ঢাকা সোমবার, ২৭ জানুয়ারি, ২০২৫
জহিরনামা

দুবলহাটি রাজবাড়ীতে

মিনহাজুর রহমান নয়ন

প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৬, ২০২৫, ০২:৪৪ পিএম

দুবলহাটি রাজবাড়ীতে

ছবি: সংগৃহীত

আজ আসলাম উত্তরবঙ্গের দুবলহাটি রাজবাড়ীতে। প্রথমে আসলাম  নওগাঁ শহর। এরপর সেখান থেকে আসলাম বালুডাঙ্গা। তারপর ঘাপানিয়া, হাপানিয়া থেকে ভ্যান বা অটো রিকশায় আসলাম দুবলহাটি রাজবাড়ী। চাইলে যে কেউ নওগাঁ গোস্তহাটির মোড় হতে অটোরিকশাযোগে দুবলহাটি রাজবাড়ী আসতে পারবেন।

 ইতিহাসবিদদের মতে প্রায় দুইশ’ বছরের পুরোনো এই বাড়িটি। দুবলহাটি জমিদার বংশের প্রতিষ্ঠাতা জগতরাম একজন লবণ ব্যবসায়ী, বাণিজ্য উপলক্ষে দুবলহাটির কাছের গ্রামে এসে বসবাস শুরু করেন এবং বিল অঞ্চলের ইজারা পত্তন গ্রহণ করেন। ধীরে ধীরে তারা প্রচুর জমির মালিক হন। তিনি এই বাড়িটি নির্মাণ করেন। এই এলাকায় খুব বেশি ফসল উৎপন্ন না হওয়ায় মাত্র ২২ কাহন কই মাছ দিয়ে কর দিতেন বলে জানতে পারি। তৎকালীন জামিদার রাজা হরনাথ রায় চৌধুরীর সময়ে এই বাড়িটির ব্যাপক উন্নতি সাধন হয়। 


ইতিহাস ঘেটে জানতে পারি, তাদের জমিদারি ছিল সিলেট, দিনাজপুর, পাবনা, বগুড়া, রংপুর ও ভারতের কিছু অংশে। জানা যায়, প্রায় পাঁচ একর এলাকাজুড়ে বিশাল প্রাসাদ। আর প্রসাদের বাইরে ছিল দীঘি, মন্দির, স্কুল, দাতব্য চিকিৎসালয়, ১৬ চাকার রথসহ বিভিন্ন স্থাপনা। রাজ প্রাসাদের সামনে রোমান স্টাইলের বড় বড় পিলারগুলো রাজাদের রুচির পরিচয় বহন করে। এটা দেখে বোঝা যায় যে, সেই সময় বিলাত থেকে কারিগর নিয়ে এসে এই বাড়িটি নির্মিত হয়েছে। এই বাড়িতে সাড়ে ৩শ’ ঘর ছিল। তার ছিল ৭টি আঙ্গিনা। প্রসাদের ভেতর কোনোটি ৩ তলা আবার কোনোটি ছিল ৪ তলা ভবন।  ১টি গোল্ডেন সিলভার ও ১টি আইভরির তৈরি সিংহাসন ছিল বলে জানা যায়। ব্রিটিশরা সিংহাসন দুটি নিয়ে যায়। ১৮৬৪ সালে রাজ পরিবারের উদ্যোগে একটি স্কুল স্থাপন করা হয়। পরবর্তীতে স্কুলটি নামকরণ হয় রাজা হরনাথ উচ্চবিদ্যালয়। প্রতি বছর স্টেটের খরচে ৫ জন করে গরিব ও মেধাবী ছাত্রদের লেখাপড়ার ব্যবস্থা ছিল এখানে।


আশপাশে অনেক মানুষের সঙ্গে কথা বলি। স্থানীয় বয়স্ক কিছু মানুষ জানায়, রঘুনাথ নামের এক ব্যক্তি এ এলাকায় লবণ ও গুড়ের ব্যবসা করতেন। তিনি দীঘলি বিলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত খয়রা নদী দিয়ে নৌকা যোগে দুবলহাটিতে ব্যবসার জন্য আসেন। তিনি প্রায় প্রতিরাতে স্বপ্ন দেখতেন তাকে কে যেন বলছে, তুই যেখানে নৌকা বেঁধেছিস সেখানে জলের নিচে রাজ রাজেশ্বরী দেবীর প্রতিমা আছে। সেখান থেকে তুলে স্থাপন কর। রঘুনাথ একদিন ভোরবেলা জলে নেমে দেখলেন সত্যিই সেখানে রাজ রাজেশ্বরীর প্রতিমা আছে। তিনি প্রতিমাটি জল থেকে তুলে একটি মাটির বেদি তৈরি করে প্রতিষ্ঠা করলেন। এরপর তার ব্যবসায় ব্যাপক উন্নতি হতে থাকে।


আর খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম অন্য আরেক ঐতিহাসিকদল মনে করেন, দুবলহাটি জমিদার বংশের প্রতিষ্ঠাতা জগতরাম একজন লবণ ব্যবসায়ী, বাণিজ্য উপলক্ষে দুবলহাটির কাছের গ্রামে এসে বসবাস শুরু করেন এবং বিল অঞ্চলের ইজারা পত্তন গ্রহণ করেন। ধীরে ধীরে তারা প্রচুর জমির মালিক হন। বিত্ত-বৈভবের খবর পৌঁছে যায় মোগল দরবারে। মোগল দরবারের নির্দেশে তাকে ডেকে পাঠানো হয় মুর্শিদাবাদ নবাবের দরবারে। নবাব তাকে রাজস্ব প্রদানের নির্দেশ জারি করেন। তিনি নবাবকে জানান, তিনি যে এলাকায় থাকেন সেখানে শুধু জল আর জল। কোনো ফসল হয় না। তবে বড় বড় কৈ মাছ পাওয়া যায়। বিষয় বুঝতে পেরে নবাব তাকে প্রতিবছর রাজস্ব হিসাবে ২২ কাহন কৈ মাছ প্রদানের নির্দেশ দেন। ১৮৯২ খ্রিষ্টাব্দের দিকে জমিদারি প্রথা বিলুপ্তি হওয়ার পর রাজা হরনাথ রায় সপরিবারে চলে যান ভারতে। রাজবংশের স্মৃতিস্বরূপ থেকে যায় বিশাল সুরম্য অট্টালিকা দুবলহাটি রাজবাড়ী। পরবর্তীতে এটি সরকারি সম্পদ হিসেবে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ নিজেদের অধীনে নেয়।
 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!