ঢাকা সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৪

দেশে-বিদেশে: সৈয়দ মুজতবা আলীর আফগান ভ্রমণকাহিনী

এস ডি সুব্রত

প্রকাশিত: অক্টোবর ২, ২০২৪, ০২:৩৪ পিএম

দেশে-বিদেশে: সৈয়দ মুজতবা আলীর আফগান ভ্রমণকাহিনী

চিত্রকর্ম: পিয়াজা সান মার্কো(জার্মান চিত্রশিল্পী)

প্রবন্ধ

বাংলা সাহিত্যে সহজ, সরল সরস, অসাধারণ রম্যরচনার অনবদ্য রূপকার সৈয়দ মুজতবা আলী ভাষা ও ভঙ্গির রম্যতায় অনন্য অবদান রেখে গেছেন। ‘দেশে-বিদেশে’ (১৯৪৯) তার শ্রেষ্ঠ ভ্রমণসাহিত্য। আফগানিস্তান ভ্রমণের অভিজ্ঞতা এই বইটির উপজীব্য হয়েছে। কলকাতা থেকে কাবুলে যাত্রার ঘটনা দিয়ে এর কাহিনী শুরু হয়। এরপর তিনি কাবুলের বৈচিত্র্য ছাড়াও সেখানে তার সঙ্গে পরিচিত হওয়া ব্যক্তিদের সঙ্গে পরিচয়, কথোপকথন এবং দৈনন্দিন জীবনের কার্যকলাপ সূক্ষ্ম রসবোধের সঙ্গে তুলে ধরেছেন। সৈয়দ মুজতবা আলী  একজন  বহু ভাষাবিদ লেখক।  রম্যলেখক হিসেবে সুপরিচিত। যার দখলে আঠারোটি ভাষা, রাশিয়ান ভাষার উপন্যাস বাংলায় অনুবাদ হয়েছে যার হাতে, জার্মান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট, বিশ্বভারতী থেকে স্নাতক, মিসরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা, গীতা থেকে গীতবিতান যার সম্পূর্ণ মুখস্থ। গুরুগম্ভীর সাহিত্যকে তিনি রম্যের আঙ্গিকে লিখে পাঠকদের মন জয়  করেছিলেন। বহু ভাষাবিদ লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী ১৯০৪ সালে সিলেটে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার মাধ্যমিক ছাত্রজীবন সিলেটেই কাটে। ১৯২১ সালে তিনি শান্তিনিকেতনে ভর্তি হন। বিভিন্ন ভাষা নিয়ে তার পড়ালেখা এখানেই শুরু হয়। শান্তিনিকেতনে পড়ালেখার পর আফগানিস্তান সরকারের অনুরোধে ‘কাবুল কৃষি কলেজে’ ফারসি ও ইংরেজি ভাষার শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। এই আফগানিস্তানের নানা অভিজ্ঞতা নিয়েই তার বিখ্যাত ভ্রমণকাহিনী ‘দেশে-বিদেশে’ বইটি। তার রসনাভরা শব্দের বিভিন্ন অভিজ্ঞতার সঙ্গে মানুষ প্রথমবারের মতো পরিচিত হয়। দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল এই ভ্রমণকাহিনী। বইয়ের নাম ‘দেশে-বিদেশে’ হলেও এটি মূলত তার আফগানিস্তানের জীবনযাপন এবং সেখানকার অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা। কাহিনীর  শুরু  হাওরা স্টেশন থেকে পেশওয়ারের দিকে ট্রেনযাত্রা দিয়ে। দেশত্যাগের সময়ে স্বাভাবিকভাবেই সবার বুকের ভেতরটা আর্দ্র হয়ে ওঠে। অপরিচিত পরিবেশে নিজেকে ভীষণ একা মনে হয়। লেখকও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না।
ট্রেন যখন তীব্রগতিতে ছুটে যাচ্ছিল তিনি সতর্কদৃষ্টিতে জানালার বাইরে বাংলাদেশের পরিচিত কোনো ছবি খুঁজছিলেন। একটি সুপারি গাছ কিংবা একটি আম গাছ হয়তো তার অন্তরে তৃপ্তি দিতে পারত। স্মৃতিকাতরতায় তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল অতীতের কাছে। ট্রেন এগোনোর সঙ্গে সঙ্গে মুজতবা আলীর  বর্ণনায় চলে আসে ভৌগোলিক বর্ণনা, কখনো বা স্থানীয় মানুষের বর্ণনা আর এ রকম কাঠখোট্টাবিষয়ক আলোচনাগুলোও তার কথার রসে এমনভাবে সিক্ত যে পাঠক সে রস আস্বাদন করতে বাধ্য। সঙ্গে তার স্বাভাবিক রসিকতা যুক্ত তো হয়েছেই সারাটা সময় ধরে । সৈয়দ মুজতবা আলীর দেশে বিদেশে পাঠানদের আন্তরিকতা ও আড্ডার মনোভাবের বেশ ভালো ছবি ফুটে উঠেছে। যখন আপন দেশ ছেড়ে আসার ফলে তার মন বেশ বিপর্যস্ত, এক পাঠান বৃদ্ধ তা খেয়াল করে তখন নিজ থেকেই আলাপ শুরু করে দিলেন। সামনের বুড়ো সর্দারজীই প্রথম আলাপ আরম্ভ করলেন। ‘গোয়িঙ ফার?’ নয়, সোজাসুজি ‘কহাঁ জাইয়েগা?’ আমি ডবল তসলিম করে সবিনয় উত্তর দিলুম ভদ্রলোক ঠাকুরদার বয়সী আর জবরজঙ্গ দাড়ি-গোঁফের ভেতর অতিমিষ্ট মোলায়েম হাসি। বিচক্ষণ লোকও বটে, বুঝে নিলেন নিরীহ বাঙালি কৃপাণবন্দুকের মাঝখানে খুব আরাম বোধ করছে না। বাইরে থেকে পাঠানদের শুষ্ক, রসকষহীন মনে হলেও একবার আলাপ হলেই তারা যে কাউকে আপন করে নেয়। গল্পের বেশিরভাগ যদিও নিজেদের গোষ্ঠী আর জাতির কথা কিন্তু তাতে করে তাদের চিন্তাভাবনা আত্মকেন্দ্রিক ভাবলে ভুল হবে। এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ পাওয়া যায় তাদের মেহমানদারিতে। গরিব জাতি হলেও মেহমানদারিতে তাদের কোনো কমতি নেই। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, মেহমানদারি করার ইচ্ছা টাকা থাকা না থাকার উপর নির্ভর করে না।
অতিথিকে বাড়িতে ডেকে নেওয়ার মতো আনন্দ পাঠান অন্য কোনো জিনিসে পায় না আর সে অতিথি যদি বিদেশি হয় তাহলে তো আর কথাই নেই। তারা গল্পগুজব না করে সময় কাটাতে পারে না। এই আড্ডার অজুহাতে তারা বেশ মজাদার কাজকর্ম করে থাকে । গল্পগুজব না করে সে এক মাইল পথও চলতে পারে না। কাউকে না পেলে সে বসে যাবে রাস্তার পাশে। মুচিকে বলবে, দাও তো ভায়া, আমার পয়জারে গোটা কয়েক পেরেক ঠুকে। মুচি তখন ঢিলে লোহাগুলো পিটিয়ে দেয়, গোটা দশেক নতুনও লাগিয়ে দেয়। এই রকম শ’খানেক লোহা লাগালে জুতার চামড়া আর মাটিতে লাগে না, লোহার ওপর দিয়েই রাস্তার পাথরের চোট যায়। হাফসোল লাগানোর খরচাকে পাঠান বড় ভয় করে কি-না। সেই পেরেক আবার হরেকরকম সাইজের হয়। পাঠানের জুতা তাই লোহার মোজায়িক।
পাঠানরা অলস এবং আড্ডাবাজ জাতি হলেও তারা আরামপ্রয়াসী নয়। গালগল্প আর আড্ডায় মশগুল থাকা স্বভাবের ভেতরে তাদের অকৃত্রিম দেশপ্রেম আবিষ্কার করে মুজতবা আলী অবাক হয়েছেন। তারা ব্যবসা-বাণিজ্যে বেশ অপরিপক্ব হওয়ায় তাদের রাজ্য কখনো অর্থনৈতিক সচ্ছলতা ওভাবে চোখে দেখেনি। অভাবের তাড়নায় তাই তারা লুটতরাজ করে বেড়ায়। তাদের কতগুলো গোষ্ঠী রয়েছে যেমন— আফ্রিদী, শিনওয়ারী, খুগিয়ানী যাদের মধ্যে সারা বছরই মারামারি লেগে থাকে। পেশওয়ার থেকে লেখকের যাত্রা শুরু হয় আফগানিস্তানের দিকে। এই দেশের অস্থিতিশীল অবস্থা নিয়ে লেখক বেশ শঙ্কিত ছিলেন। পেশওয়ার পৌঁছে আফগান যাত্রীদের আবার নতুন করে স্ট্যাম্প করে নিতে হয়। এই স্ট্যাম্পের মেয়াদও মাত্র তিন দিন। এই ব্যবস্থার কারণ হচ্ছে, খাইবারপাসের আশপাশে যে কোনো সময় দাঙ্গা লেগে যেতে পারে। ‘খুনের বদলা খুন’ এই নীতিতেই আফগানরা বিশ্বাসী। অন্যান্য সভ্য দেশকে অনুসরণ করে যদিও তাদের পথেঘাটে কিছুসংখ্যক পুলিশ রাখা হয় কিন্তু এই পুলিশেরা এসব খুনখারাবির ব্যাপারগুলোতে বেশ উদাসীনই থাকে। লেখক তার হাস্যরসাত্মক ভাষায় এভাবে ব্যাখ্যা করেছেন— তবু আফগানিস্তান স্বাধীন সভ্য দেশ; আর পাঁচটা দেশ যখন খুনখারাবির প্রতি এত বেমালুম উদাসীন নয় তখন তাদেরও তো কিছু একটা করার আছে এই ভেবে দুচারটে পুলিশ দু-একদিন অকুস্থলে ঘোরাঘুরি করে যায়। যদি দেখে আপনার আত্মীয়স্বজন কান্তা দর্শনে বুদ হয়ে আছেন অথবা শোনে যে খুনি কিংবা তার সুচতুর আত্মীয়স্বজন আপনার আত্মীয়স্বজনকে চাকচিক্যময় বিশেষ বিরল ধাতুদ্বারা নাক-কান, চোখ-মুখ বন্ধ করে দিয়েছে, আপনারা জীবনের এই তিন দিনের মুসাফিরিতে কে দুই ঘণ্টা আগে গেল, কে দুই ঘণ্টা পড়ে গেল, কে বিছানায় আল্লা রসুলের নাম শুনে শুনে গেল, কে রাস্তার পাশের নয়ানজুলিতে খাবি খেয়ে খেয়ে পাড়ি দিল এসব তাবৎ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র বিচলিত হন না, তবে বিবেচনা করুন, মহাশয়, পুলিশ কেন মিছে আপনাদের তথা খুনি এবং তস্য আত্মীয়স্বজনদের মামলায় আরও ঝামেলা বাড়িয়ে সবাইকে খামকা, বেফায়দা তথ্য করবে? শেষে গন্তব্যস্থল কাবুলের দিকে লেখক এগিয়ে যেতে থাকে। পথিমধ্যে নুড়িযুক্ত পথ, মরুভূমির মতো প্রান্তর, আফগান সীমান্তের শুরুতে এক দুর্গ, এক প্রাচীন সরাই, চমৎকার নিমলার বাগান পড়ল। লেখকের চোখে কিছুই এড়াচ্ছিল না। বাসের মধ্যে যাত্রীরা কে কী রকম জামা পরেছিল। কত অদ্ভুত এবং বাংলার লোকদের থেকে তা কত পৃথক, কত পুরোনো সংস্কৃতি ধারণ করে আছে সে জামা সবই তার লেখায় ধরা পড়ছিল। সঙ্গে সে অঞ্চল সম্পর্কে বিস্তর কথাবার্তা তো রয়েছেই। এত চমৎকার করে ইতিহাস, ভূগোল এবং বাস্তব গল্পের মিশেল সম্ভবত মুজতবা আলীর মতো পাণ্ডিত্য ছাড়া লেখা সম্ভব নয়। পশ্চিম ভারত আর আফগানিস্তানের শহর গ্রাম সবকিছুই তার লেখনীর জোরে বইয়ের কাগজ ছেড়ে পাঠকের চোখে মোহনীয় দৃষ্টিতে ধরা পড়ে। অবশেষে রেডিওর ধ্বনি শুনে লেখক বুঝতে পারলেন তিনি কাবুল এসে পৌঁছেছেন। কাবুল ইউরোপের কোনো কিছু অনুসরণ করতে গেলে ফ্রান্সকে আদর্শ হিসেবে ধরে নেয়। সেখানে বেতারবাণী শুরু হয় ‘ইসি পারি’ বা ‘এখানে প্যারিস’ দিয়ে। লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী দাবি করছেন আফগানিস্তানের ইতিহাস না জেনে ভারতবর্ষের ইতিহাস সম্পূর্ণ করার কোনো সুযোগ নেই। তবে এই ইতিহাস না লেখারও কিছু কারণ রয়েছে। আফগানিস্তানের ভৌগোলিক সীমান্ত এমনই জটিল যে নিজেদের ইতিহাস নিয়ে মাথা ঘামাতে হলে তাদেরকে আরও কয়েকটি দেশের ইতিহাস নিয়ে পর্যালোচনা করতে হবে। আফগানিস্তানের উত্তর ভাগের ইতিহাস তার সীমান্ত নদী আমুদরিয়ার ওপারের তুর্কিস্তানের সঙ্গে, পশ্চিমভাগ ইরানের সঙ্গে, পূর্বভাগ অর্থাৎ কাবুল জলালাবাদ খাস ভারতবর্ষ ও কাশ্মীরের ইতিহাসের সঙ্গে মিশে গিয়ে নানা যুগে নানা রূপ ধারণ করেছে। ভারতবর্ষ আর আফগানিস্তানের ইতিহাস এমনভাবে মিলেমিশে রয়েছে যে, এই দুই দেশকে আলাদা করে দেখাকে লেখক কুসংস্কার হিসেবে মন্তব্য করেছেন।
এক সময় পশ্চিম ভারত ও আফগানিস্তানের মধ্যে সংস্কৃতিগত কোনো পার্থক্য ছিল না। এই বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা কনিষ্ক তার শেষ বৌদ্ধ অধিবেশনের প্রতিবেদন যে তাম্রফলকে খোদাই করে রেখেছিলেন তা আফগানিস্তানে পাওয়া গেলেও অবাক হওয়ার মতো নয়। কারণ কনিষ্ক যতখানি ভারতীয় রাজা ছিলেন ঠিক ততটুকুই আফগান রাজাও ছিলেন। ভারতবর্ষে কুষাণদের পতনের পরেও আফগানিস্তানে তারা দু’শ বছর শাসন করেছিল। ভ্রমণকাহিনী হওয়া সত্ত্বেও ‘দেশে-বিদেশে’ আফগানিস্তানের ইতিহাসের একটি লিখিত দলিল। তার রম্য-রসাত্মক বর্ণনা, মানুষের সঙ্গে রসালাপ, ভ্রমণের সময় বিভিন্ন স্থানের বর্ণনার মধ্য দিয়ে আফগানিস্তানের ইতিহাস ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট দেখা যায়। শুধু আফগানিস্তান নয়; ভারত, ব্রিটেনসহ বিভিন্ন দেশের ইতিহাস এবং তৎকালীন রাজনীতিক পরিপ্রেক্ষিত ও সম্পর্কও তিনি তুলে ধরেছেন। কাবুলে অবস্থানের শেষ পর্যায়ে আফগানিস্তানের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের পরিবর্তন শুরু হয় এবং বাচ্চায়ে সাকোর আক্রমণে বিপর্যস্ত কাবুল ত্যাগের মধ্য দিয়ে শেষ হয় ‘দেশে-বিদেশে’। শেষটা ছিল হৃদয়বিদারক। আবদুর রহমানের সঙ্গে লেখকের বিচ্ছেদ মুহূর্তটি দিয়েই করুণভাবে কাহিনী শেষ হয়। সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘দেশে-বিদেশের’ একটি অন্যতম প্রধান চরিত্র আবদুর রহমান। লেখক আবদুর রহমানের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে ‘বরফাচ্ছাদিত জনাকীর্ণ কাবুলের পথে বিশাল বপু পাঠান আবদুর রহমানের পিঠে একটা বিরাট বোঁচকা; তার পিছু পিছু ক্ষীণ বপুর বাঙালি সৈয়দ মুজতবা আলী হেঁটে হেঁটে যাচ্ছেন!’ আবদুর রহমান সৈয়দ মুজতবা আলীর পাঠকের অতি পরিচিত চরিত্র।’
 

আরবি/ আরএফ

Link copied!