিল্প ছাড়ার কথাও জানিয়েছেন।  

ভোলা থেকে আসা বিক্রেতা শাহ আলম জানান, শীতল পাটি তৈরিতে অনেক ধাপের কাজ জড়িত। তুলতুলে নরম ও মজবুত ফিনিশিং যুক্ত পাটি তৈরি হয় কঠোর পরিশ্রমে। কিন্তু ক্রেতাদের আগ্রহ নেই।

 

বরিশাল থেকে আসা বিক্রেতা গণেশ দত্ত বলেন, ৩৫ শতাংশ জমিতে বেতের চাষ করে, তিনজন কর্মীর সহায়তায় তিনি প্রতিটি ছোট পাটি তৈরি করেন ১২০০ টাকা খরচে, মাঝারি পাটির খরচ ১৫০০-২০০০ টাকা এবং বড় পাটির জন্য লাগে ২৫০০-৩০০০ টাকা। অথচ সেই দামে পাটি বিক্রি করা সম্ভব হয়নি। মেলায় অংশগ্রহণের খরচই তার ১৫ হাজার টাকার বেশি হলেও, বিক্রি ২০ হাজার টাকাও ছাড়ায়নি।  

গণেশ আরও বলেন, ‘বেতের খেতে পুরুষেরা ঘাম ঝরায়, আর নারীরা সারাদিন ধরে পাটি বোনে। শ্রমিকদের ৩০০-৪০০ টাকা মজুরি দিতে হয়। লাভ তো দূরের কথা, নিজেদের সংসারও চলে না ঠিকমতো।’  

মেলায় আসা সিলেটের কারিগর কালাচান দাস বলেন, ‘আমাদের অঞ্চলের শীতল পাটি সারা দেশে বিখ্যাত। শতাধিক পরিবার এই পেশার ওপর নির্ভর করে। পাহাড়ি জঙ্গলে বেতের চাষ, গাছ থেকে আঁশ সংগ্রহ, সিদ্ধ করা, শুকানো এবং ডিজাইনসহ পুরো কাজ করতে হয় পরম যত্নে। বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে শুরু করে হাঁস-মুরগির নকশাও আঁকি আমরা। তবু আজকাল কেউ আগ্রহ দেখায় না।’

তিনি ক্ষোভের সুরে বলেন, ‘মজুরিও উঠে আসে না। ভাবছি, এ পেশা ছেড়ে দেব। কিন্তু ছোটবেলা থেকে এ শিল্পের সঙ্গে মিশে আছি, তাই ছাড়তেও মন চায় না।’  

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শহুরে জীবনের ব্যয়বহুল ব্যস্ততা, প্লাস্টিকের আধিক্য, সাধ্যের বাইরে দামের কারণে শীতল পাটির কদর এখন আর নেই বললেই চলে। এর সুবিধা সম্পর্কে জানে না নতুন প্রজন্মও। কেউ তো কিনছেনই না, আগ্রহও হারিয়েছেন অনেকে।

কেউ কেউ ধুঁকে ধুঁকে ব্যবসা চালিয়ে নিলেও নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছেন বেশির ভাগ শিল্পীই। ফলে বিলুপ্তির ‘দ্বারপ্রান্তে’ হাজার বছরের শিল্পটি।