ঢাকা সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৪

কলকাতা পরিক্রমা

এস এম নওশের

প্রকাশিত: অক্টোবর ২০, ২০২৪, ১১:২০ এএম

কলকাতা পরিক্রমা

ছবি: ইন্টারনেট


কলকাতা শহরটাকে কেন জানি না আমার ভীষণ ভালোলাগে। এর কারণ খুঁজে পাই না যদিও। ২০১১ সালে প্রথম যখন এসেছিলাম, সেই তখনই মনে হয়েছিল এই শহর যেন আমার বড্ড আপন। আমি যেন এর আগেও এসেছি। সাইকোলজিতে একে কি যেন একটা টার্ম বলে মনে নেই। এবার আমার ৫ম বারের মতো আসা। গন্তব্য ছিল কাশ্মীর। হাতে ১ দিন সময় রেখে এসেছিলাম। সকালে বেরুলাম মীর্জা গালিব স্ট্রিট থেকে লক্ষ্যহীনভাবে। সেখানেই ছিল আমার হোটেল। হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম নিউমার্কেট এস্পল্যানেড মেট্রো। চড়ে বসলাম, থুড়ি দাঁড়ালাম দমদম গামি মেট্রো স্টেশনে। এই ভিড়ের মধ্যে মেট্রোতে সিট পাওয়া আর খড়ের ভেতর সুই পাওয়া একই। তারপরে আবার সিটের ওপরে লেখা আছে মহিলা ও বৃদ্ধদের জন্য সংরক্ষিত। আমার মেট্রো জার্নি ভীষণ ভালোলাগে। খরচও অনেক কম। মাত্র দশ টাকা খরচ করে দম দম স্টেশন চলে এলাম। চলে তো এলাম কিন্তু যাব কই? ঠিক করলাম এখন তো চক্র রেল চালু। এক কাজ করি, এখান থেকে মাঝের হাট চলে যাই কলকাতা স্টেশন শ্যামবাজার ক্যালকাটা পোর্টের দৃশ্য দেখতে দেখতে। মাঝের হাট থেকে শিয়ালদা ফিরব বালিগঞ্জ টালিগঞ্জ পার্ক সার্কাস দেখতে দেখতে। কাউন্টার থেকে টিকিট নিলাম। দম দম থেকে মাঝের হাট ভাড়া নিল পাঁচ টাকা। ১২টা ২০-এর ট্রেন। বজবজ লোকাল। ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষা করতে করতে দেখলাম অনেক ট্রেনের যাওয়া-আসা। দম দম অত্যন্ত ব্যস্ততম একটা স্টেশন। প্রায় দুই মিনিট পরপরই আপ অ্যান্ড ডাউন লাইন দিয়ে ট্রেন আসছে বা যাচ্ছে। কোনোটা দাঁড়াচ্ছে, কোনোটা সিগন্যাল ক্লিয়ারেন্স নিয়ে ঝিক ঝিক করে চলে যাচ্ছে। আমার বজবজ লোকালও এলো। আমি উঠে পড়লাম। ট্রেন ছেড়ে দিল। অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করলাম আমি ছাড়া এই কামরায় কোনো পুরুষ নেই। চোখে পড়ল লেখা ‘লেডিস অনলি’। হায় হায় কি করলাম এটা। না জেনে কামরায় উঠে গেলাম। পরে এক ভারতীয় বন্ধুর কাছে জেনেছিলাম লোকাল ট্রেনগুলোতে নারীদের জন্যে একটা বা দুটো কামরা সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। ভালো লাগল ভারতীয় রেলের এই উদ্যোগকে। এতে বহু কর্মজীবী নারীরা; যাদের প্রতিদিন বেরুতে হয় তারা বেঁচে গেছেন অনেক উটকো বিড়ম্বনা থেকে। ভাগ্যিস নারীরা খেপচুরিয়াস হয়ে আমায় কিছু বলেননি। এনাদের জিভের যা ধার। একেবারে কেলেঙ্কারিয়াস ব্যাপার হয়ে যেত। আমার চেহারা দেখে হয়তো উনারা ক্যাবলা-ভ্যাবলা ভেবেছিলেন। চুপচাপ দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। বিধাননগর স্টেশনে আসতেই সবার আগে নেমে গেলাম। অন্য কামরায় ঠেলে ঠুলে উঠলাম। বজবজ লোকাল এই ট্রেনটা আসলে চক্র রেল ছিল না এটা শিয়ালদা স্টেশন বাইপাস করে পার্ক সার্কাস বালিগঞ্জ টালিগঞ্জ ইত্যাদি হয়ে মাঝের হাট এলো। এখানে অদ্ভুত একটা ব্যাপার দেখলাম। টালিগঞ্জ স্টেশন পেরুতেই চলে এলো আরেকটা স্টেশন লেক গার্ডেন্স। এত অল্প দূরত্বে দুটা স্টেশন! মানে এক স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম শেষ, তো অন্যটির শুরু।
পৌঁছে গেলাম মাঝের হাট। ফিরতি টিকিট করে নিলাম। স্টেশনটা শহরতলির স্টেশন। ভিড় ভাড় নেই। পরের ট্রেনে চড়ে বসলাম। কিন্তু আমি ভুল ট্রেনে চড়েছি। এটা ছিল বজবজের ট্রেন। যাক গে, বজবজও না হয় দেখে  গেলাম। টিটি ধরলে টিকিট দেখিয়ে বলব, ভুল করে উঠে গেছি। কিন্তু কেউ চেক করতে এলো না। 
ঘণ্টাখানেক জার্নি করে চলে এলাম বজবজ। এটা একেবারেই প্রান্তিক স্টেশন। হুগলি নদীর ধারে। এখানে থেকেই নাকি স্বামী বিবেকানন্দ জাহাজ থেকে নেমে শিয়ালদার ট্রেন ধরেছিলেন। এই স্টেশনে জীবনে প্রথম লেবু আর ছাতুর সরবত খেলাম। সরবতে এরা চিনি না দিয়ে লবণ দিয়েছিল। একই ট্রেনে ফিরলাম শিয়ালদা। পরদিন আমার দিল্লি যাবার দুরন্ত এক্সপ্রেস ট্রেনটা কোন প্ল্যাটফর্ম থেকে ছাড়বে দেখে নিলাম। শিয়ালদা থেকে বেরিয়ে বাসে চড়লাম। গন্তব্য হাওড়া স্টেশন। সেখানে একটা রেল মিউজিয়াম হয়েছে শুনেছিলাম। সেটা দেখার জন্যেই হাওড়া যাওয়া। হাওড়া নেমে একে ওকে জিজ্ঞেস করে চলে এলাম। মিউজিয়াম। তখন শেষ বিকেলের পড়ন্ত বেলা।
ত্রিশ টাকা টিকিট করে ঢুকলাম। দিল্লির রেল মিউজিয়ামের মতো অত বড় না হলেও বেশ ভালোই। একটা সার্কুলার টয় ট্রেন আছে। এর টিকিট ও ত্রিশ টাকা। এখানে হাওড়া রেল স্টেশনের একটা রেপ্লিকা বিল্ডিং আছে। এখান থেকেই টয় ট্রেনের যাত্রা শুরু আর শেষ। যিনি টিকিট দেন তিনিই আবার এই ট্রেনটা চালান। চড়লাম এটায়। এরপর এর চালক আমিন উদ্দিনের সঙ্গে পরিচিত হলাম। সেল্ফি নিলাম। পুরো এরিয়াটা খুব বেশি বড় নয়। এক ঘোরাতেই দেখা শেষ। এখানে একটা ট্রেনের ইঞ্জিন আছে যেটা ছিল তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান রেলওয়ের ইঞ্জিন। এটা কীভাবে এখানে এলো; এর বিশদ কোনো বর্ণনা পাইনি। আছে বিভিন্ন মডেলের স্টিম ইঞ্জিন ডিজেল আর ইলেক্ট্রিক ইঞ্জিন। পুরনো দিনের রেল কামরা। রেলের বিভিন্ন সরঞ্জাম। এটা দেখা শেষ করে চলে এলাম নদীর ধারে। তখন বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা। জ্বলে উঠেছে হাওড়া ব্রিজের লাল নিল হরেক রঙের আলো। সে সঙ্গে হাওড়া রেল স্টেশনের ফ্লুরোসেন্ট লাইটগুলো। আকাশে দেখি কালো মেঘ। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। নদী থেকে বেশ হাওয়াও আসছে। চলে এলাম ফেরি ঘাটে। মাত্র ছয় টাকা দিয়ে ওপারের ফেয়ারলি ঘাটের টিকিট নিলাম। যাত্রী বেশি ছিল না। ওঠার অল্প কিছুক্ষণ পরেই ছেড়ে দিল। নদীতে বেশ ঢেউ ছিল। দুলছিল ফেরিটা বেশ। কাল বৈশাখি ঝড়ের পূর্ব লক্ষণ। ই-ফেরি থেকেই লাফিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন বিখ্যাত গীতিকার কবি পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়।
দেখতে দেখতে চলে এল ফেয়ারলি। সেখান থেকে বাসে চলে এলাম ধর্ম তলা। তখন ঘড়িতে রাত আটটা। হোটেল ফিরে শেষ হল আমার সেদিনকার উদ্দেশ্যহীনভাবে কলকাতা পরিক্রমা। 
 

আরবি/ আরএফ

Link copied!