আজ সকালে একা একা হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে ঢুকলাম শহরের একটি পাবলিক লাইব্রেরিতে। নামটি যদিও চোখে পড়ার মতো ছিল না, তবে দরজা দিয়ে ঢুকতেই মনে হলো এখানে এক অন্য জগতের বসবাস। লাইব্রেরির ভেতরের নিস্তব্ধতা বাইরের কোলাহল থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।
ভেতরে ঢোকামাত্রই অন্যরকম এক আবহ আমাকে ঘিরে ধরল। এটা এমন এক জায়গা, যেখানে শব্দ নেই, আছে শুধু শব্দের পেছনের গল্প।লাইব্রেরির ভেতর মানুষের বিচিত্র আনাগোনা। কেউ টেবিলে বসে গভীর মনোযোগে বই পড়ছে, কেউ করিডর ধরে হেঁটে চলে যাচ্ছে। লাইব্রেরির কোণে এক ছেলে কানে হেডফোন দিয়ে বসে আছে। তার সামনে কোনো বই নেই। একটু খেয়াল করতেই বুঝলাম, সে হয়তো এখানে নিজের মতো সময় কাটানোর জন্য এসেছে।
পাশেই একদল তরুণ-তরুণী হাসি-ঠাট্টায় ব্যস্ত। তারা হয়তো ছবি তুলবে বলে এসেছে। তাদের হাতে মোবাইল, মুখে হাসি। লাইব্রেরির পুরোনো কাঠের বুকশেলফ আর দীর্ঘ সারির বইপত্র তাদের ক্যামেরার সামনে কেবল একটি পটভূমি। তাদের মধ্যে থেকে কেউ একজন হাসতে হাসতে বলল, ‘একটা পুরোনো জায়গায় এসে কি সুন্দর এস্থেটিক ছবি তোলা যায়!’ আমি মনের ভেতর হাসলাম। এই জায়গার মর্ম তারা হয়তো পুরোপুরি বুঝতে পারেনি, তবুও তাদের জন্য এই লাইব্রেরি একটা স্মৃতির জায়গা হয়ে থাকবে।
এক কোণে বইয়ের তাকে হাত বোলাচ্ছিলেন এক মধ্যবয়সী মানুষ। তার চোখে এক ধরনের বিষণ্নতা ছিল। তিনি খুব মনোযোগ দিয়ে পুরোনো বইগুলোর মলাটের ওপর হাত বুলাচ্ছিলেন, যেন বইয়ের গল্পগুলো তার নিজের জীবনের সঙ্গে মিশে গেছে। আমার কাছে এসব আধ্যাত্মিকতার মতো অনুভূত হলো।
পাহারাদার বৃদ্ধ মানুষটি গেটের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তার গায়ে পুরোনো ইউনিফর্ম। তার চেহারায় কঠোরতার ছাপ থাকলেও চোখে ছিল মমতা। কাছে গিয়ে কথা বললাম। জানতে চাইলাম, এত মানুষ এখানে আসে, তাদের মধ্যে কী বিশেষত্ব দেখেন? তিনি বললেন, ‘সবাই যে বই পড়তে আসে তা নয়। কেউ আসে স্রেফ সময় কাটাতে, কেউ ছবি তুলতে। কেউ কেউ আবার এমনও আসে, যারা লাইব্রেরির ভেতরের শান্তিতে কয়েক মুহূর্ত হারিয়ে যেতে চায়। অনেকের দিকে তাকালে মনে হয়, বইয়ের চেয়ে তারা নিজেদের জীবনটাই বেশি খুঁজছে।’
লাইব্রেরির কোণের একটি টেবিলে এক তরুণ গভীর মনোযোগে ইতিহাসের একটি বই পড়ছে। তার মুখের অভিব্যক্তিতে স্পষ্ট যে বইটি তাকে এক অন্য জগতে নিয়ে গেছে। চারপাশের কোনো কিছুতেই তার ভ্রূক্ষেপ নেই। হঠাৎ পাশের একদল মানুষের উচ্চস্বরে হাসি আর গল্পের শব্দ শুনে সে বিরক্তি নিয়ে উঠে চলে গেল। বুঝলাম, তারমতো বইপ্রেমীদের জন্য এই পরিবেশ একটু অসহ্য। লাইব্রেরির শান্তি অনেক সময় মানুষের মনোযোগ ধরে রাখতে পারে না।
একটি ছোট টেবিলে এক দম্পতিকে দেখা গেল। তাদের সামনে চায়ের কাপ আর বিস্কুট। বই নয়; তাদের আলাপের বিষয়বস্তু ছিল সংসার আর ভবিষ্যৎ। লাইব্রেরির মতো শান্ত জায়গায় এসে তারা একে অপরের সঙ্গে নিজেদের সময় ভাগ করে নিচ্ছিল।
অন্যদিকে একটি শিশু তার মায়ের সঙ্গে এসেছিল। সে কোনো বইতে আগ্রহ না দেখিয়ে ছুটোছুটি করছিল। মাতৃস্নেহময়ী মা এক হাতে তার পিঠে হাত রেখে আরেক হাতে নিজের বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছিলেন।
আরেক কোণে এক বৃদ্ধাকে দেখলাম। তিনি কোনো বই পড়ছিলেন না, বরং বইয়ের মলাটের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তার হাতে একটি ডায়েরি, যেখানে হয়তো নিজের মনের কথাগুলো লিখছিলেন। লাইব্রেরির নিস্তব্ধতায় তারমতো কারো জন্য হয়তো এটাই ছিল একান্ত সময়।
খেয়াল করলাম, লাইব্রেরির এক কোণে বসে থাকা এক কিশোর মুঠোফোনে গেম খেলছে। তার পাশে রাখা কয়েকটি অর্ধপড়া বই। সম্ভবত বাবা-মায়ের চাপে এখানে এসেছিল, কিন্তু মন তার ভিন্ন জগতে। অন্যদিকে, এক তরুণী বইয়ের তাক থেকে বই বেছে নিচ্ছিলেন, হয়তো তার পড়ার তালিকায় কিছু নতুন সংযোজন হবে।
এই বিচিত্র মানুষগুলোকে দেখে মনে হলো, লাইব্রেরি শুধু জ্ঞানের ভান্ডার নয়; এটি মানুষের জীবনের ছোটখাটো মুহূর্তগুলো ধরে রাখার এক জায়গা। কেউ এখানে আসে বই পড়তে, কেউ আসে নিজের মতো সময় কাটাতে। আবার কেউ আসে নিছক কিউরিসিটি থেকে। প্রতিটি মানুষ আলাদা, কিন্তু এই জায়গাটা যেন তাদের প্রত্যেককে এক সূক্ষ্ম সুতায় বেঁধে রেখেছে।
পাহারাদারের সঙ্গে কথা বলার সময় তার বলা একটি কথা আমার মনে গভীর ছাপ ফেলেছিল। তিনি বলেছিলেন, ‘মানুষের চোখে যা তুচ্ছ, তা অনেক সময় প্রকৃত মূল্যবান হয়। লাইব্রেরি হচ্ছে সেই তুচ্ছ জিনিস, যা এখনো সময়ের লড়াইয়ে টিকে আছে।‘ তার কথার মধ্যে এক ধরনের বিষণ্নতা লুকিয়ে ছিল। হয়তো লাইব্রেরির জনপ্রিয়তা কমে গেছে; কিন্তু এখানে যারা আসে, তাদের জন্য এটি এখনো এক আশ্রয়স্থল।
লাইব্রেরি থেকে বের হওয়ার আগে একটি পুরোনো বই হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ পড়লাম। বইটির পাতা থেকে ভেসে আসা গন্ধ আমাকে অন্য সময়ের গল্প শোনাল। মনে হলো, লাইব্রেরি হলো সময়ের দলিল। মানুষের অনুভূতি, স্বপ্ন আর কল্পনার সংরক্ষণাগার...
আপনার মতামত লিখুন :