ঢাকা সোমবার, ২১ অক্টোবর, ২০২৪

আকাশে ওড়ার স্বপ্ন পূরণ

মির্জা হাসান মাহমুদ

প্রকাশিত: অক্টোবর ১৮, ২০২৪, ০৪:৩৫ পিএম

আকাশে ওড়ার স্বপ্ন পূরণ

ছবি: ইন্টারনেট

কখনো কি ভেবেছেন, যদি পাখির মতো আকাশে উড়ে সাদা মেঘের ভেলায় ভেসে বেড়াতে পারতেন, কেমন হতো? মুক্ত আকাশে হারিয়ে যাওয়ার এই স্বপ্ন অনেকের মনেই জাগে। জানেন কি? মেঘের মাঝে ঘুরে বেড়ানো বাস্তবে অসম্ভব মনে হলেও পৃথিবীতে এমন এক জায়গা আছে, যেখানে পাওয়া যায় এই অসাধারণ অনুভূতির ছোঁয়া। বলছি বলিভিয়া তথা পুরো বিশ্বের বিস্ময় সালার দি ইউনির কথা; যেখানে আকাশ আর মাটি এক হয়ে যায়।

বলিভিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত সালার দি ইউনি বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক আয়নাভূমি। প্রায় ১০,৫০০ বর্গকিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত এই বিস্ময়কর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আপনাকে নিয়ে যাবে এক অদ্ভুত স্বপ্নের রাজ্যে। আকাশের নীলিমা আর শুভ্র মেঘ যখন মাটির উপরে প্রতিফলিত হয়, তখন এই স্থানটি যেন এক বিশাল আয়নায় রূপান্তরিত হয়। লবণের এই মরুভূমি শুধু পর্যটকদের নয়, বিজ্ঞানী থেকে ফটোগ্রাফার; সবার কাছেই এক পরম আকর্ষণ।

প্রকৃতির জাদুর খেলা
সালার দি ইউনিতে বর্ষাকালে (ডিসেম্বর-মার্চ) লবণের উপর যখন বৃষ্টির পানি জমে, তখন পুরো অঞ্চলটি বিশাল এক আয়নার মতো হয়ে ওঠে। আকাশের প্রতিফলন এমন নিখুঁত হয় যে, আকাশ আর পৃথিবীর সীমারেখা যেন মুছে যায়। এই মিরর ইফেক্টের জন্য সালার দি ইউনি ফটোগ্রাফারদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় স্থান। অন্যদিকে শুকনো মৌসুমে (মে-নভেম্বর) সমগ্র এলাকা ধবধবে সাদা লবণপথে আচ্ছাদিত থাকে। সেই সময় পর্যটকরা লবণের প্রাকৃতিক ষড়ভুজাকার কাঠামো দেখতে পান, যা প্রকৃতির এক অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য।

পৌরাণিক, বৈজ্ঞানিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব
আন্দিজ পর্বতের আয়মারা সম্প্রদায় বিশ্বাস করে, পার্শ্ববর্তী আগ্নেয়গিরি তনূপা, কুসকু এবং কুসিনা অতীতে তিন দৈত্যাকৃতির মানুষ ছিল। তারা বলে, কুসকু তনূপাকে বিয়ে করলেও পরে কুসিনার সঙ্গে পালিয়ে যায়। শোকাহত তনূপা তখন তার সন্তানকে দুধ পান করাচ্ছিল। তার চোখের জল আর দুধ একসাথে মিশে তৈরি হয় সালার, অর্থাৎ লবণের সমতল। স্থানীয়দের কাছে এটি ‘সালার দি তনূপা’ নামেও পরিচিত। সেখানে এখনো তনূপাকে দেবী হিসেবে সম্মান করা হয়। অন্যদিকে বিজ্ঞানীরা বলেন, প্রায় ৩০-৪২ হাজার বছর আগে এই অঞ্চলটি লেক মিনচিন নামে একটি বিশাল হ্রদের অংশ ছিল। পরবর্তীতে হ্রদের পানি শুকিয়ে গেলে তলানিতে লবণ এবং অন্যান্য মূল্যবান খনিজ পদার্থ রয়ে যায়। পরবর্তীতে লবণ জমেই গঠিত হয়েছে এ সমতল ভূমি। এই অঞ্চলে বিশ্বের বৃহত্তম লিথিয়াম মজুদ রয়েছে, যা আধুনিক প্রযুক্তির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি, স্মার্টফোন থেকে ইলেকট্রিক গাড়ি; সব ক্ষেত্রেই এই ধাতুটি অপরিহার্য।

সালার দি ইউনির দর্শনীয় স্থানগুলো
ইনকাহুয়াসি আইল্যান্ড : এই ছোট্ট দ্বীপটি সালারের মাঝখানে অবস্থিত। যেখানে বিশালাকার ক্যকটাস দেখা যায়, যা দৈর্ঘ্যে প্রায় ৩৩ ফুট লম্বা। ১২০০ বছর পুরনো এই ক্যকটাসগুলো মরুভূমির মধ্যে জীবনের স্পন্দন বয়ে আনে।

ট্রেন গ্রেভইয়ার্ড : উইনি শহরের কাছাকাছি পুরোনো ট্রেনের ধ্বংসাবশেষ নিয়ে গঠিত এই জায়গাটি ইতিহাসের সাক্ষী। একসময় এই অঞ্চলটি বলিভিয়ার খনিজ পরিবহনের গুরুত্বপূর্ণ রুট ছিল। এখন এটি পর্যটকদের পছন্দের একটি ফটোগ্রাফি স্পট।

লবণের হোটেল : সালার দি ইউনিতে এক অনন্য অভিজ্ঞতা হবে লবণ দিয়ে তৈরি হোটেলগুলোতে রাতযাপন করা। পুরো হোটেল, প্রাচীর থেকে শুরু করে আসবাবপত্র পর্যন্ত  লবণের ইট দিয়ে তৈরি। এটিও পর্যটকদের জন্য এক দারুণ আকর্ষণ।

এছাড়া সালার দি ইউনি সল্ট ফ্ল্যাটের আশপাশে বেশ কিছু মনোমুগ্ধকর হ্রদ রয়েছে, যার মধ্যে লেগুনা কলোরাডা এবং লেগুনা ভার্দে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। লেগুনা কলোরাডা হ্রদটি উজ্জ্বল লালচে রঙের জন্য বিখ্যাত, যা এতে থাকা শৈবাল এবং খনিজের কারণে সৃষ্টি হয়। এটি বিভিন্ন প্রজাতির ফ্লেমিংগোর আশ্রয়স্থল হিসেবেও পরিচিত। অন্যদিকে, লেগুনা ভার্দে সবুজাভ জলরঙের জন্য খ্যাত, যার কারণ পানিতে মিশ্রিত তামা ও অন্যান্য খনিজ।

ভ্রমণের প্রস্তুতি ও যাত্রা
সাধারণত সালার দি ইউনিতে যাত্রা শুরু হয় বলিভিয়ার লা পাজ বা ইউনি শহর থেকে। ইউনি শহর এই মরুভূমির প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিচিত, যেখানে পর্যটকদের জন্য বিভিন্ন ধরনের ট্যুর প্যাকেজ পাওয়া যায়। এখানে ট্র্যাভেল গাইড সহ ৪ী৪ গাড়িতে করে তিন বা চার দিনের ট্যুর বেশ জনপ্রিয়। শুকনো ও বর্ষাকাল; দুই ভিন্ন ঋতুতেই এই সমভূমি ভিন্ন অভিজ্ঞতা দেয়, তাই ভ্রমণের আগে ঋতু অনুযায়ী প্রস্তুতি নেওয়া জরুরি।

পরামর্শ ও সাবধানতা

  • সালার দি ইউনির শুষ্ক পরিবেশে ত্বক শুষ্ক হয়ে যেতে পারে, তাই পর্যাপ্ত ময়েশ্চারাইজার এবং সানস্ক্রিন সঙ্গে রাখা জরুরি।
  • উচ্চতার কারণে (প্রায় ৩,৬৫৬ মিটার) অনেকেই প্রথমদিকে শ্বাসকষ্ট অনুভব করতে পারেন। সেজন্য হালকা খাবার ও পর্যাপ্ত পানি পানের পরামর্শ দেওয়া হয়।
  • বর্ষাকালে কিছু অংশ ডুবে যায়, তাই গাইডের নির্দেশনা মেনে চলা উচিত।

সালার দি ইউনির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, বিস্তৃত আয়না প্রভাব, আর লবণের বিশাল বিস্তার যে কারো মনে অসাধারণ অনুভূতির সঞ্চার করে। প্রকৃতির এই আশ্চর্য মায়ারাজ্যে ভ্রমণ করে মানুষ উপলব্ধি করে,পৃথিবীর কোণায় কোণায় আরও কত বিস্ময় যে অপেক্ষা করছে! তাই সুযোগ পেলে একবার হলেও এই জাদুকরী স্থানে ভ্রমণের পরিকল্পনা করে ফেলুন!

আরবি/ আরএফ

Link copied!