ঢাকা শনিবার, ২৬ অক্টোবর, ২০২৪

ইতিহাস-ঐতিহ্য ও দৃষ্টিনন্দনে ঘেরা নোয়াখালী

মোঃ আবদুল্যাহ চৌধুরী (নোয়াখালী প্রতিনিধি)

প্রকাশিত: অক্টোবর ২৩, ২০২৪, ১২:৩১ পিএম

ইতিহাস-ঐতিহ্য ও দৃষ্টিনন্দনে ঘেরা নোয়াখালী

ফাইল ছবি

নোয়াখালী জেলা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে চট্টগ্রাম বিভাগের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল। বর্তমান নোয়াখালী জেলা আগে ফেনী, লক্ষ্মীপুর এবং নোয়াখালী জেলা নিয়ে একটি বৃহত্তর অঞ্চল ছিল, যা এখনও বৃহত্তর নোয়াখালী নামে পরিচিত।

নোয়াখালী জেলার মোট আয়তন ৪২০২ বর্গ কিলোমিটার। নোয়াখালী জেলার উত্তরে কুমিল্লা, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, পূর্বে ফেনী ও চট্টগ্রাম জেলা এবং পশ্চিমে লক্ষীপুর ও ভোলা জেলা অবস্থিত। এই জেলার প্রধান নদী মেঘনা । এছাড়াও উল্লেখযোগ্য নদ-নদীর মাঝে ছোট ফেনী, ডাকাতিয়া অন্যতম। ডাকাতিয়া ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য হতে কুমিল্লার বাগছাড়া দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ডাকাতিয়া নদীর দৈর্ঘ্য ২০৭ কি.মি. যার মধ্যে ১৮০ কিমি কুমিল্লায় ও ২৭ কিমি নোয়াখালীতে প্রবাহিত হয়েছে। ছোট ফেনী নদী ভারতের ত্রিপুরার পাহাড়ী অঞ্চল হতে কুমিল্লার দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত হয়ে গুনবতি নামক স্থান দিয়ে নোয়াখালীতে প্রবেশ করেছে।এছাড়াও নোয়াখালীতে বহু খাল রয়েছে যার মধ্যে নোয়াখালী খাল উল্লেখযোগ্য।

দেশে জেলা প্রশাসন প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার সময় থেকেই। ১৭৭২ সালে কোম্পানীর গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস এদেশে প্রথম আধুনিক জেলা প্রশাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের প্রচেষ্টা নেন। তিনি সমগ্র বাংলাদেশকে ১৯টি জেলায় বিভক্ত করে প্রতি জেলায় একজন করে কালেক্টর নিয়োগ করেন। এ ১৯টি জেলার একটি ছিল কলিন্দা। এ জেলাটি গঠিত হয়েছিল মূলতঃ নোয়াখালী অঞ্চল নিয়ে। কিন্ত ১৭৭৩ সালে জেলা প্রথা প্রত্যাহার করা হয় এবং প্রদেশ প্রথা প্রবর্তন করে জেলাগুলোকে করা হয় প্রদেশের অধীনস্থ অফিস। ১৭৮৭ সালে পুনরায় জেলা প্রশাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয় এবং এবার সমগ্র বাংলাদেশকে ১৪টি জেলায় ভাগ করা হয়। এ ১৪ টির মধ্যেও ভুলুয়া নামে নোয়াখালী অঞ্চলে একটি জেলা ছিল। পরে ১৭৯২ সালে ত্রিপুরা নামে একটি নতুন জেলা সৃষ্টি করে ভুলুয়াকে এর অন্তর্ভূক্ত করা হয়। তৎকালে শাহবাজপুর, হাতিয়া, নোয়াখালীর মূল ভূখন্ড, লক্ষ্মীপুর ,ফেনী , ত্রিপুরার কিছু অংশ, চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ ও মীরসরাই নিয়ে ছিল ভুলুয়া পরগনা। ১৮২১ সালে ভুলুয়া নামে স্বতন্ত্র জেলা প্রতিষ্ঠার পূর্ব পর্যন্ত এ অঞ্চল ত্রিপুরা জেলার অন্তর্ভূক্ত ছিল। ১৮৬৮ সালে ভুলুয়া জেলাকে নোয়াখালী জেলা নামকরণ করা হয়।

১৯৭১-এর স্বাধীনতা সংগ্রামে পাক হানাদার বাহিনীর সাথে বহু রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে নোয়াখালীর মাটি রঞ্জিত হয়ে আছে। ১৫ই জুন, ১৯৭১ সালে সোনাপুর আহমদীয়া স্কুলের সম্মুখ যুদ্ধে প্রায় ৭০ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়। ১৯৭১ সালের ১৯ আগস্ট পাকবাহিনী বেগমগঞ্জ থানার গোপালপুরে গণহত্যা চালায়। নিহত হন প্রায় ৫০ জন নিরস্ত্র মানুষ। নোয়াখালী জেলা স্বাধীন হয় ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর।

ভৌগোলিক অবস্থান

নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও ফেনী মহকুমা নিয়ে নোয়াখালী জেলা চট্টগ্রাম বিভাগের অর্ন্তভূক্ত একটি বিশাল জেলা হিসেবে পরিচালনা হয়ে আসছিল। ১৯৮৪ সালে সরকারি সিদ্ধান্ত মোতাবেক সকল মহকুমাকে জেলায় রূপান্তর করা হলে লক্ষ্মীপুর ও ফেনী জেলা আলাদা হয়ে যায়। শুধুমাত্র নোয়াখালী মহকুমা নিয়ে নোয়াখালী জেলা পুনর্গঠিত হয়।

ইতিহাস 

নোয়াখালী জেলার প্রাচীন নাম ছিল ভুলুয়া। নোয়াখালী সদর থানার আদি নাম সুধারাম। ইতিহাসবিদদের মতে একবার ত্রিপুরা-র পাহাড় থেকে প্রবাহিত ডাকাতিয়া নদীর পানিতে ভুলুয়া-র উত্তর-পূর্বাঞ্চল ভয়াবহভাবে প্লাবিত হয় ও ফসলি জমির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসাবে ১৬৬০ সালে একটি বিশাল খাল খনন করা হয়, যা পানির প্রবাহকে ডাকাতিয়া নদী হতে রামগঞ্জ, সোনাইমুড়ী ও চৌমুহনী হয়ে মেঘনা এবং ফেনী নদীর দিকে প্রবাহিত করে। এই বিশাল নতুন খালকে নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় "নোয়া (নতুন) খাল" বলা হত, এর ফলে অঞ্চলটি একসময়ে লোকের মুখেমুখে পরিবর্তিত হয়ে "নোয়াখালী" হিসাবে পরিচিতি লাভ করতে শুরু করে। নোয়াখালী জেলার মর্যাদা পায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী কর্তৃক

প্রশাসনিক এলাকাসমূহ 

নোয়াখালী জেলায় ৯টি উপজেলা, ১০টি থানা, ৮ টি পৌরসভা, ৭২ টি ওয়ার্ড, ১৫৩ টি মহল্লা, ৯১ টি ইউনিয়ন, ৮৮২ টি মৌজা এবং ৯৬৭ টি গ্রাম রয়েছে।উপজেলাঃ নোয়াখালী জেলার ৯টি উপজেলা হচ্ছে : নোয়াখালী সদর, বেগমগঞ্জ, চাটখিল, কোম্পানীগঞ্জ, হাতিয়া, সেনবাগ, সুবর্ণ চর, সোনাইমুড়ি ও কবিরহাট উপজেলা । আর জেলায় রয়েছে ৮ টি পৌরসভা এগুলো হলো: নোয়াখালী পৌরসভা, চৌমুহানী, চাটখিল, বসুরহাট, হাতিয়া, সেনবাগ, সোনাইমুড়ি ও কবিরহাট পৌরসভা।

জনসংখ্যা 

২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী নোয়াখালী জেলার মোট জনসংখ্যা ৩১,০৮,০৮৩ (পুরুষ- ১৪,৮৫,১৬৯ এবং মহিলা- ১৬,২২,৯১৪)। পুরুষ এবং মহিলার অনুপাত ৯২ঃ১০০, জনসংখ্যার ঘনত্ব ৮৪৩/ বর্গ কিলোমিটার এবং জন্মহার ১.৮৩%। জেলার শিক্ষার হার ৫১.৩%। শহরের শিক্ষার হার ৬০.৭%।

ধর্ম

জেলার মোট জনসংখ্যার ৯৫.৪২% ইসলাম, ৪.৫২% হিন্দু, ০.০২% খ্রীস্টান, ০.০৩% বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। নোয়াখালী জেলায় ৪১৫৯ টি মসজিদ, ৪৯৭ টি ঈদগাহ, ২৩৯ টি মন্দির, ২ টি প্যাগোডা এবং ১ টি ক্যাথলিক খ্রিস্টান গীর্জা রয়েছে।

নোয়াখালীর শহর 

নোয়াখালী সদর মাইজদী ৯টি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত। শহরের মোট জনসংখ্যা ৭৪,৫৮৫ জন। নোয়াখালী সদরের আদি নাম সুধারাম। ১৯৪৮ সালে যখন থানা সদর দফতর মেঘনা গর্ভে বিলীন হয়ে যায়, তখন তা ৮ কিলোমিটার উত্তরে সরিয়ে বর্তমান মাইজদীতে স্থানান্তর করা হয়। চৌমুহনী নোয়াখালীর আরেকটি ব্যস্ত শহর ও বাণিজ্য কেন্দ্র, যা একসময়ে মুদ্রণ, পাট ও প্রকাশনা ব্যবসার জন্য বিখ্যাত ছিল। বর্তমান বসুরহাট শহরটি দ্রুত বেড়ে উঠছে এবং ব্যস্ত শহরের রুপ নিচ্ছে ।

অর্থনীতি 

নোয়াখালী জেলার অর্থনীতি মূলত কৃষি নির্ভর। আঞ্চলিক জিডিপির প্রায় ৪০ % কৃষি খাত থেকে আসে এবং জেলার ৮০ ভাগ লোক এই পেশার সাথে সংশ্লিষ্ট। নিন্মভূমি অঞ্চল হওয়াতে এই জেলায় প্রচুর মৎস্য চাষ হয়ে থাকে যা এই অঞ্চলের অর্থনীতিতে বিশাল ভূমিকা পালন করে। ফসল উৎপাদন মূলত বছরে একবারই হয়।নোয়াখালী জেলায় শিল্প কারখানা তেমনভাবে গড়ে উঠেনি তবে বর্তমানে বেগমগঞ্জ ও নোয়াখালী সদর উপজেলায় ভারী শিল্প কারখানা স্থাপন ও উৎপাদন শুরু হয়েছে।

শিক্ষা 

নোয়াখালীর শিক্ষার হার ৫১.৩০%। নোয়াখালীতে ০১ টি বিশ্ববিদ্যালয় , ১ টি সরকারী মেডিক্যাল কলেজ, ১টি টেক্সটটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, ১২৪৩ টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ২৮৯ টি ( ১২টি সরকারী ও ২৭৭টি বেসরকারী ) মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ৩৫ টি কলেজ ( ০৮টি সরকারী ও বেসরকারী ২৭টি), ১৬১ টি ( ৩০টি দাখিল ও আলিম ১৩১টি) মাদ্রাসা, ০১টি কৃষি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, ০১টি পিটিআই রয়েছে।

যাতায়াত ব্যবস্থা 

সড়ক, রেল ও নৌ পথে নোয়াখালী জেলার যোগাযোগ ব্যবস্থা অত্যন্ত উন্নত। নোয়াখালী থেকে সড়ক পথে রাজধানী ঢাকা এবং বন্দরনগরী চট্টগ্রামের দূরত্ব যথাক্রমে ১৫১ ও ১৩৪ কি মি। বাসই মূলত দূর যাতায়াতের প্রধানতম মাধ্যম।

পর্যটন স্থান

নিঝুম দ্বীপ, শহীদ ভুলু স্টেডিয়াম, বজরা শাহী মসজিদ, লুর্দের রাণীর গীর্জা, গান্ধী আশ্রম, ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল, চর জব্বর, নোয়াখালী জেলা জামে মসজিদ, মাইজদী, নোয়াখালী কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, মাইজদী, বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ মোহাম্মদ রুহুল আমিন গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর, সোনাইমুড়ী, শ্রী শ্রী রাম ঠাকুরের আশ্রম, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও চৌমুহনী উল্লেখযোগ্য।

 

আরবি/জেআই

Link copied!