ঢাকা মঙ্গলবার, ২৮ জানুয়ারি, ২০২৫
হারুনের ডায়েরি

ধানমন্ডি লেকে এক সন্ধ্যায়

মির্জা হাসান মাহমুদ

প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৬, ২০২৫, ০২:৪১ পিএম

ধানমন্ডি লেকে এক সন্ধ্যায়

ছবি: সংগৃহীত

ধানমন্ডি লেকের ধারে সন্ধ্যার হালকা আলোয় হাঁটতে বের হয়েছি। জায়গাটা সবসময়ই আমার কাছে আশ্রয়ের মতো মনে হয়। আজকের বিকেলটা অন্যরকম। চারপাশে কিছু অদ্ভুত বিষয় চোখে পড়ছে, যা সাধারণত কেউ খেয়াল করে না। হাঁটতে হাঁটতে মনে হলো, আজ প্রকৃতি আমাকে কিছু বলতে চাইছে।


পায়ে চলার পথে দেখলাম লেকের পানিতে একটি পলিথিনের ব্যাগ ভেসে আছে। সেই ব্যাগে আটকে গেছে কয়েকটি ছোট মাছ। তাদের দুর্বল ফ্ল্যাপিং দেখে মনে হলো, যেন মুক্তির জন্য শেষ চেষ্টা চালাচ্ছে। পাশে দাঁড়ানো কয়েকজন মানুষ দৃশ্যটি উপেক্ষা করে নিজেদের মধ্যে হাসি-ঠাট্টায় ব্যস্ত। কী অদ্ভুত! মানুষের মন এতোই অচেতন হয়ে গেছে যে এক ফোঁটা সাহায্য করার চিন্তাও তাদের মনে আসে না। ব্যাগটি তুলে নিয়ে মাছগুলোকে লেকের জলে ছেড়ে দিলাম। মনে হলো, এই ছোট কাজের মাধ্যমে হয়তো নিজের ভেতর কিছুটা সান্ত্বনা খুঁজে পেলাম।


আরেকটু এগিয়ে গিয়ে দেখলাম এক বৃদ্ধা লেকের পাড়ে চুপচাপ বসে আছেন। তার সামনে একটি ছোট বাটি, তাতে কিছু খুচরো পয়সা। তাকিয়ে মনে হলো, তিনি হয়তো নিজের শেষ সম্বল নিয়ে এখানে বসে অপেক্ষা করছেন, যেন কেউ তার দিকে একটু দয়া দেখায়। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক দম্পতি তাকে দেখে কিছুটা বিরক্তি নিয়ে অন্যদিকে সরে গেল। এমন উপেক্ষার মাঝে তার চোখে এক অদ্ভুত শান্তি ছিল। কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম, তিনি এখানে বসে কী করেন। হালকা হাসি দিয়ে বললেন, ‘মানুষের মুখ দেখি। ওতেই দিন কেটে যায়।‘ তার কথায় কোনো হতাশা ছিল না, বরং ছিল এক ধরনের আত্মসমর্পণ।


হাঁটতে হাঁটতে দেখি, লেকের পানিতে একটি ভাঙা নৌকা ভেসে আছে। হয়তো অনেক দিন কেউ এটি চালায়নি। এর জীর্ণ অবস্থা সেই মানুষের গল্প বলে, যারা একসময় অনেক শক্তিশালী ছিল কিন্তু এখন সময়ের হাত ধরে জীবনের মূল স্রোত থেকে হারিয়ে গেছে। পাশেই কয়েকজন তরুণ বসে গান গাইছে। তাদের সুরে কোনো নিয়ম নেই, তবু সেটি শুনে মনে হলো এই অগোছালো সুরের মধ্যেও আনন্দ লুকিয়ে আছে। তাদের মাঝে বসে থাকা এক তরুণ হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমাদের জীবনের মতো গানও এলোমেলো। কিন্তু এর মধ্যেই তো আসল মজা!’ কথাটা শোনার পর মনে হলো, হয়তো সে ঠিকই বলেছে।


লেকের আরেক কোণে দেখলাম একটি কুকুর তার বাচ্চাগুলো নিয়ে বসে আছে। বাচ্চাগুলো পরস্পরের সাথে খেলছে, আর মা কুকুরটি তাদের পাহারা দিচ্ছে। পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া এক ভদ্রলোক তাদের খাবারের জন্য কিছু দিচ্ছিলেন। মানুষ যে সবসময় নির্মম হয় না, তা এই ছোট কাজগুলো প্রমাণ করে। অথচ তার পাশ দিয়ে চলা আরেকজন বললেন, ‘এদের খাওয়ানোর দরকার নেই, এতে এরা বেশি বেড়ে যাবে।‘ কথাটা শুনে ভাবলাম, মানুষের সীমাহীন বিচারবুদ্ধি কত অদ্ভুত! অন্য প্রাণীর জীবন বাঁচানোর প্রয়োজনীয়তাটাও আমরা নিজেরা ঠিক করে দেই।


একটা জায়গায় কিছু তরুণ একটি গাছের নিচে গোল হয়ে বসে গল্প করছে। তাদের কথাবার্তার টুকরো টুকরো অংশ কানে এলো। একজন বলল, ‘জীবন অনেক ছোট, তাই প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করো।‘  অন্যজন বলল, ‘কিন্তু আমাদের সময় তো চাকরি আর টাকার পেছনে ছোটার মধ্যেই চলে যায়।‘  কথাগুলো শুনে মনে হলো, তারা যেন নিজের অজান্তেই জীবনের গভীর অর্থ খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে।


লেকের পাশে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছি, জীবনের প্রতিটি অংশে মানুষ কত ভিন্ন আর কত বৈচিত্র্যময়! কেউ কষ্টে আছে, কেউ আনন্দে, কেউবা উদাসীন। কিন্তু সবাই এই পৃথিবীর গল্পের কোনো না কোনো চরিত্র। হয়তো এভাবেই প্রকৃতি আমাদের জীবনের মানে বোঝাতে চায়।


বিকেলের আলো ফুরিয়ে আসছে। লেকের পাশের বাতিগুলো জ্বলে উঠল। মনে হলো, এই জায়গাটা যেন শহরের মধ্যেও আলাদা এক পৃথিবী। এখানে প্রকৃতির সাথে মিশে মানুষের জীবন, তাদের গল্প আর আমাদের অদ্ভুত আচরণ সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। ধানমন্ডি লেকের এই বিকেল আমাকে শেখাল যে, জীবন শুধু বড় ঘটনাগুলোর জন্য নয়; ছোট ছোট মুহূর্ত আর অবজ্ঞাত দৃশ্যগুলোতেও গভীর কিছু লুকিয়ে থাকে...
 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!