থাইরয়েড ছোট্ট একটা গ্রন্থি, যা ঘাড়ের সামনের দিকে শ্বাসনালির চারপাশে আবৃত থাকে। এর আকৃতি অনেকটা প্রজাপতির মতো। মাঝখানে ছোট দুটি ডানা আছে। এই গ্রন্থির কাজ মূলত আমাদের শরীরের কিছু অত্যাবশ্যকীয় হরমোন উৎপাদন করা। শরীরে এই থাইরয়েড হরমোনের নির্দিষ্ট একটি মাত্রা আছে। নির্দিষ্ট মাত্রার চেয়ে কম বা বেশি হরমোন উৎপাদিত হলে শরীরে এর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। পরিণত হয় রোগে।
থাইরয়েড রোগের প্রতিকার ও প্রতিরোধ নিয়ে দৈনিক রূপালী বাংলাদেশকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বিস্তারিত কথা বলেছেন ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার মেডিসিন অ্যান্ড অ্যালায়েড সায়েন্সেস (ইনমাস), কক্সবাজার-এর পরিচালক, ডায়াবেটিস, হরমোন ও থাইরয়েড বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মো. সাঈদুল আলম প্রিন্স।
দৈনিক রূপালী বাংলাদেশ: থাইরয়েড কী?
সাঈদুল আলম প্রিন্স: থাইরয়েড অন্তক্ষরাগ্রন্থি, অ্যান্ডোক্রাইন গ্ল্যান্ড। এটি থাইরক্সিন এবং ট্রাই-আয়োডোথাইরোনিন নামক হরমোন তৈরি করে যা আমাদের শরীরবৃত্তীয় কাজগুলো পুরোদমে নিয়ন্ত্রণ করে। মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত শরীরের প্রত্যেকটি সিস্টেমকে নিয়ন্ত্রণ করে। এ ছাড়াও স্নায়ুতন্ত্র, হজম প্রক্রিয়া, মাংসপেশি ও হাড়ের বৃদ্ধি এবং শারীরিক শক্তি উৎপাদনে ভূমিকা রাখে।
দৈনিক রূপালী বাংলাদেশ: থাইরয়েডের প্রকারভেদ ও সমস্যাগুলো কী কী? বা থাইরয়েড নিশ্চিত হওয়ার লক্ষণগুলো কীভাবে চিনব?
সাঈদুল আলম প্রিন্স: থাইরয়েড রোগের লক্ষণ নির্ভর করে আপনি কোন ধরনের থাইরয়েড সমস্যায় ভুগছেন হাইপোথাইরয়েডিজম (হরমোনের অভাব) নাকি হাইপারথাইরয়েডিজম (অতিরিক্ত হরমোন)।এই দুটি অবস্থার লক্ষণ আলাদা এবং স্পষ্টভাবে বোঝা যায়। প্রথমেই বলি হাইপোথাইরয়েডিজমের লক্ষণ-
অবসাদ : সারাক্ষণ ক্লান্তি ও দুর্বল অনুভব করা।
ওজন বৃদ্ধি: বেশি খাবার না খেলেও ওজন বেড়ে যায়।
ঠান্ডা সহ্য করতে না পারা: ঠান্ডা আবহাওয়ায় অস্বাভাবিক সংবেদনশীলতা।
ত্বক ও চুলের পরিবর্তন: ত্বক শুষ্ক ও রুক্ষ হয়ে যায় এবং চুল পড়া বেড়ে যায়।
কোনো কাজ করতে ধীরগতির হওয়া: মনোযোগে ঘাটতি বা কথা বলতে ধীরগতি।
হৃদস্পন্দনের ধীরগতি, হার্টবিট কমে যাওয়া, হজমের সমস্যা, কোষ্ঠকাঠিন্য, মেজাজ খারাপ, হতাশা ও মনমরা ভাব, মাসিকের অনিয়ম, নারীদের ক্ষেত্রে মাসিক চক্র ভারসাম্যহীন হতে পারে।
হাইপারথাইরয়েডিজমের লক্ষণ (থাইরয়েড হরমোনের অতিরিক্ততা)
ওজন কমে যাওয়া: স্বাভাবিক খাবার খেলেও দ্রুত ওজন কমে যায়।
হৃদস্পন্দনের দ্রুততা: হার্টবিট বেড়ে যায় এবং বুক ধড়ফড় করে।
উদ্বিগ্নতা ও নার্ভাসনেস: অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা ও উত্তেজনা অনুভব করা।
ঘামানো ও তাপ সহ্য করতে না পারা: শরীর থেকে অস্বাভাবিক ঘাম ঝরা।
ঘুমের সমস্যা: ইনসমনিয়া বা ঠিকমতো ঘুম না হওয়া।
হাত-পায়ের কাঁপুনি: মাংসপেশিতে দুর্বলতা ও কাঁপুনি।
পেটের সমস্যা: ডায়রিয়া বা হজম সমস্যা।
গলার ফোলাভাব (গলগন্ড): থাইরয়েড গ্রন্থি বড় হয়ে যাওয়া।
চোখের সমস্যা: চোখ ফোলা বা বেরিয়ে আসা (বিশেষ করে গ্রেভস ডিজিজে)।
দৈনিক রূপালী বাংলাদেশ : আমি কখন বুঝব যে ডাক্তারের কাছে যেতেই হবে?
সাঈদুল আলম প্রিন্স : কারোর গলায় ফোলাভাব বা অস্বাভাবিক পরিবর্তন এলে। ওজন অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়া বা কমে গেলে। হার্টবিট অনিয়মিত হওয়া বা অথ্যাধিক বেড়ে গেলে। দীর্ঘমেয়াদি ক্লান্তি বা অবসাদ হলে ত্বক, চুল বা নখে অস্বাভাবিক পরিবর্তন দেখলে।
দৈনিক রূপালী বাংলাদেশ : থাইরয়েডের সমস্যা নির্ণয়ের পরীক্ষাগুলো কি কি?
সাঈদুল আলম প্রিন্স : রক্ত পরীক্ষা : থাইরয়েড হরমোনের মাত্রা জানার জন্য। থাইরয়েড আলট্রাসনোগ্রাফি: থাইরয়েড গ্রন্থির আকার ও গঠন পরীক্ষা।
রেডিওআয়োডিন স্ক্যান: হরমোনের উৎপাদন প্রক্রিয়া মূল্যায়ন।
দৈনিক রূপালী বাংলাদেশ : গলগন্ড কি? গলগন্ড আর থাইরয়েড কি একই জিনিস?
সাঈদুল আলম প্রিন্স : গলগন্ড হলো একটি অবস্থায় থাইরয়েড গ্রন্থির অস্বাভাবিকভাবে বড় হয়ে যাওয়া। এটি গলার সামনের অংশে ফুলে ওঠে এবং কখনো কখনো শ্বাস নিতে বা গিলতে অসুবিধা তৈরি করতে পারে। গলগন্ড কোনো নির্দিষ্ট রোগ নয়, বরং এটি থাইরয়েড গ্রন্থির বিভিন্ন সমস্যার কারণে হয়ে থাকে।
দৈনিক রূপালী বাংলাদেশ : কোন সমস্যার কারণে গলগন্ড হয়?
সাঈদুল আলম প্রিন্স : গলগন্ড সাধারণত থাইরয়েড হরমোন উৎপাদনের ভারসাম্যহীনতার কারণে হয়। এর কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে:
আয়োডিনের ঘাটতি: এটি গলগন্ডের সবচেয়ে সাধারণ কারণ, বিশেষত যেসব এলাকায় খাবারে পর্যাপ্ত আয়োডিন থাকে না।
হাইপোথাইরয়েডিজম : যখন থাইরয়েড পর্যাপ্ত হরমোন তৈরি করতে পারে না।
হাইপারথাইরয়েডিজম : যখন থাইরয়েড অতিরিক্ত হরমোন তৈরি করে।
অটোইমিউন রোগ: যেমন, হাশিমোটোর থাইরয়েডিটিস বা গ্রেভস ডিজিজ। এছাড়াও থাইরয়েড গ্রন্থিতে টিউমার বা সিস্ট ও গর্ভাবস্থা বা হরমোন পরিবর্তন।
দৈনিক রূপালী বাংলাদেশ : কীভাবে বুঝব আমার গলগন্ড হয়েছে বা লক্ষণ শুরু হয়েছ?
সাঈদুল আলম প্রিন্স : সাধারণ ব্যক্তির ক্ষেত্রে এটা বোঝা একেবারেই অসম্ভব। কেননা গলগন্ডের লক্ষণগুলো এর তীব্রতা ও কারণের উপর নির্ভর করে: যেমন- গলায় ফোলা বা স্ফীতি; গিলতে বা শ্বাস নিতে কষ্ট; কণ্ঠস্বর ভারি হয়ে যাওয়া; ক্লান্তি, ওজন বাড়া বা কমা (থাইরয়েড হরমোনের অসামঞ্জস্যের কারণে)।
দৈনিক রূপালী বাংলাদেশ : গলগন্ড হলে করণীয় কী?
সাঈদুল আলম প্রিন্স : এর (গলগন্ড ) চিকিৎসা খুব জটিল কিছু নয়। আয়োডিনযুক্ত লবণ বা খাবার গ্রহণ, হাইপোথাইরয়েডিজম বা হাইপারথাইরয়েডিজম নিয়ন্ত্রণে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খাওয়া, যদি গলগন্ড খুব বড় হয় বা শ্বাস-প্রশ্বাসে বাধা দেয় তবে অপারেশন করাতে হয়। এ ছাড়া আলাদা কোনো উপসর্গ থাকলে দ্রুত চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত।
দৈনিক রূপালী বাংলাদেশ : থাইরয়েড গ্লান্ডের কাজ আসলে কী?
সাঈদুল আলম প্রিন্স : যেহেতু আমরা বলছি, মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করে থাইরয়েড সেহেতু এর কাজ সীমাহীন। তবুও এর কিছু বিশেষ কার্যক্রম যেমন, থাইরয়েড হরমোন উৎপাদন ও নিঃসরণ করা। এছাড়া থাইরয়েড গ্রন্থি থাইরক্সিন এবং ট্রাই-আয়োডোথাইরোনিন হরমোন উৎপাদন করে। এই হরমোনগুলো শরীরের বিপাকক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে, অর্থাৎ ক্যালরি পোড়ানো, শক্তি উৎপাদন, এবং কোষের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে। থাইরয়েড হরমোন শরীরের তাপমাত্রা বজায় রাখতে সহায়তা করে।
থাইরয়েড গ্রন্থি হৃদযন্ত্রের গতি ও কার্যক্ষমতাকে প্রভাবিত করে। এটি রক্তচাপ এবং হার্ট রেট নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে। শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধিতে থাইরয়েড হরমোন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। স্নায়ুতন্ত্রকে সক্রিয় ও সঠিকভাবে কাজ করার জন্য থাইরয়েড হরমোন প্রয়োজন। এটি স্মৃতি ও মনোযোগে সাহায্য করে। থাইরয়েড হরমোন পরিপাকতন্ত্রের কার্যক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করে। থাইরয়েড হরমোন নারী ও পুরুষের প্রজনন ক্ষমতার ওপর প্রভাব ফেলে। এটি হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।
দৈনিক রূপালী বাংলাদেশ: থাইরয়েডের ঘাটতি হলে শরীরে কী কী প্রভাব পড়ে?
সাঈদুল আলম প্রিন্স: থাইরয়েড হরমোন অতিরিক্ত (হাইপারথাইরয়েডিজম) বা কম (হাইপোথাইরয়েডিজম) হয়ে গেলে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতে পারে, যেমন: শক্তি কমে যায়, নিস্তেজ হয়ে পড়ে, সারাক্ষণ অলস অলস ভাব ফিল হয়, অস্বাভাবিক হারে ওজন বৃদ্ধি বা হ্রাস পেতে থাকে। হার্টবিট অনেক বেশি বেড়ে যায় আবার হঠাত কমে যেতে পারে।
শারীরিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয় বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় শিশুর ওজন অনেক বেশি বেড়ে যাচ্ছে। থাইরয়েডের কাজ সঠিকভাবে সম্পন্ন করার জন্য পুষ্টিকর খাবার (বিশেষ করে আয়োডিন) এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। থাইরয়েড গ্রন্থি হৃদযন্ত্রের গতি ও কার্যক্ষমতাকে প্রভাবিত করে। এটি রক্তচাপ এবং হার্ট রেট নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে।
দৈনিক রূপালী বাংলাদেশ : থাইরয়েড সমস্যা আসলে কেন হয়?
সাঈদুল আলম প্রিন্স : থাইরয়েড সমস্যার বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। এগুলো সাধারণত থাইরয়েড গ্রন্থির হরমোন উৎপাদন ও কার্যক্রমের ভারসাম্যহীনতার কারণে ঘটে। থাইরয়েড সমস্যার প্রধান কারণগুলো:
আয়োডিনের অভাব: থাইরয়েড হরমোন তৈরি করতে আয়োডিন প্রয়োজন। খাবারে পর্যাপ্ত আয়োডিনের অভাব হলে গলগন্ড এবং হাইপোথাইরয়েডিজম হতে পারে। এটি বিশেষত আয়োডিন-স্বল্প এলাকায় বেশি দেখা যায়। বিশেষ করে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল ও পাহাড়ি এলাকায় এ সমস্যা বেশি দেখা যায়।
অটোইমিউন রোগ: হাশিমোটোর থাইরয়েডিটিস: এটি একটি অটোইমিউন অবস্থা, যেখানে শরীরের ইমিউন সিস্টেম থাইরয়েড গ্রন্থিকে আক্রমণ করে। এতে হরমোন উৎপাদন কমে যায় (হাইপোথাইরয়েডিজম)।
গ্রেভস ডিজিজ: এটি অটোইমিউন পরিস্থিতি, যেখানে থাইরয়েড অতিরিক্ত হরমোন তৈরি করে (হাইপারথাইরয়েডিজম)।
হরমোনের ভারসাম্যহীনতা: প্রেগন্যান্সি, মেনোপজ, বা অন্যান্য হরমোনগত পরিবর্তন থাইরয়েডের কার্যক্রম প্রভাবিত করতে পারে।
জিনগত কারণ: পরিবারে থাইরয়েড সমস্যার ইতিহাস থাকলে ঝুঁকি বাড়ে। বিশেষ করে মায়ের দিকের পরিবার যেমন: নানি, মা, খালা, বোন, খালাতো বোন ইত্যাদি থেকে বহন করে থাকে।
থাইরয়েড গ্রন্থির প্রদাহ: ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণ, ওষুধ বা ইমিউন সিস্টেমের কারণে থাইরয়েড গ্রন্থি ফুলে উঠতে পারে।
টিউমার বা সিস্ট: থাইরয়েড গ্রন্থিতে নোডিউল, সিস্ট বা ক্যানসার হওয়ায় এর কার্যক্ষমতা পরিবর্তিত হতে পারে।
ওষুধের পার্র্শ্বপ্রতিক্রিয়া: কিছু ওষুধ, যেমন লিথিয়াম বা অ্যামিওডারোন, থাইরয়েডের কার্যক্রমে প্রভাব ফেলতে পারে।
অতিরিক্ত আয়োডিন: অতিরিক্ত আয়োডিনযুক্ত খাবার বা ওষুধ গ্রহণ থাইরয়েড হরমোনের উৎপাদনে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
স্ট্রেস ও জীবনযাত্রার প্রভাব: দীর্ঘমেয়াদি মানসিক চাপ বা অনিয়মিত জীবনযাত্রা থাইরয়েডের ভারসাম্যহীনতা তৈরি করতে পারে।
জন্মগত ত্রুটি: কিছু শিশু জন্মগতভাবেই থাইরয়েড গ্রন্থির সমস্যায় আক্রান্ত হতে পারে। এদের জন্মের সাথে সাথে চিকিৎসা নিশ্চিত না করলে এদের ব্রেন ডেভেলপমেন্ট হয় না ফলে প্রতিবন্ধী হওয়ার আশংকা থাকে। নয়তো বয়সের তুলনায় ইমম্যাচিউর রয়ে যায়, এমনকী মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
আপনার মতামত লিখুন :