স্টেশনে আর ভালো লাগছে না! বের হয়ে চলে গেলাম সদরঘাটের দিকে; কমলাপুরের ভিড়, ট্রেনের ধোঁয়া-সবকিছু পেছনে ফেলে নদীর পাড়ে একটু শান্তি খুঁজতে। সদরঘাটে পৌঁছে দেখি, অন্যরকম এক জগত। এখানে ট্রেনের হুইসেল নেই, আছে ট্রলারের ইঞ্জিনের গর্জন, আছে মানুষের অস্থিরতা। তবু কোথাও যেন মাটির গন্ধ লেগে আছে।
আশপাশে দেখার অনেক কিছুই আছে। আমার নজর পড়ল এক ফকিরের দিকে! তিনি ঘাটের এক কোণে বসে আছেন। সামনে ছেঁড়া কাপড় বিছানো। কেউ এড়িয়ে যাচ্ছে, কেউ তাতে কিছু পয়সা ফেলছে। ফকিরের মুখে কোনো অভিযোগ নেই। বরং একরকম গভীর শান্তি বিরাজ করছে তার চেহারায়। ভাবছি, এই মানুষটির জীবনের লক্ষ্য কি? যে মানুষ নিজের সবকিছু হারিয়েছে, তার কি লক্ষ্য থাকা জরুরি? নাকি লক্ষ্যহীন এই জীবনেই প্রকৃত মুক্তি?
ভাবতে ভাবতে নদীর পাড় ধরে একটু এগিয়ে গেলাম। দেখলাম, এক মাঝি তার ছোট্ট নৌকায় বসে তামাক খাচ্ছে। কিছুক্ষণের জন্য আমার মনে হলো জগতের সবচেয়ে সুখী মানুষকে দেখছি। কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘জনাব! এই নৌকা কি আপনার?’
মনে হলো তিনি খানিকটা বিরক্ত হলেন, তবুও হেসে বললেন, ‘আমার? নদীর জিনিস কি কখনো কারও হতে পারে? আমি শুধু চালাই। নদী তার বুকে চলতে দেয় আর কখনো কখনো কেড়ে নেয়।’
কথাটা শুনে আমি থমকে গেলাম। নদী যেমন কাউকে নিজের করে না, আমাদের জীবনও কি তেমনই নয়? আমরা শুধু ভাড়াটিয়া, জীবন আমাদের নৌকা আর সময় আমাদের নদী। আচ্ছা, মাঝি কি জানে তার এই সাধারণ কথার মধ্যে কত গভীর সত্য লুকিয়ে আছে?
আমি অনুমতি নিয়ে তার নৌকায় কিছুক্ষণ বসলাম। পা দুটো নামিয়ে দিয়েছি পানিতে। বসে থাকতে থাকতে একটা দৃশ্য চোখে পড়লো। ছোট ছোট মাছ দল বেঁধে পানির ওপর লাফাচ্ছে। দেখলাম, তাদের জীবন কত সরল, অথচ গভীর। কোনো কোনো মানুষ মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে। আর মাছটি... জীবনের শেষ মুহূর্তেও মুক্তির জন্য লাফায়। আমি ভাবতে থাকলাম কে বেশি সুখী; মানুষ, না সেই মাছ?
নদীর স্রোত দেখে মনে হলো, এই পানির মতোই আমাদের সময়ও প্রবাহিত হচ্ছে। কোথাও থামছে না, শুধু ছুটছে। আমরা এই স্রোতের অংশ। তবু ভাবি, আমরা থামাতে পারব, নিয়ন্ত্রণ করতে পারব। নদী যেন আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল- ‘তোমাদের এই চেষ্টা, এই অহংকার, সবই বৃথা।’
সন্ধ্যা নেমে আসছে। সদরঘাটে আলো-ছায়ার খেলা। নদীর পানিতে ট্রলারের আলো ভেঙে গিয়ে অদ্ভুত সৌন্দর্য তৈরি করেছে। এই সৌন্দর্য কত ক্ষণস্থায়ী, যেমন আমাদের জীবন। তবে হয়তো এই ক্ষণস্থায়ী মুহূর্তগুলোই আমাদের জীবনকে অর্থবহ করে তোলে।
এখন অনেক রাত, লিখতে আর ইচ্ছে করছে না। কিন্তু সদরঘাটের গল্পগুলো আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। সদরঘাটে দাঁড়িয়ে আজ আবারও অনুধাবন করলাম, ছোট ছোট বিষয়গুলোই জীবনের গভীর সত্যকে প্রকাশ করে। চারপাশে অনেক কিছুই আছে, আমাদের শুধু দেখতে জানতে হয়।
নদী বলে, ‘আমি কোনো দিক জানি না, শুধু বয়ে যাই।’
আমাদের জীবনও তেমনই; দিকহীন, তবু চলমান...
আপনার মতামত লিখুন :