ঢাকা রবিবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

স্মৃতিতে জাহাজ বাড়ি

মির্জা হাসান মাহমুদ

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২৪, ০৫:৫৯ পিএম

স্মৃতিতে জাহাজ বাড়ি

ছবি: ইন্টারনেট

দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম জনবহুল শহর ঢাকা। এই শহর ইতিহাসের অগণিত স্থাপত্যের গৌরব ধারণ করে। এ শহরের প্রতিটি কোণায় ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য স্থাপত্যের মধ্যে রহস্যময় একটি স্থাপত্য ছিল ধানমন্ডি লেকের পাশের বিখ্যাত ‘জাহাজ বাড়ি’। ধানমন্ডির ৫/এ রোডে অবস্থিত এ বাড়িটি ছিল আশেপাশের মানুষের কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দু। প্রায় এক যুগ আগে লেকের আশেপাশে গেলেই মাথা উঁচু করে থাকতে দেখা যেত জাহাজ বাড়ির বিশাল উঁচু মিনারটা। কালের গর্ভে কোথায় হারিয়ে গেলো সেই মিনার? কোথায় হারালো  জাহাজের মতো দেখতে খয়েরী রঙের সেই রহস্যময় বাড়িটি? চলুন জেনে নেয়া যাক জাহাজ বাড়ির ইতিহাস—

জাহাজ বাড়ি প্রথম দর্শনে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করত তার অনন্য স্থাপত্যশৈলীর জন্য। এর আকৃতি এবং গঠন ছিল আমাদের দেশের প্রচলিত বাড়িগুলোর থেকে আলাদা। বড় একটি জাহাজের মতো দেখতে এই বাড়িটি স্থানীয় বাসিন্দা ও পথচারীদের মাঝে রহস্য তৈরি করতো। অনেকেই ভাবতেন এটি হয়তো কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বা কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থার অফিস। কেউ কেউ একে ভৌতিক বাড়িও মনে করতেন। তবে উল্লেখ্য যে, ১৯৯৪ সালে নির্মাণ শেষে বাড়ির আকৃতি জাহাজের মতো ছিল না। নির্মাণের কিছুদিন পর ‘ঢাকা সিটি কর্পোরেশন’ বাড়িটির লেকসংলগ্ন প্রাচীর ভেঙে নতুন রাস্তা তৈরি করে। যার ফলে পরবর্তীতে বাড়ির মালিক সীমানার প্রাচীরকে জাহাজের আদলে নতুনভাবে নির্মাণ করেন। চিশতিয়া প্যালেসের গঠন ও নকশা ছিল অভূতপূর্ব। বাড়িটিতে দুইটি ফটক ছিল, প্রথম ফটক দিয়ে প্রবেশ করলেই দেখা মিলত বিশাল একটি সুইমিংপুলের। দ্বিতীয় ফটকের মাধ্যমে প্রবেশ করলে দেখা যেত মূল ভবনের সিঁড়ি। তিনতলা এ বাড়িটিতে মোট ৩৭টি গুম্বজ ছিল, যার প্রধান গুম্বজটির উচ্চতা ১৬ তলা ভবনের সমান। 
বাড়িটির মূল নাম ‘চিশতিয়া প্যালেস’ হলেও ‘জাহাজ বাড়ি’ নামেই এটি বেশি পরিচিত ছিল। জানা যায় ১৯৯৩ সালে প্রায় ১৬ কাঠা জমির ওপর এই বাড়ির নির্মাণ কাজ শুরু হয় এবং মাত্র এক বছরের মধ্যেই তা সম্পন্ন হয়। এটি তৈরি করেছিলেন এ কে এম আনোয়ারুল হক চৌধুরী; যিনি ‘শের এ খাজা’ নামে পরিচিত ছিলেন। শের এ খাজা ছিলেন রহস্যময় একজন ব্যক্তি, বিশ্ব নেতাদের সাথে ওঠাবসার জন্য তার পরিচিতি ছিল। ভারতের প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ী, জাতিসংঘের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব ইকবাল রেজা সহ বিভিন্ন শীর্ষ নেতাদের সাথে তার সম্পর্ক ছিল। শোনা যায়, তার সুনিশ্চিত ভবিষ্যৎবাণী করার ক্ষমতা ছিলো। ফলে অনেক নেতাদের পদচারণাও ছিল এ জাহাজ বাড়িতে। আরও শোনা যায়, তার ভবিষ্যৎ বাণী অনুসারে নাকি বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ব্যাক্তি রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন এবং এজন্য তাকে “কিং অব কিং মেকার” বলা হত। তিনি সুফিবাদি মতাবাদ দ্বারা বিশেষ ভাবে প্রভাবিত ছিলেন। তবে প্রচলিত সুফিবাদী পুরুষের মত কানকায়ে শরীফ বা জলসার আয়োজন করতেন না। ছিল না কোন মুরিদও।
২০১১ সালে শেরে খাজার মৃত্যুর পর তার মা, স্ত্রী রেহানা চৌধুরী, পুত্র রুবেল চৌধুরী ও কন্যা সাদিয়া চৌধুরী এ বাড়িতে থাকতেন এবং পরবর্তীতে জাহাজ বাড়ির বিভিন্ন স্থানে ফাটল ধরলে তার পরিবার এটিকে সংস্কার না করে, বাণিজ্যিক ভবন তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়।২০১৫ সালে তারা ‘শান্তা হোল্ডিং কোম্পানি’র সাথে চুক্তি করে, যার ভিত্তিতে ২০১৬ সালে বাড়িটি ভেঙে ফেলা হয়। ঠিকাদারদের মতে, বাড়িটির গাঁথুনি এতটাই মজবুত ছিল যে এটি ভাঙতে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে বেশি সময় লেগেছিল। 
বর্তমানে সেই জাহাজ বাড়ির জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে ১৪ তলা বিশিষ্ট আধুনিক বহুতল ভবন ‘চিশতিজ ইয়ট’। এই ভবনটিতে রয়েছে ২০টি বিলাসবহুল এপার্টমেন্ট, যার প্রত্যেকটির আয়তন প্রায় ৩০০০ বর্গফুট। নতুন এই ভবনটি স্থপতি নাহাস আহমেদ খলিলের নকশায় নির্মিত হয়েছে, যেখানে রয়েছে সুইমিংপুল, জিম এবং কমন স্পেস সহ নানা নাগরিক সুবিধা।

চিশতিয়া প্যালেস আজ বাস্তব জগত থেকে হারিয়ে গেলেও, এর অনন্য স্থাপত্য এবং রহস্যময় ইতিহাস মানুষের স্মৃতিতে বেঁচে থাকবে। ঢাকা শহরের সৌন্দর্য এবং রহস্যের প্রতীক হয়ে হয়তো এই বাড়িটি থেকে যাবে নগরবাসীর হৃদয়ে। 
 

আরবি/ আরএফ

Link copied!