১৯৯১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের রুতগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর উইম্যান’স গ্লোবাল লিডারশিপ (সিডব্লিউজিএল) প্রথম লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার বিরুদ্ধে ১৬ দিনের সক্রিয় প্রচার শুরু করে। সারা বিশ্বে ২৫ নভেম্বর থেকে শুরু হওয়া এই কর্মসূচি ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে। চলতি বছরের প্রতিপাদ্য ‘প্রতি ১১ মিনিটে একজন নারীকে হত্যা করা হয়, নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা বন্ধে একত্র হও’। ১৯৯১ সাল থেকে প্রতি বছর বিশ্বের প্রায় ছয় হাজারের বেশি সংস্থা এই কর্মসূচি গ্রহণ করে। এবার লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা রোধে সচেতনতা বৃদ্ধি, সুরক্ষা নীতি নির্ধারণ, আইনের বাস্তবায়ন, সাংগঠনিক সক্ষমতা বৃদ্ধি, বাল্যবিবাহ রোধ, গার্হস্থ্য সহিংসতা বন্ধ, স্বাস্থ্যঝুঁকি রোধ এবং সার্ভাইভরদের ক্ষমতায়নের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ১৬ দিনের কর্মসূচি এবং প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো নিয়ে দেশের নারী নেত্রী, উন্নয়নকর্মী ও বিশ্লেষকরা কথা বলেছেন দৈনিক রূপালী বাংলাদেশের সঙ্গে। তুলে ধরেছেন- মির্জা হাসান মাহমুদ ও তাহমিনা বৃষ্টি।
নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ করতে হলে বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে হবে। মেয়ে শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ নিশ্চিত করতে হবে। ছেলে শিশুর প্রতি যৌন নির্যাতন বন্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। নারীর প্রতি শ্রমবৈষম্য বন্ধ করতে হবে ইত্যাদি। বিশেষ করে মেয়েরা পরিবারে এবং কর্মক্ষেত্রে সহিংসতার শিকার বেশি হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে পরিবারের মানুষের সচেতন হতে হবে এবং সরকারের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
আমাদের স্লোগান হলো, ‘পারিবারিক আইনে সমতা আনি, নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ করি’। ১৬ দিনের কর্মসূচি শুরু হয় ২৫ নভেম্বর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন থেকে পল্টন মোড় পর্যন্ত র্যালির মাধ্যমে। ১৬ দিনের কর্মসূচি, আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস এবং বিশ্ব মানবাধিকার দিবস ২০২৪ উদযাপন উপলক্ষে গৃহীত কর্মসূচিগুলো পরিকল্পনা অনুযায়ী পালিত হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ই-পোস্টার ও বিষয়ভিত্তিক রিল প্রচারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, সংগঠন, সিটি করপোরেশন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করে সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে। তৃণমূলের নারী-পুরুষ এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা আয়োজন করা হয়েছে। ২ ডিসেম্বর সংগঠনের আনোয়ারা বেগম-মুনিরা খান মিলনায়তনে অংশীজনদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হবে। ৫ ডিসেম্বর জেলা শাখার তরুণ-তরুণীদের সঙ্গে অনলাইনে মতবিনিময়ের মাধ্যমে যুবসমাজকে সম্পৃক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে। ৭ ডিসেম্বর রোকেয়া দিবস উপলক্ষে ‘রোকেয়া রান’ আয়োজন করা হবে, যা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে শুরু হবে। এই কর্মসূচির সমাপ্তি হবে ১০ ডিসেম্বর জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে। এ ধরনের বহুমুখী কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ এবং পারিবারিক আইনে সমতার গুরুত্ব তুলে ধরতে সচেষ্ট।
বাংলাদেশে আইনি ব্যবস্থার ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে, যার কারণে মেয়েরা সহিংসতার শিকার বেশি হয়ে থাকে। দেশের আইন ব্যবস্থার ওপর কড়া নজর দিতে হবে বলেও তিনি মনে করেন। অপরদিকে বাংলাদেশে কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদেরকেও যৌন হয়রানি করা হয় বলেও জানান তিনি। এ ব্যাপারেও সরকার কোনো পদক্ষেপ এখন পর্যন্ত গ্রহণ করেনি। যদিও ২০০৯ সালের হাইকোর্টের নির্দেশে কর্মক্ষেত্রে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এবং পাবলিক প্লেসে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে নির্দেশিকা প্রদান করা হয়েছে। বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬-এর মতো আইনে এখনো অস্পষ্ট শব্দযুক্ত নিষেধাজ্ঞা রয়েছে; যা সংশোধনের প্রয়োজন। বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬-এর ৪২নং আইনে বলা হয়েছে, ‘কোন প্রতিষ্ঠানের কোন কাজে কোন মহিলা নিযুক্ত থাকিলে, তিনি যে পদমর্যাদারই হোন না কেন, তার প্রতি উক্ত প্রতিষ্ঠানের অন্য কেহ এমন কোন আচরণ করিতে পারিবেন না যাহা অশ্লীল কিংবা অভদ্রজনোচিত বলিয়া গণ্য হইতে পারে, কিংবা যাহা উক্ত মহিলার শালীনতা ও সম্ভ্রমের পরিপন্থী?’-এটি অবিলম্বে সংশোধন প্রয়োজন। আমরা আমাদের সংস্কৃতিকে নতুন আকার দিতে পারি। নারীর প্রতি সহিংসতা কমাতে পুরুষদের দৃষ্টিভঙ্গি, বদ্ধমূল মানসিকতা এবং আচরণের পরিবর্তন অপরিহার্য।
লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা প্রতিরোধে জাতীয় থেকে স্থানীয় পর্যায়ে আরও কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন এবং ওয়ার্ডভিত্তিক কমিটিগুলোকে আরও গঠনমূলকভাবে কাজ করতে হবে। এগুলো শুধু নামমাত্র সংগঠন হয়ে থাকলে চলবে না; এদের সচেতনতা সৃষ্টিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে। নারী ও পুরুষ উভয়ের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করাটা অত্যন্ত জরুরি। বিশেষ করে নারীদের আত্মসচেতন হতে হবে এবং নিজেদের অধিকার সম্পর্কে জানতে হবে। পাশাপাশি, পরিবার থেকেই সচেতনতার বীজ বপন করা উচিত। শিশুদের ছোট থেকেই নৈতিক শিক্ষা দেওয়া এবং ভালো-মন্দ স্পর্শের পার্থক্য শেখানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, অনেক শিশু যৌন হয়রানির শিকার হলেও তা প্রকাশ করতে দ্বিধাবোধ করে। এছাড়া প্রশাসনের ভূমিকা আরও কার্যকর এবং জনবান্ধব হওয়া উচিত। ভুক্তভোগীরা অনেক সময় লজ্জা বা ভয়ের কারণে প্রশাসনের সাহায্য নিতে চান না। প্রশাসনের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক সহজ করতে হবে এবং সুরক্ষা ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, সমাজে সচেতনতার আলো ছড়িয়ে দিলে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার মতো সমস্যাগুলো অনেকাংশে কমে আসবে। সামাজিক, পারিবারিক এবং প্রশাসনিক পর্যায়ে সম্মিলিত উদ্যোগই এই সমস্যার দীর্ঘস্থায়ী সমাধান আনতে পারে।
আপনার মতামত লিখুন :