ডিজিটাল কনটেন্টের সুরক্ষায় কপিরাইট আইন

হায়দার তানভীরুজ্জামান

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ৯, ২০২৫, ০৮:১৮ পিএম

ডিজিটাল কনটেন্টের সুরক্ষায় কপিরাইট আইন

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে ডিজিটাল কনটেন্ট ক্রিয়েশন পেশা। খ্যাতির পাশাপাশি আয়ের সুযোগ থাকায় বিশ্বজুড়ে ডিজিটাল কনটেন্ট ক্রিয়েশনকেই পেশা হিসেবে বেছে নিচ্ছেন অনেকে। পৃথিবীর যে কোনো স্থান থেকে যে কোনো বয়স ও শ্রেণির ইন্টারনেট ব্যবহারকারী প্রতিদিনই যুক্ত হচ্ছেন ডিজিটাল কনটেন্টের ভার্চুয়াল দুনিয়ায়।

কিন্তু অনেক সময়েই নিজের কনটেন্ট চুরি হওয়ার মতো বিরূপ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয় ডিজিটাল কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের। এমন সমস্যার সমাধান এবং ডিজিটাল কনটেন্টের রক্ষাকবচ হতে পারে কপিরাইট আইন। ডিজিটাল কনটেন্টের চৌর্যবৃত্তি থামাতে ডিজিটাল কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের জন্য কপিরাইট আইনের সেসব সমাধান নিয়েই লিখেছেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হায়দার তানভীরুজ্জামান।    

মেধাস্বত্বের সুরক্ষা: কপিরাইট কী এবং কেন গুরুত্বপূর্ণ?
আপনি যদি একজন কনটেন্ট ক্রিয়েটর, লেখক, শিল্পী বা উদ্যোক্তা হন, তবে আপনার সৃষ্টিকর্মের মেধাস্বত্ব সুরক্ষা কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা নিশ্চয়ই জানেন। কপিরাইট একটি আইনি ব্যবস্থা, যা আপনার মৌলিক সৃষ্টিকর্মকে সুরক্ষিত রাখে এবং অন্য কেউ আপনার অনুমতি ছাড়া তা ব্যবহার, পুনঃপ্রকাশ বা বিক্রি করতে পারে না।

কপিরাইটের সংজ্ঞা
কপিরাইট হলো মৌলিক সৃষ্টিকর্মের মালিকানা বা স্বত্বাধিকারী নিশ্চিত করার প্রক্রিয়া। এটি সৃষ্টিকর্তাকে তার কাজের ওপর একচেটিয়া অধিকার প্রদান করে, যার মাধ্যমে তিনি তার কাজের ব্যবহার, প্রকাশ, পুনর্মুদ্রণ, অনুবাদ, বিক্রয় ইত্যাদির নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেন। 

কপিরাইটের আওতায় আসতে পারে সাহিত্য বা যে কোনো লেখা, শিল্পকর্ম, সংগীত, চলচ্চিত্র, স্থাপত্য, আলোকচিত্র, ভাস্কর্য, নকশা, লেকচার, কম্পিউটার প্রোগ্রাম, সফটওয়্যার, ওয়েবসাইট, অ্যাপস, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পেজ বা আইডি (যেমন ফেসবুক পেজ, টিকটক আইডি, ইনস্টাগ্রাম পেজ, লিংকডইন, ইউটিউব চ্যানেল)। অর্থাৎ যা কিছু মৌলিকভাবে তৈরি করা হবে, সবকিছুই কপিরাইটের আওতায় আসতে পারে। 

আবার কপিরাইট হচ্ছে মেধা সম্পদের উপর যে সম্পদ উৎপাদনকারীর অধিকারের স্বীকৃতি। অর্থাৎ এর মাধ্যমে যিনি মালিক তার নামে মেধা সম্পদটি রেজিস্ট্রেশন হয়। মেধাস্বত্বের ইংরেজি পরিভাষা ‘কপিরাইট’ বলতে আক্ষরিক অর্থে কোনো মৌলিক সৃষ্টির ‘অনুলিপি তৈরির অধিকার’ বোঝায়। 

কেন কপিরাইট রেজিস্ট্রেশন প্রয়োজন?
কপিরাইট রেজিস্ট্রেশন করে আপনি আপনার মেধা, স্বত্ব এবং সৃষ্টির আইনগতভাবে সুরক্ষিত করতে পারবেন এবং যে কোনো সমস্যা হলে আপনি আইনগত প্রতিকার পেতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, যদি আপনার ফেসবুক পেজ বা টিকটক আইডির নাম বা কনটেন্ট কারো দ্বারা কপি বা নকল করা হয়, তবে বাংলাদেশের কপিরাইট আইন অনুসারে রেজিস্ট্রেশন আপনাকে আইনগতভাবে সাহায্য করবে। 

কপিরাইট নিবন্ধন করার পদ্ধতি
তথ্যপ্রযুক্তি-ভিত্তিক ডিজিটাল কর্ম যেমন- সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ফেসবুক পেজ, টিকটক আইডি, ইউটিউব চ্যানেল, ইনস্টাগ্রাম পেজ, অ্যাপস, কম্পিউটার প্রোগ্রাম, সফটওয়্যার, ওয়েবসাইটসহ কপিরাইটের আওতাধীন বিষয়গুলো নিবন্ধনের জন্য এই পদক্ষেপগুলো অনুসরণ করতে হবে-
১) আবেদনপত্র সংগ্রহ: প্রথমে কপিরাইট অফিসের ওয়েবসাইট থেকে আবেদনপত্র সংগ্রহ করুন।
২) আবেদনপত্র পূরণ: যে বিষয়টি কপিরাইট করতে চান তার বিস্তারিত বিবরণ, স্বত্ব কার নামে হবে, শর্তসমূহ ইত্যাদি তথ্য দিয়ে আবেদনপত্র পূরণ করুন। 
৩) ডিজিটাল কর্মের স্ক্রিনশট: ফেসবুক পেজ, টিকটক, ইউটিউব চ্যানেল, ইনস্টাগ্রাম পেজের স্ক্রিনশট নিয়ে রঙিন প্রিন্ট করে তার উপর স্বত্বাধিকারী নিজ হাতে স্বাক্ষর করুন। পেজটির প্রকাশনার তারিখ, পেজের নাম, লিংক, নাম ঠিকানা এবং ইমেইল আইডি লিখুন। সফটওয়্যার, ওয়েবসাইট, অ্যাপসের ক্ষেত্রেও প্রথম পাতা ও আপডেট করা ডোমেনের স্ক্রিনশট নিয়ে ৩ কপি রঙিন প্রিন্ট করে তার ওপর স্বত্বাধিকারীর নিজ হাতে স্বাক্ষর করবেন। 
৪) জাতীয় পরিচয়পত্র ও ছবি: স্বত্বাধিকারী ব্যক্তির জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি এবং এক কপি পাসপোর্ট সাইজ ছবি প্রয়োজন হবে। একক প্রতিষ্ঠান হলে চলতি বছরের ট্রেড লাইসেন্স কপি, যৌথ হলে অংশীদারিত্বের চুক্তি এবং কোম্পানি হলে মেমোরেন্ডাম এর কপি জমা দিতে হবে।
৫) ফি: কপিরাইট নিবন্ধন করতে ই-ট্রেজারি চালান এর মাধ্যমে ফি প্রদান করুন। কপিরাইট নিবন্ধন ফি কাজের ধরনের উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন হতে পারে।
৭) হস্তান্তর দলিল: মালিকানার ক্ষেত্রে ৩০০ টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে হস্তান্তর দলিল দাখিল করতে হবে।
৮) অঙ্গীকারনামা: কর্মটি নিয়ে কোনো মামলা-মোকদ্দমা বিচারাধীন নেই এবং এর তথ্য নির্ভুল মর্মে কার্টিজ পেপারে অঙ্গীকারনামা জমা দিতে হবে।
৯) আইনজীবীর মাধ্যমে আবেদন: যদি আপনি আইনজীবীর মাধ্যমে আবেদনপত্র দাখিল করতে চান, তবে আবেদনপত্রের সঙ্গে ক্ষমতাঅর্পণ পত্র বা ওকালতনামা দাখিল করতে হবে।
১০) কপিরাইট অফিসে জমা: আইনজীবীর মাধ্যমে বা প্রতিনিধি বা নিজে কপিরাইট অফিসে আবেদনপত্রটি অনলাইনে এবং প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টসসহ সরাসরি হার্ড কপি জমা দিন।
এসব পদক্ষেপ অনুসরণ করে আপনি আপনার ডিজিটাল বা মৌলিক সৃষ্টিকর্মটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধন করতে পারবেন এবং সুরক্ষা পেতে পারেন।

কপিরাইটের মেয়াদ
কপিরাইটের নির্দিষ্ট মেয়াদ রয়েছে, যা সৃষ্টিকর্মের প্রকারভেদে পরিবর্তিত হতে পারে। তবে ডিজিটাল ও তথ্যপ্রযুক্তি-ভিত্তিক সৃষ্টিকর্ম যেমন- সফটওয়্যার, অ্যাপস, ওয়েবসাইট, ইমেইল, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পেজ, আইডি ইত্যাদি এই ধরনের কপিরাইটের মেয়াদ প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে ৬০ বছর পর্যন্ত থাকে। 

কপিরাইট লঙ্ঘনের প্রতিকার
কেউ যদি কোনো সৃষ্টিকর্মের মালিকানা বা স্বত্বাধিকারী, লেখক বা প্রণেতার কোনো সৃষ্টিকর্ম নকল করে, পাইরেসি করে, কপিরাইট সংশ্লিষ্ট অন্যান্য অধিকার লঙ্ঘন করে, কোনো তথ্যপ্রযুক্তি-ভিত্তিক ডিজিটাল কর্ম লঙ্ঘন করে, অবিকল নকল প্রচার ও প্রকাশ করেন তাহলে দেওয়ানি ও ফৌজদারি এবং  প্রশাসনিক উভয় প্রতিকারগুলো চাইতে পারবেন। 

লেখকের ই-মেইল : advocatefindmy@gmail.com
 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!