পূজা হলো আমাদের সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা কেবল ধর্মীয় উৎসবের নয়, বরং আমাদের শৈশবের আনন্দ এবং আবেগের একটি প্রতীক। যখনই পূজার সময় আসে, আমাদের মনে পড়ে শৈশবের সেই দিনগুলো—পূজার প্রস্তুতি, আনন্দ, উচ্ছ্বাস, এবং নানা রকমের স্মৃতি। এই প্রবন্ধে আমি সেই সব অনুভূতি এবং স্মৃতির কথা বলতে চাই, যা আজও আমাকে স্পর্শ করে। শৈশবে পূজার আগমনে যে উত্তেজনা দেখা দিত, তা অন্য কোনো সময়ে অনুভব করা যেত না। পূজার কয়েক সপ্তাহ আগে থেকেই বাড়ির সবাই মিলে প্রস্তুতি শুরু হতো। মা এবং দাদি অনেক সময় ধরে বাজারে ঘুরতেন নতুন পোশাক কিনতে। আমি এবং আমার ভাই-বোনেরা সেই নতুন পোশাকের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম। বাজারে নতুন জামাকাপড়ের গন্ধ, মিষ্টির দোকানের সুগন্ধ, এবং প্যান্ডেলের সাজসজ্জা সবকিছু মিলে এক আনন্দের পরিবেশ তৈরি করত।
পূজার সময় বিশেষ করে দোল পূর্ণিমা এবং দুর্গাপূজা আমাদের জন্য ছিল এক ভিন্ন মাত্রার উৎসব। মন্দিরে যাওয়ার সময় যে সুরম্য দৃশ্য ফুটে উঠত, তা মনকে প্রফুল্ল করে দিত। মা দুর্গাপূজার সময় বিশেষ আয়োজন করত। সন্ধ্যায় বোধনের সময় যখন মন্ত্রের ধ্বনি শোনা যেত, তখন মনে হতো, যেন দেবী আমাদের আশীর্বাদ করছেন। এই অনুভূতি আমাদের শৈশবের ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক শিক্ষা দিয়েছিল।
আমরা বন্ধুরা মিলে পূজার সময় নানা ধরনের খেলাধুলা, নাচ-গান এবং গল্পের আয়োজন করতাম। পূজার প্যান্ডেলে গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরে বেড়ানো, প্যান্ডেলের আলোকসজ্জা এবং মণ্ডপে মন্দিরের পরিবেশে বিচরণ করাটা এক অসাধারণ অনুভূতি ছিল। এ সময়ে আমরা সকলেই একসঙ্গে মিলেমিশে আনন্দে মেতে উঠতাম। পূজার সময় আমরা যখন মণ্ডপে যেতাম, তখন দেবীর কাছে প্রার্থনা করতাম— ‘মা, আমাদের বন্ধু-বান্ধবদের সাথে মিলেমিশে আনন্দ করতে সাহায্য কর।’ এই প্রার্থনা আমাদের মধ্যে একযোগিতার অনুভূতি জাগিয়ে তুলতো। শৈশবে বন্ধুত্বের সম্পর্কের গুরুত্ব আমাদের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছিল। এক সাথে আনন্দ ভাগ করে নেওয়া, হাসি-মজা করা এবং কিছু সময়ের জন্য সব কষ্ট ভুলে যাওয়া—এসব শৈশবের আনন্দের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল।
পূজার সময় বাড়ির মধ্যে যে আনন্দের পরিবেশ তৈরি হতো, সেটিও ছিল অসাধারণ। মিষ্টির স্তূপ, নতুন জামাকাপড়, এবং অঞ্জলি দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি—এই সবকিছু আমাদের মনে প্রাণবন্ত স্মৃতি তৈরি করতো। বাড়ির সকল সদস্য একত্রিত হয়ে গল্প করত, খাওয়া-দাওয়া করত এবং পূজার আনুষ্ঠানিকতা পালন করত। এটি আমাদের পরিবারের মধ্যে বন্ধনের এক দৃঢ় ভিত্তি তৈরি করেছিল।
পূজার সময় দানের সংস্কৃতি আমাদের মাঝে গেঁথে ছিল। মা সবসময় বলতেন, ‘পূজোর সময় যারা অভাবগ্রস্ত, তাদের সাহায্য করা উচিত।’ এই শিক্ষা আমাদের শৈশবে মানবিকতার মূল্য বোঝাতে সাহায্য করেছিল। আমরা সবাই মিলে খাবার ও জামাকাপড় বিতরণ করতে যেতাম, এবং এতে আমাদের মধ্যে সংহতির অনুভূতি জাগ্রত হতো।
পূজার সময়ে ছিল একটি বিষণ্নতা—মা দুর্গার বিসর্জন। এই মুহূর্তে আমাদের মনে হত, যেন আমাদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ হারিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই অভিজ্ঞতা আমাদের শিখিয়েছিল, কিছু জিনিস চিরকাল থাকে না। এটি আমাদের জীবনের বাস্তবতা উপলব্ধি করতে সাহায্য করেছিল।
পূজা শুধু ধর্মীয় উৎসব নয়, বরং এটি একটি মানবিক সম্পর্কের উৎসব। যখন আমরা এক সাথে এই উৎসব উদযাপন করি, তখন আমাদের মধ্যে এক অনুভূতির সৃষ্টি হয়। শৈশবের পূজার আনন্দ আমাদের মানবিকতা এবং সম্পর্কের মূল্যবোধকে শক্তিশালী করেছে। আজকের সময়ে, যখন আমরা প্রযুক্তির যুগে বাস করছি, শৈশবের সেই পূজার আনন্দ এবং সহজ সরলতা আজও আমাদের হৃদয়ে জীবন্ত।
পূজার সময়ের স্মৃতিগুলো আমাদের জীবনের অমূল্য রত্ন। তারা আমাদের শিখিয়েছে কীভাবে ভালোবাসা, সম্পর্ক এবং মানবিকতার ভিত্তিতে সমাজকে গড়ে তুলতে হয়। পূজা আমাদের জন্য কেবল একটি উৎসব নয়, বরং এটি আমাদের জীবনকে আলোকিত করার একটি উপায়। এই স্মৃতিগুলো আমাদের জীবনের পথপ্রদর্শক, যা আমাদেরকে সুন্দর এবং সমৃদ্ধ মানবজীবনের পথে পরিচালিত করে।
এভাবে, পূজার আনন্দে শৈশবের স্মৃতি আমাদের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যখনই পূজার সময় আসে, তখন আমাদের মনে এই স্মৃতিগুলো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে এবং আমাদের জীবনের এক বিশেষ রং যোগ করে।
আপনার মতামত লিখুন :